‘কেউ যদি আমার পাগল ছেলেটাকে সুস্থ করে দিতো’
জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের খাঁয়েরপাড়া গ্রামে চিকিৎসার অভাবে সোহেল নামে এক যুবক প্রায় ১২ বছর ধরে শিকলবন্দি জীবন-যাপন করছেন। সোহেলের বাবার নাম আবু বক্কর সিদ্দিক। তিনি পেশায় একজন কৃষক। মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন সোহেলের আরও দুই ভাই-বোন রয়েছে। বড় বোন শিল্পীর বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় ১৫ বছর আগে। অপর বড় ভাইয়ের নাম রুবেল।
আর দশটা শিশুর মতোই স্বাভাবিকভাবে জন্ম হয়েছিলো সোহেলের। দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে কৃষক আবু বক্করের সংসার ভালোই চলছিলো। তখন রুবেলের বয়স আট বছর আর সোহেলের বয়স সাত বছরের মতো হবে। কৃষক আবু বক্কর অনেক স্বপ্ন নিয়ে দুই ছেলেকে স্কুলে পাঠান।
কিছুদিন যেতে না যেতেই বড় ভাই রুবেল বাবা-মাকে জানান, সোহেল স্কুলে ঠিকমতো থাকে না। অন্য শিক্ষার্থীদের মারধর করে। একপর্যায়ে সোহেলের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সোহেলের বাবা-মা তখন বুঝতে পারেন তাদের ছেলের কিছুটা মানসিক সমস্যা আছে। পরে তারা সোহেলকে পল্লী চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু কোনও কাজ হয় না; বরং পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন সোহেল।
তার পাগলামি দিন দিন বেড়ে যায়। তখন তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জামালপুরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে অনেক দিন চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু কোনও কাজ হয় না। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য সোহেলকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান ওই ক্নিনিকের চিকিৎসকরা। কৃষক আবু বক্কর তখন ধার-দেনা করে সোহেলকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে প্রায় তিন মাস চিকিৎসা দেয়া হয় সোহেলকে। কিন্তু ততোদিনে ঋণে জর্জরিত কৃষক আবু বক্করকে ছেলের চিকিৎসা বন্ধ করে বাড়ি নিয়ে যেতে হয়।
এদিকে বাবার ঋণের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সোহেলের পাগলামীও। এ সময় সে বাড়ির লোকজনসহ প্রতিবেশীদের মারধর শুরু করে। পরিচিতরা সোহেলের এসব পাগলামী সহ্য করে নিলেও অপরিচিতরা তাকে উল্টো মারধর করে। এতে করে তার পাগলামী আরও বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে বাবা-মা ছেলের পায়ে শিকল পড়িয়ে দেন। সেই যে ১২ বছর আগে শিকলবন্দি হয়েছিলেন সোহেল; আজও তাই আছেন।
মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলের চিন্তা আর ঋণের চাপে দুই বছর আগে মারা যান সোহেলের বাবা আবু বক্কর সিদ্দিক।
স্বামীকে হারিয়ে এবার বিপাকে পড়ে যান সোহেলের মা জাহানারা বেগম। বড় ভাই রুবেলও সংসারের হাল ধরতে এক বছর আগে পাড়ি জমান বিদেশে। বিদেশ গেলেও এখনও সংসারের ঋণের বোঝা কমাতে পারেননি তিনি।
এদিকে মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই বয়সের ভারে নুয়ে পড়া জাহানারা বেগমের। শেষ বয়সে তার চাওয়া একটাই ছেলের সুস্থ জীবন।
শুধু মা জাহানার বেগমেই নন; প্রতিবেশীরাও চান সোহেল যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন।
সোহেলের প্রতিবেশী বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘শিকলবন্দি না থাকলে সোহেল মানুষের ক্ষতি করে। বাড়ি থেকে চলে যায়। মানুষকে মারধর করে। তাকে ধরে রাখা যায় না। সোহেলের পরিবার তার অনেক চিকিৎসা করেছে। এখন টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না।’
সোহেলের ভাবী মর্জিনা বেগম বলেন, ‘সোহেলকে নিয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকি। কখন কী করে। প্রায় ১২ বছর ধরে তাকে শিকলবন্দি করে রাখতে হয়েছে। এ অবস্থায় তার প্রাকৃতিক কাজকর্ম করতে সমস্যা হয়। তাকে নিয়ে চিন্তায় আছি।’
সোহেলের মা জাহানারা বেগম বলেন, ‘আমার বয়স হয়েছ। কখন যে কী হয়। ছেলেটাকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। ওকে খাওয়া-দাওয়া করানোই আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে পড়েছে।’ তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মরার আগে যদি ছেলেটাকে সুস্থ দেখে যেতে পারতাম; তাহলে মরে গিয়েও শান্তি পেতাম। আমারতো সামর্থ নেই। কেউ যদি আমার ছেলেটাকে সুস্থ করে দিতো।’
জেবি
মন্তব্য করুন