• ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
logo

বছরজুড়ে অগ্নিকাণ্ডে মানুষের স্বপ্ন পুড়ে ছাই

  ২২ ডিসেম্বর ২০২০, ২১:০৭
Throughout the year, fire, burn, people, dreams, ashes
বছরজুড়ে অগ্নিকাণ্ডে মানুষের স্বপ্ন পুড়ে ছাই

চলতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষ সর্বশান্ত হয়েছেন। আশ্রয়ের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে পথে বসেছেন তারা। বহু পরিবার আগুনের ভয়াবহ লেলিহান শিখায় হারিয়েছেন পরিবারের শেষ কর্মক্ষম মানুষটিকেও। বছরজুড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পুষিয়ে উঠতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও। রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সূত্রপাতের পেছনে মানুষের অসচেতনতা, ঘনবসতি ও অপরিকল্পিত নগরায়ণকে দায়ী করেছেন নগরপরিকল্পনাবিদরা।

ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্টরা জানায়, দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আর সবচেয়ে কম অগ্নিকাণ্ড সিলেট বিভাগে। নতুন গঠিত ময়মনসিংহ বিভাগেও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা সিলেটের চেয়ে বেশি। ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি। ঢাকায় ঘনবসতি ও অলিগলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে না পারায় ঢাকায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। ব্যবসায়িক এলাকা পুরনো ঢাকায় সড়কগুলো একেবারেই সরু। কোনো সড়কেই দুটি গাড়ি পাশ কাটানোর জায়গা নেই। পুরনো ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এখন অগ্নিকাণ্ডের সময়ে ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ি প্রবেশে সমস্যায় পড়ছে।

জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমিয়ে আনতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিলেও তা মানছে না। ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমছে না। গতকাল সোমবার (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীর মিরপুরের কালশি বস্তির অর্ধশতাধিক ঘর আগুনে ভষ্মিভূত হয়েছে। একই বস্তিতে কয়েক বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসময় ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট ঘণ্টাখানে চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনলেও ততক্ষণে বস্তির ৫৫টি ঘর পুড়ে ছাই। শুধু মিরপুর কালশি বস্তি নয়, রাজধানীসহ সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই মানুষের স্বপ্নে গড়া সংসার পুড়ে হচ্ছে ছাঁই।

অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (অ.দা.) মো. সিরাজুল ইসলাম আরটিভি নিউজকে বলেন, সারা দেশের তুলনায় ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটছে। আর এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনে মূল তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত মানুষের অসচেতনতা, দ্বিতীয়ত ঘনবসতি এবং তৃতীয় অপরিকল্পিত নগরায়ণ। দেখা গেছে, মানুষ অসচেতনভাবে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখছেন কিংবা বৈদ্যুতিক সংযোগে দুর্বল তার ব্যবহার করছেন। এসব কারণে বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে।

তিনি আরও বলেন, ঢাকায় কিভাবে অগ্নিকাণ্ড কমিয়ে আনা যায় সেই বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন যৌথভাবে কাজ করছে। তবে নগর পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজউক যদি রাজধানীর প্রতিটি ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক ও কঠোরভাবে মনিটরিং করতে পারলে অগ্নিকাণ্ডসহ অনেক দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করনে এই নগরপরিকল্পনাবিদ।

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম আরটিভি নিউজকে বলেন, বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর পেছনে কোনো অপশক্তি থাকলেও তা অধিকাংশ সময়ে প্রতিবেদনে উঠে আসে না। ফলে একই বস্তিতে কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ এবং দোষীদের সাজার আওতায় আনলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো কিছুটা কমানো সম্ভব।

রাজধানীর নীমতলি, চুড়িহাট্টা কিংবা এফআর টাওয়ারের মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা চলতি বছরে ঘটেনি। কিন্তু বছরজুড়ে রাজধানীসহ সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এতে শতশত কোটি টাকার ক্ষতির পাশপাশি আগুনে পুড়ে বহু মানুষ মারা যান।

চলতি বছরে ঢাকায় বেশকিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে

২০২০ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকা আইনজীবী সমিতির ভবনে আগুন লাগ দিয়ে শুরু হয়। তখন খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে। ৫ জানুয়ারি সাভারের আশুলিয়া বাজারে আজিজ সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগে। এখানেও ইপিজেড ও উত্তরা ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট একযোগে কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ৯ জানুয়ারি ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় স্টলে আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট কয়েক ঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

মিরপুরে চলন্তিকা বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনায় পারভিন (৩৫) নামে দগ্ধ এক নারীর মৃত্যু হয়। পুরান ঢাকায় বকশি বাজারে আগুন লাগে। ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি বস্তির আগুন লাগে সেখানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ২২টি ইউনিট কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ২৭ ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের একটি পাঁচতলা ভবনের গ্যারেজে অগ্নিকাণ্ডে শিশুসহ তিনজন নিহ হয়। ১১ মার্চে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর বস্তিতে ভয়াবহ আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছিল ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি ইউনিট। এই বস্তিতে শতশত ঘর পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়।

