• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

‘মোরা ভাত চাই না ত্রাণ চাই না, চাই একটা টেকসই বেড়িবাঁধ’

  ৩০ নভেম্বর ২০২০, ২২:৪৪
‘মোরা ভাত চাই না ত্রাণ চাই না চাই একটা টেকসই বেড়িবাঁধ’

‘মোগো গ্রামে কোনও বাঁধ নাই ডিগ্রি ও দারছিড়া নদী হগোল (সব) বাঁধ গিল্লা খাইয়া হালাইছে। এহোন ভাঙা বাঁধ দিয়া জোবার (জোয়ার) পানি ঢুইক্যা মোগো গ্রামের ঘর-দুয়ার জায়গা-জমি মাঠ-ঘাট হগোল পানিতে তলাইয়া যায়। মোরা ভাত চাই না ত্রাণ চাই না, চাই একটা টেকসই বেড়িবাঁধ’। এ কথাগুলো বলছিলেন পটুয়াখালী জেলার উপকূলীয় উপজেলা রাঙ্গাবালীর বেড়িবাঁধ বিহীন চালিতাবুনিয়া এলাকার ভুক্তভোগীরা।

একই অবস্থা বিরাজ করছে জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া, মুন্সীপাড়া, হাসনাপাড়া, ছোট পাঁচ নম্বর, বড় পাঁচ নম্বর, মঞ্জপাড়া, চান্দুপাড়া, কালাউপাড়া, এগারো নম্বর, ধনজুপাড়া, বানাতিপাড়া, চাড়িপাড়া ও মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর, সুধীরপুর, কমরপুর ও নজীবপুর এলাকাগুলোতেও।
এ দু’টি ইউনিয়নের মধ্যে লালুয়া ইউনিয়নের প্রায় সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ইতোমধ্যে রামনাবাদ নদী গিলে ফেলেছে এবং মহিপুর এলাকার নিজামপুর থেকে কমরপুর পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। এসব এলাকার ভুক্তভোগীরাও একি দাবি ‘মোরা ভাত চাই না ত্রাণ চাইনা, চাই একটা টেকসই বেড়িবাঁধ’।

পানি উন্নয়ন বোর্ড পটুয়াখালী ও কলাপাড়া দপ্তর সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালী জেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ রয়েছে ১ হাজার ৩৩৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাউবোর পটুয়াখালী সার্কেলের অধীনে ৮২২ কিলোমিটার এবং কলাপাড়া সার্কেলের অধীনে রয়েছে রয়েছে ৫১৩ কিলোমিটার। এসব বেড়িবাঁধের মধ্যে পাউবোর কলাপাড়া সার্কেলের অধীনে জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়ায় প্রায় চার কিলোমিটার চর। আণ্ডায় চার কিলোমিটার কলাপাড়ার লালুয়ায় সাত কিলোমিটারসহ ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত রয়েছে। এছাড়া কলাপাড়ার মহিপুরের নিজামপুর, সুধীরপুর, কমরপুর ও নজীবপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।

অন্যদিকে পাউবোর পটুয়াখালী সার্কেলের অধীনে শুধুমাত্র গলাচিপা উপজেলার চর কাজলেই দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত রয়েছে। কয়েক দফা পরিবর্তন করার পর শেষ রক্ষা হচ্ছে না গলাচিপা পানপট্টির বেড়িবাঁধটি। খরস্রোতা আগুনমুখা ও বুড়াগৌরঙ্গ নদীর তাণ্ডবে পানপট্টি লঞ্চঘাট থেকে গ্রামর্দন ও বদনাতলী পর্যন্ত রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।

