• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

দেশের বৃহত্তম ‘মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের’ ভেতরে বহু চমক!

  ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:২০
Many surprises inside the country's largest 'women's central prison'
ফাইল ছবি

নারী বন্দী বরণের অপেক্ষায় রয়েছে দেশের বৃহত্তম ও সর্বোচ্চ বন্দী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক সুবিধাসম্বলিত মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জ কারা কমপ্লেক্স সীমানায় ইতোমধ্যেই নতুন এ মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারটি নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে সরকার। বিশেষ এ কারাগারটি উদ্বোধনের সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করেছে কারা অধিদপ্তর। হাই সিকিউরিটি সম্পন্ন, সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ও আয়তনে বিশাল এবং আধুনিক সুবিধাসম্বলিত এ কারাগারটিতে শুধু নারী বন্দী আটক রাখা হবে। এর মাধ্যমে ঢাকা মহানগর ও জেলার বিভিন্ন অপরাধের বন্দীদের অন্যত্র না নিয়ে ঢাকাতেই আটক রাখার পথ সুগম হচ্ছে। বর্তমানে সকল নারী বন্দীদের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়।

আজ সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চূয়াল পদ্ধতিতে এই কারাগারটির শুভ উদ্বোধন করবেন বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন। সরকারের নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্পের সঙ্গে এ কারাগারটির শুভ উদ্বোধন করা হবে।

কাশিমপুর গাজীপুরের কাশিমপুরে দেশের প্রথম মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণের পর দেশে এটি দ্বিতীয় মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার। এতে বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত উভয় প্রকারের বন্দী রাখা হবে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হওয়া নারী বন্দীর আধিক্য ও ঢাকাসহ সারাদেশের নারী বন্দীদের সুবিধার্থে এই বিশেষ কেন্দ্রীয় কারাগারটির নির্মাণ করা হয়েছে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় এ কারাগারটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর নির্মাণ কাজ চলতি বছরের মার্চ মাসে শেষ হলেও করোনাভাইরাসের কারণে এতদিন এটি চালু করা সম্ভব হয়নি।

কারা সূত্র জানায়, সাধারণত কারাগার উদ্বোধনের পরপরই বন্দীদের আটক রাখার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে কারাগারে বন্দী আনার পর উদ্বোধন করা হয়। তবে এক্ষেত্রে এ কারাগারটি ব্যতিক্রম। আজ এ কারাগারটি উদ্বোধন করা হলেও আজ থেকেই এ কারাগারে কোন প্রকার বন্দী রাখা হবে না। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে আপাতত বন্দী রাখা হবে না। কারাবন্দীদের স্বার্থে কারা কর্তৃপক্ষ দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ কারাগারে কোন বন্দী না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রথমে আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনারদের জন্য এ কারাগারটি তৈরি করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে সরকারের নির্দেশে সকল প্রকার বন্দী থাকার জন্য তৈরির নির্দেশ দেয় সরকার। কেরানীগঞ্জ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ২ টি পুরুষ ও একটি মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণের কথা থাকলেও এ থেকে সরে আসে সরকার। এর স্থলে কেরানীগঞ্জে ১টি পুরুষ কেন্দ্রীয় কারাগার ও ১টি মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ১টি আধুনিক কারা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। মোট ১৯৪ একর জমির ওপর গৃহীত কারা কমপ্লেক্স সীমানায় ৩০ একর জমিতে এই কারাগারটি নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৫ সালে মূল প্রকল্পটি শুরু হলেও ২০২০ সালের মার্চে এর পুরো কাজ শেষ হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট প্রকল্প ব্যয় হয় ৪৬৪ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে কারা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেন প্রকল্প পরিচালক উপসচিব জুহুরুল আলম চৌধুরী।

জানা গেছে, মহিলা এ কেন্দ্রীয় কারাগারটি হচ্ছে দেশের আধুনিক সুবিধাসম্বলিত মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারাগারটিতে মোট ৩০০ বন্দী ধারণক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো পৃথক পৃথক সেলের যাতে বন্দীর শ্রেনীবিন্যাস করে রাখা যায় সেজন্য আলাদা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

