• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
logo

সোশ্যাল মিডিয়া, বিকল্প মাধ্যম নাকি মূল ধারার গণমাধ্যমের সমান্তরাল?

  ২৪ অক্টোবর ২০২০, ২৩:০০
journalism,social media,
স্যোশাল মিডিয়া

গোটা বিশ্বেই এখন সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ-আন্দোলন সংগঠিত করতেও এটি একটি অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরুর দিকে সোশ্যাল মিডিয়া বিকল্প ধারা হিসেবে শুরু হয়েছিলে, এর কাঠামোও ছিল বিকল্প ধারার। সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিমত্তা ও প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা লক্ষ্য করার মতোই। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি বিকল্প মাধ্যম হিসেবেই বিকশিত হচ্ছে নাকি গণমাধ্যমের সমান্তরালে দৌঁড়াচ্ছে? আরটিভি নিউজের সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বিষয়ে আরটিভি নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মফিজুর রহমান।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক গোটা বিশ্বেই পরিচিত। সাইবার জগতে এই মাধ্যমটি যেমন ভালো কাজের জন্য ব্যবহার হচ্ছে, তেমনই এটি অপরাধীদের অপরাধ সংগঠনের সূত্রপাতস্থলও বটে। এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে যেমন অপরাধীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে চলছে, তেমনি একই মাধ্যম ব্যবহার করে অপরাধ দমনে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধেরও অসংখ্য ঘটনা রয়েছে।

এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কখনো কখনো মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়েও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। যার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুরে গৃহবধূকে ধর্ষণ চেষ্টা ও নির্যাতনের ঘটনা। যা ঘটে যাওয়ার এক মাসের মাথায় ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এটিকে কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয়, প্রতিবাদে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। তখনই বিষয়টি দেশের সকল গণমাধ্যমসহ প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্তাদের নজরে আসে। এরপরই প্রবল প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ধর্ষণের আইনে সংশোধনী আনে সরকার। নোয়াখালীর মতো দেশে ঘটে যাওয়া এমন অনেক ঘটনাই রয়েছে যা গণমাধ্যমের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনগণের সামনে তুলে ধরেছে।

বর্তমানে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ এখন গণমাধ্যমের চেয়েও সোশ্যাল মিডিয়ার উপর বেশি আস্থা রাখতে শুরু করেছে। এই সুযোগে অসাধুচক্র সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে তড়িৎ গতিতে বেড়ে চলছে সাইবার অপরাধের মাত্রা। আবারও প্রশ্ন উঠছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সোশ্যাল মিডিয়া বেশি শক্তিশালী? নাকি মূল ধারার গণমাধ্যম বেশি শক্তিশালী?

এ বিষয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম আরটিভি নিউজকে বলেন, পাঠক বা দর্শকের বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গাটা কতোটা তৈরি করে তার উপর নির্ভর করে গণমাধ্যমের মূল্যায়ন। আমরা জানি যে, গণমানুষের আকাঙ্ক্ষায় গণমাধ্যম যতোটা পেশাদারিত্ব বজায় রাখবে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা ততোটাই শানিত হবে। সোশ্যাল মিডিয়া খুব সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে, এই কথা ঠিক। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যমের উপর মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থা যে পরিমাণ, সোশ্যাল মিডিয়া কি সেই জায়গাটা দখল করতে পেরেছে?

এমন প্রশ্নে আমি মনে করি, এখনো সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গাটা গণমাধ্যমের মতোই অর্জন করতে পারেনি। এখানে পাঠকের প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ার দায়বদ্ধতা ততোটা নেই, যতোটা মূল ধারার গণমাধ্যমের রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার জবাদিহিতার জায়গাটা ততোটা কঠোর এবং কঠিন নয়, যতোটা মূল ধারার গণমাধ্যমের রয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমের ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি বলেন, আমি মনে করি এটি চ্যালেঞ্জের নয়। জনগণের বিশ্বাসের জায়গাটা যারা ধরে রাখতে পারবে এবং আস্থা অর্জন করতে পারবে তারাই ভবিষ্যতে টিকে থাকবে। সেই ক্ষেত্রে কোনো তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক দ্রুত ছড়িয়ে যায় বা খবর দেয়। তবে সেখানে জবাদিহিতার জায়গাটা কম।

আমরা দেখি যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক খবর আসে, যেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। এমন দু’চারটি খবরের মধ্যে দিয়ে কিন্তু পুরো সোশ্যাল মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিমজ্জিত হয়ে যায়। অন্যদিকে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা রয়েছে। যদিও কিছু কিছু গণমাধ্যমে ফেইক (ভুয়া) নিউজ আসতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে যে গণমাধ্যম যতো বেশি বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সরবরাহ করবে, তাদের ভবিষ্যত ততো উজ্জ্বল। কিন্তু এর উল্টো যারা করে, তারা ক্রমেই পাঠকপ্রিয়তা বা দর্শকপ্রিয়তা হারাতে থাকবে।

ঘটনার তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা প্রসঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম আরও বলেন, আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে যে, গণমাধম্যের কর্মী বা সংবাদকর্মী একেবারেই দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় নেই। আমার জানামতে, কোনো গণমাধ্যমেরই গ্রাম পর্যায়ে সংবাদ প্রতিনিধি নেই। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য সরবরাহের জন্য সাধারণ মানুষের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন রয়েছে। যেখানে কেউ একটি তথ্য দিলে মুহূর্তেই তা শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে দেখলে মনে হবে সোশ্যাল মিডিয়া এগিয়ে রয়েছে। তবে বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরশীলতার বিষয়ে গণমাধ্যমের জুড়ি নেই।

এমন পরিস্থিতিতে আমি মনে করি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো দ্রুত তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে অনলাইন নিউজ সাইট ব্যবহারের পাশাপাশি সিটিজেন সাংবাদিকতার প্রসার ঘটাতে হবে। তাহলেই মানুষ মিসগাইড হওয়া থেকে রক্ষা পাবে এবং অসাধু লোকজন কর্তৃক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার পাত্তা পাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মফিজুর রহমান আরটিভি নিউজকে বলেন, মূল ধারার গণমাধ্যমে যারা সাংবাদিকতা করেন, তারা তো অবশ্যই পেশাদার সাংবাদিক। অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়া বা ফেসবুকে যেসব তথ্য আসে সেগুলো পেশাগত মানদণ্ডে কতোটা বাস্তব সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়া কিছু কিছু তথ্যের সত্যতা থাকতে পারে। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক সময় ফেইক (ভুয়া) তথ্যের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। এসব তথ্য নির্ভরশীলতার চ্যালেঞ্জে গণমাধ্যমের উপর অতিমাত্রায় মানুষের আস্থা তৈরি করে। সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্যে মানুষ বিভিন্নভাবে মিসগাইডেড হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সোশ্যাল মিডিয়া বিভিন্ন ধরনের ভুলতথ্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়।

আগামীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে গণমাধ্যমের সময়টা চ্যালেঞ্জের বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই শিক্ষক। তিনি বলেন, বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরশীল তথ্যের জন্য গণমাধ্যমের উপর মানুষের আস্থা অব্যহত থাকবেই। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে গণমাধ্যমের অপারচ্যুনিটি রয়েছে, সেই অপারচ্যুনিটিগুলো যদি ঠিকঠাক ব্যবহার করা যায়, তাহলে এই দুইয়ের (সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যম) সমন্বয়ে মানুষ কাছে তথ্য প্রবাহ আরো সহজেই সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা দেখতে পাই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য মানুষকে বেশি প্রভাবিত করছে। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তিকে কীভাবে মেইন স্ট্রিমের সংবাদ মাধ্যমগুলো কাজে লাগাতে পারে সেই বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো তাদের ইন্টারনেটে অনলাইন সাইট পরিচালনা করছে এবং সেইসব নিউজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে সঠিক তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে নির্যাতন ও ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটে যাওয়ার এক মাসের মাথায় ভাইরালের প্রসঙ্গ টেনে সোশ্যাল মিডিও ও গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হলে অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, প্রফেশনাল মিডিয়াগুলোতো আর সোশ্যাল মিডিয়ার মতো যাচ্ছে তাই প্রকাশ করতে পারে না। সোশ্যাল মিডিয়া বলতে বুঝায় সিটিজেন জার্নালিজম। অন্যদিকে গণমাধ্যম বলতে বোঝায় পেশাদার সাংবাদিকদের সংবাদ পরিবেশনা। এই দুটির মধ্যে অবশ্যই অনেক পার্থক্য রয়েছে। প্রান্তিক জায়গা থেকে তো আর সবসময় পেশাদার সাংবাদিকরা সহজেই তথ্য পায় না। অন্যদিকে ঘরে ঘরে স্মার্ট ফোনের ব্যবহার থাকায় সিটিজেন জার্নালিজম লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সে বিষয়ে মূল ধারার গণমাধ্যম সত্যতা যাচাই বাছাই শেষে প্রকৃত তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে।

কেএফ/এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
ঢাবি অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তে কমিটি
গোছানো শহরকে আরও স্মার্টভাবে গড়ে তুলতে চান ফেরদৌস
X
Fresh