এছাড়া গলাচিপার ডাকুয়া, পকিয়া, কলাগাছিয়া, ইছাদি ও দক্ষিণ চর বিশ্বাস, মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুন্দা কালিকাপুর, গোলখালী, ভিকাখালী, রামপুরা, সদর উপজেলার ছোট বিঘাই ও বড় বিঘাই, দুমকি উপজেলার পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের রাজগঞ্জ ও চন্দখালী, আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের বাহেরচর, পশ্চিম আঙ্গারিয়া, দক্ষিণ ও উত্তর মুরাদিয়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, বিধ্বস্ত এসব বেড়িবাঁধের মধ্যে জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের সাত কিলোমিটার রয়েছে পায়রা সমুদ্র বন্দরের অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে। তাই বিধ্বস্ত ওই সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ মেরামত বা সংস্কার করবে। ওখানের বেড়িবাঁধ মেরামত বা সংস্কারের কোনও পরিকল্পনা নেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের।

তবে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের অধিগ্রহনকৃত ভূমিতে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করার অনুরোধ জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে গত দুই বছর আগে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু লালুয়ায় পায়রা সমুদ্র বন্দরের অধিগ্রহনকৃত ভূমি এলাকায় বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ এখন পর্যন্ত সংস্কার বা মেরামত করেনি পাউবো কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয়দের অভিযোগ সিডর, আইলা, রোহানু, বুলবুল, ফনি ও আম্ফানসহ দফায় দফায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে পটুয়াখালীর উপকূলের পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত প্রায় ১৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত রয়েছে এবং চরম ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলের ২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।

দীর্ঘদিনেও এসব বেড়িবাঁধ মেরামত বা সংস্কার না হওয়ায় অরক্ষিত রয়েছে উপকূলীয় পটুয়াখালী জেলার ১৬ লাখ মানুষ। অভিযোগ রয়েছে কোথাও কোথাও বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত বা সংস্কার হলেও কাজের মান ছিল নিম্নমানের। যার ফলে সংস্কারের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওই সংস্কারকৃত বেড়িবাঁধ জোয়ারের পানির তোড়ে ফের বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এতে চলতি বছরে কয়েক দফা জোয়ারের পানি বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে লোকালয়ের মধ্যে প্রবেশ করায় মানুষের ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি তলিয়ে যায়। আবার কখনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এইসব অরক্ষিত এলাকার মানুষের জানমাল ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এনিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত পটুয়াখালীর উপকূল জনপদের মানুষজন।

এ ব্যাপারে জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, বেড়িবাঁধ না থাকায় দফায় দফায় ঝড়-বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে এ ইউনিয়নের মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে লোনা পানি ঢুকে পড়ায় ফসলের অর্ধেকও ঘরে তুলতে পারছে না কৃষকরা। তাই উপকূলের বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার করে মজবুত ও টেকসই করা জরুরি। তা না হলে কৃষি নির্ভর এ অঞ্চলের মানুষজন এক সময় তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হবে।

কলাপাড়া উপজেলার লালুয়ার ইউপি চেয়ারম্যান মো. শওকত হোসেন তপন বিশ্বাস বলেন, আমার ইউনিয়নের সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধই নেই। এক কথায় বলা যায় পুরো ইউনিয়নটিই এখন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এই বেড়িবাঁধ সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের জন্য কত বার যে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিয়েছি তা গুনে হিসাব দিতে পারবো না। তারপরও বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ করা হয়নি। এমনকি কবে সংস্কার করা হবে তাও ঠিক করে বলতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পটুয়াখালী ও কলাপাড়া সার্কেলের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ অলিউজ্জামান জানান, প্রথমত কলাপাড়ার লালুয়ার বেড়িবাঁধ এলাকাটির ভূমি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লালুয়ার বেড়িবাঁধের কাজটি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ করবে। ওখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ কাজ করার কোনও পরিকল্পনা নেই। তারপরও সরকার সেখানে কাজ করার জন্য পাউবোকে নির্দেশনা দিলে সে মোতাবেক কাজ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এছাড়া অন্যান্য এলাকার বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংস্কারের জন্য বরাদ্দ আসলে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করা হবে।

জিএম/এসএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বেড়িবাঁধ সংস্কারে বন উজাড়, ঝুঁকিতে সমুদ্র উপকূলের মানুষ
X
Fresh