গতকাল শনিবার সরেজমিনে কারাভ্যন্তরে গিয়ে দেখা গেছে, কেরানীগঞ্জের নতুন কারাগারটি উদ্বোধনের জন্য সাজানো হয়েছে। কারাভ্যন্তরে প্রবেশ পথেই বেলুন ও ফুল দিয়ে নানা রঙে রাঙানো হয়েছে। কারাগারের বন্দীদের প্রবেশের রাস্তায় কারাবন্দী চিত্রশিল্পী দিয়ে নানা রকমের ফুল আঁকা হয়েছে। প্রতিটি ভবনের পৃথক নাম দেয়ার কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। কারাগারটি চালুর সকল প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করা হয়েছে। যে কোন সময় এ কারাগারটি ব্যবহার করার উপযুক্ত করার অবস্থায় রয়েছে।

নতুন কারাগারে মোট ১০টি ভবন রয়েছে। এসব ভবনের নাম হচ্ছে, বেগম রোকেয়া বন্দী ব্যারাক। এটিই কারাগারের প্রধান ভবন। এতেই সবচেয়ে বেশি বন্দী আটক রাখা হবে। ৪ তলাবিশিষ্ট এ ভবনটিতে মোট ১২টি ওয়ার্ড রয়েছে। এ ভবনটিতে বর্তমানে কারাবন্দী ও কারারক্ষীসহ কর্মকর্তা কর্মচারীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখাসহ কোভিড-১৯ এর রোগীদের পরীক্ষার কাজ করা হয়। আইসিআরসির সহায়তায় এর কাজ চালানো হয় বলে জানা গেছে।

অপর ভবনগুলো হচ্ছে ‘ইলা মিত্র সেন ভবন’, নতুন কারাগারটিতে ১২ জন ডিভিশনপ্রাপ্ত (প্রথম শ্রেণীর বন্দী) রাখা হবে। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘সুলতানা রাজিয়া ভবন’। যেখানে ৪ টি সেলে সর্বোচ্চ ৩ জন করে নারী বন্দী রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।

‘ডাঃ কাদম্বিনী মেডিক্যাল ভবন’ বা কারা হাসপাতাল, কারাবন্দীদের চিকিৎসার জন্য ৩ তলাবিশিষ্ট এ হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়েছে।

‘প্রীতিলতা কিশোরী ভবন’, কিশোর অপরাধ করে কারাগারে যাওয়া নারীদের অন্য নানা অপরাধে আটক হওয়া বন্দী থেকে পৃথক করে রাখার জন্য যেখানে ১৮ বছরের নিচের যে কোন বন্দী অস্থায়ীভাবে এ ওয়ার্ডে রাখা হবে।

জঙ্গী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, আলোচিত মামলার আসামি ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সকল নারী বন্দীকে আটক রাখার জন্য দেশে এই প্রথমবারের মতো কারাগারের ভেতরেই পৃথকভাবে ‘হাই সিকিউরিটি’ সম্পন্ন সেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই সেলে মোট ৩০ জন দুর্ধর্ষ নারী বন্দীকে আটক রাখা হবে। এছাড়া ফাঁসির সেল ও সাধারণ বন্দীদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে।

এর বাইরে প্রথমবারের মতো তৈরি করা হয়েছে ‘মেন্টাল ওয়ার্ড’। মানসিকভাবে অসুস্থ নারী বন্দীরা থাকবেন এ ওয়ার্ডে। উৎপাদন ওয়ার্ড ভবন। এতে সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের নানা কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

নারী বন্দীদের কারাভ্যন্তরে বই পড়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে গ্রন্থাগার বা পাঠাগার। এ ভবনটির নাম দেয়া হয়েছে ‘শহীদ জাহনারা ইমাম গ্রন্থাগার’। এছাড়া কর্তব্যরত সকল কারারক্ষীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে গার্ড হাউস।