২৭ মে রাজধানীর গুলশান-২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুন লাগে। আগুনের স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র ১০ মিনিট। আর এই ১০ মিনিটে আগুনে মারা যায় ৫ জন। ২৫ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটের দেবিদ্বারঘাট লেনের একটি পলিথিন কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছিল ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট।

২৫ আগস্ট নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জের আড়িয়াবো এলাকায় একটি স্টিল ফার্নিচারের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট কাজ করেছিল। এভাবে বিচ্ছিন্ন আগুন লাগার ঘটনায় চলতি বছরে দেশের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ২৩ নভেম্বর রাতে মহাখালী সাত তলা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ৩০০টি ঘর ও দোকানপাট আগুনে পুড়ে যায়। একই দিনে রাজধানীর মাতুয়াইলের কোনাপাড়ায় বৈদ্যুতিক বাতি উৎপাদন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ ইউনিট আগুন কাজ করেছিল। ঠিক দু’দিন পর ২৫ নভেম্বর মিরপুরে কালশি বস্তিতে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ৫০টি ঘর।

১২ ডিসেম্বর চকবাজারের চুড়িহাট্টার কাছেই উর্দু রোডে ‘নোয়াখালী বিল্ডিং’ নামে ৪ তলা ভবনের প্লাস্টিক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরমধ্যেই অর্ধশত প্লাস্টিক কারখানা পুড়ে ছাই হয়। সর্বশেষ গতকাল সোমবার (২১ ডিসেম্বর) ঢাকার মিরপুর কালশি বস্তিতে আগুনের ঘটনায় অর্ধশতাধিক ঘর আগুনে ভষ্মিভূত হয়।

ঢাকা ছাড়াও বিভাগীয় অঞ্চলে চলতি বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে

২০২০ সালের ২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানার কাটগড়া এলাকায় শিপিং স্টোরের গুদামে আগুন লাগলে মো. জাবেদ (১৮) ও আজিজ নামে দুই তরুণের মৃত্যু হয়। বুধবার দিবাগত গভীর রাতে পতেঙ্গা থানার কাটগড় এলাকায় এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের একটি ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণে একই পরিবারের তিনজন দগ্ধ হয়।

৩ জানুয়ারি কক্সবাজার শহরের নতুন বাহারছড়া গাড়িরমাঠ এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘরে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে। ৫ জানুয়ারি দিনাজপুরে একটি খামারে আগুন লাগার ঘটনায় ৪৫টি ছাগল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলায় পৃথক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১৩টি ঘর পুড়ে যায়। চট্টগ্রামের হালিরশহরে একটি ব্যাচেলর কলোনিতে আগুনের ঘটনায় দুই যুবক নিহত হয়।

১০ জানুয়ারি গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ি জরুন এলাকায় ইসলাম গ্রুপের একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরে কাশিমপুর ডিবিবিএল, কালিয়াকৈর ও জয়দেবপুর ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিটের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

২৮ জানুয়ারি বিয়েতে হবিগঞ্জ থেকে সপরিবারে মৌলভীবাজার আগুনের ঘটনায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। পিংকি সু স্টোরের মালিক সুভাষ রায় (৬৫), সুভাষ রায়ের মেয়ে প্রিয়া রায় (১৯), সুভাষ রায়ের ভাইয়ের স্ত্রী দিপ্তী রায় (৪৮), সুভাষ রায়ের শ্যালকের স্ত্রী দীপা রায় (৩৫) ও দীপা রায়ের মেয়ে বৈশাখী রায় (৩)। পৌরশহরের সেন্টাল রোডের দোতলা ভবনের যে দোকানে আগুন লেগেছিল ওই দোকানের ওপরের বাসায় স্বজনদের সঙ্গে এক ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন দীপা রায়। আগুন লাগার পর বাসার অন্যান্য সদস্যদের মতো দীপা রায়ও বাসায় আটকা পড়েন। প্রাণ বাঁচাতে আরও অনেকের সঙ্গে তার ছেলে বাসার বাইরে আসতে পারলেও ছোট মেয়ে বৈশাখীকে নিয়ে বের হতে পারেননি মা দীপা রায়। ফলে অন্য তিনজনের সঙ্গে মারা যান মা-মেয়ে।

৫ সেপ্টম্বর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুলে ইঞ্জিনিয়ারিং টেক্সটাইল নামক এস.আলম গ্রুপের একটি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সীতাকুণ্ড, কুমিরা ও আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট কাজ নিয়ন্ত্রণ আনে। ২৩ জুন নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বয়ারচরের চেয়ারম্যান ঘাট এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৫টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই সময়ে আগুনে দগ্ধ হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়।

৩০ নভেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈর বাজারে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক দোকান পুড়ে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট একযোগে কাজ করে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমাতে মানুষের সচেতনতা ও পরিকল্পিত ভবন গড়ার তাগিদ দিয়েছেন নগরপরিকল্পনাবিদরা।

এফএ

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনেও স্বপ্নভঙ্গ কভেন্ট্রির, ফাইনালে ম্যানইউ
তীব্র তাপদাহে খেটে খাওয়া মানুষের পাশে ডিএমপি
হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ পুড়ে ছাই, রক্ষা পেল ৭ শিশু
‘স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র বাছাই হবে’
X
Fresh