এর বাইরে এই প্রথমবারের মতো কোন কারাগারের ভেতরে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ‘ওয়াশিং প্লান্ট ভবন’ তৈরি করা হয়েছে। এ মেশিন দিয়ে এই কারাগারের সকল বন্দীর ব্যবহারিত কম্বল ও বিশেষ প্রয়োজনে অন্য যে কোন কারাগারের কম্বল ওয়াশিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। কম্বল অতি দ্রুত ধোয়া ও শুকাতে এই আধুনিক অটোমেটিক মেশিন ব্যবহার করা হবে। যা স্থাপন করা হয়েছে।

পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের সাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটি কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরকালে এই কারাগারের আটক সকল নারী বন্দীদের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কেরানীগঞ্জ কারাগারটি শুধু পুরুষ বন্দীদের জন্য তৈরি হওয়ায় ও কোন নারী বন্দী আটক রাখার সুযোগ না থাকায় তাদের সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

বর্তমানে কাশিমপুর মহিলা কারাগারে ধারণ ক্ষমতার ৩ গুণের বেশি বন্দী বসবাস করছে। কারাসূত্র জানায়, নতুন এ কারাগারটিতে নারী কর্মকর্তা কর্মচারী কর্তৃক পরিচালিত হবে। যেখানে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন কর্মকর্তা কর্মচারী নারী থাকবেন। নারী বন্দীদের সুবিধার্থেই এমন পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক উপ-সচিব জহুরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ক্রমান্বয়ে নারী বন্দী বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বেশ কিছু ব্যতিক্রমী সুবিধাসহ দেশের বৃহত্তম মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারটি নির্মাণ করেছে সরকার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জ কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত এ কারাগারটির নির্মাণকাজ গত মার্চ মাসে শেষ করা হয়েছে ও কারা কর্তৃপক্ষতে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কারাগারটিতে এই প্রথমবারের মতো জঙ্গীসহ দুর্ধর্ষ নারী বন্দীদের আটক রাখতে হাই সিকিউরিটি সেল ও কিশোরী সেল নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও মানসিক রোগে আক্রান্ত নারী বন্দীদের পৃথক রাখতে মেন্টাল সেল ও লাইব্রেরি ও হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রায় ৩০ একর জমিতে গড়ে ওঠা এ কারাগারটিতে বন্দী ধারণ ক্ষমতা ৩০০ জন। অপরদিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারটির আয়তন মাত্র ৮ দশমিক ৫০ একর ও বন্দী ধারণ ক্ষমতা ২০৮ জন। নতুন কারাগারটি চালু হলে নারী বন্দীদের আবাসন সঙ্কট অনেকাংশে কমবে। একইসঙ্গে নারী বন্দী ব্যবস্থাপনায় নতুনত্ব আসবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নতুন মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারটির বর্তমানে সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জের সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, আমাদের কারাগারটি মূলত পুরুষ বন্দীদের জন্য তৈরি হয়েছে। তাই বর্তমানে আদালত থেকে পাঠানো যে কোন নারী বন্দীদের আমাদের কারাগারে পাঠানোর পর তাদের বাধ্য হয়েই গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাতে হয়। কাশিমপুর অনেক দূর হওয়ায় একজন নারী বন্দীকে সেখানে পৌঁছানো অত্যন্ত কষ্টকর ও সময় সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আয়তনে ও বন্দী ধারণ ক্ষমতায় দেশের বৃহত্তম এবং দ্বিতীয় মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে কেরানীগঞ্জে এটি নির্মাণ করায় এখন থেকে আর কোন নারী বন্দীকে কষ্ট করে কাশিমপুর যেতে হবে না। নতুন কারাগারটি তৈরির পর থেকে এর সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ আমরাই করছি। আজ কারাগারটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি দেশের অন্য প্রকল্পের সঙ্গে উদ্বোধন করবেন। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুনের নির্দেশে উদ্বোধনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। করোনাভইরাসের প্রকোপের কারণে বন্দীর স্বার্থ সুরক্ষার কথা ভেবে এখনও এতে বন্দী আনা হয়নি। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কারাগারটি চালু হলে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ কাশিমপুর থেকে নারী বন্দীদের এনে রাখা হবে। এতে করে নারী বন্দীদের আবাসন সঙ্কটসহ নানা সঙ্কট বর্তমানের চেয়ে অনেকাংশে লাঘব হবে।

কেএফ

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh