• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

মার্কিন নির্বাচনের যত হিসাব-নিকাশ, আবারও কী জয়ী হচ্ছেন ট্রাম্প?

  ১৭ অক্টোবর ২০২০, ১২:৪৭
china, Russia, Iran, Trump, America, Election,
ট্রাম্প ও বাইডেন

দরজায় কড়া নাড়ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তার দিকে তাকিয়ে পুরোবিশ্ব। মহামারির মাঝেই এবারের মার্কিন নির্বাচনটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সংক্রমণের কারণে স্বাভাবিক নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে পারেনি রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যেটিক কোনও রাজনৈতিক দলই। আর অক্টোবরের শুরুতে প্রচারণার মাঝে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাক্রান্ত হয়ে ভোটের হিসেব নিকেশে ভিড়মি খাইয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

ট্রাম্প মানেই ব্যতিক্রম কিছু, ট্রাম্প মানেই বিতর্ক। গত চার বছর ধরে সেটাই বার বার প্রমাণ করেছেন তিনি। ক্ষমতায় আসার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সবকিছুই ওলটপালট করে দিয়েছেন ট্রাম্প। পরিবর্তন করেছেন তার পূর্বসূরির নেয়া অনেক সিদ্ধান্ত। ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির করা পরমাণু চুক্তি থেকে নাম প্রত্যাহার, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা, কোনও কিছুই বাদ রাখেননি ট্রাম্প। পুরো মেয়াদ ধরেই ইসরায়েলকে খুশি করার ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল।

মার্কিন নির্বাচনে ফ্যাক্টর ইহুদিরা

যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যায় কম হলেও ভোটের মাঠে অন্যতম ফ্যাক্টর ইহুদিরা। অর্থবিত্ত, জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেকটাই এগিয়ে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশের মালিক ইহুদিরা। তারই অংশ হিসেবে পুরো মেয়াদ জুড়েই ইহুদি অধ্যুষিত দেশটির পাশে থেকেছেন ট্রাম্প। সবশেষ দুটি আরব দেশকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকও করিয়েছেন তিনি। আদায় করেছেন স্বীকৃতি।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইহুদিরা কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের রাষ্ট্র ইসরায়েলের অলিখিত তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে রেখেছে। শুরু থেকে এই পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতি বছর দেশটির সেনাবাহিনীর সিংহভাগ খরচ প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই স্বাভাবিকভাবে ইহুদিদের খুশি রাখতে চাইবেন ট্রাম্প, এতে কোনও সন্দেহ নেই।

ট্রাম্প ইহুদিদের ভোট পেতে মরিয়া হয়ে উঠলেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন কাছে টানতে চাইছেন মুসলিম ভোটারদের। তিনি যে ট্রাম্পের মতো মুসলিম বিদ্বেষী আচরণ করবেন না, সেটাই বারবার স্পষ্ট করেছেন বাইডেন। এমনকি গত জুলাইয়ে বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী হলে তিনি দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিনই ট্রাম্পের মুসলমান নিষিদ্ধ করার সব নির্দেশ বাতিল করবেন।

মুসলিম ভোটের প্রতি বাইডেনের ঝুঁকে পড়া

হোয়াইট হাউজ এবং ফেডারেল প্রশাসনে মুসলিম-বিদ্বেষমূলক কোনও কিছুর চিহ্নও থাকবে না বলে ঘোষণা দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার মুসলিম রয়েছে। এটা মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ হলেও বেশ কিছু রাজ্যে ভোটার ফল বদলে দেয়ার মতো ভূমিকা রাখতে পারে তারা। বিশেষ করে মিশিগান, ফ্লোরিডা, উইসকিনসন এবং পেনসিলভানিয়ায় মুসলিম ভোট বড় একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন, মিশিগানে ২ লাখ ৭০ হাজার মুসলিম ভোটার রয়েছে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই রাজ্যে মাত্র ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে ট্রাম্পের কাছে হেরে যান তৎকালীন ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন।

তবে মার্কিন ভোটের হিসাবই শুধু নয়, বিশ্বে প্রায় ১৮০ কোটি মুসলিম রয়েছে। তাই এত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে এড়িয়ে যাওয়াই কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আর বাইডেন সেটা খুব ভালো করেই জানেন। তাই গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে এক পর্যায়ে ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ওই বিতর্কের হোস্ট ট্রাম্পের কাছে জানতে চান যে, তিনি কবে রিটার্ন দাখিল করবেন। জবাবে ট্রাম্প বলেন, আপনারা এটা দেখতে পাবেন। তখন ট্রাম্পের মন্তব্য কটাক্ষ করতে গিয়ে বাইডেন ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দের প্রয়োগ করেন।

এছাড়া বাইডেন যে এমনি এমনিই ইনশাআল্লাহ বলেননি সেটা তিনি আবারও প্রমাণ করেছেন দুই-তিনদিন আগে। নির্বাচনী এক সমাবেশে অংশ নিয়ে বাইডেন বলেছেন, তিনি বিজয়ী হলে তার প্রশাসনের ‘সব পর্যায়েই’ স্থান পাবে মুসলিমরা।

২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এবারও সেই জুজুর ভয় দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে সতর্কও করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি সেন্টারের (এনসিএসসি)। এনসিএসসি’র পরিচালক উইলিয়াম ইভানিনা হুঁশিয়ার করে বলেছেন, নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে বিদেশি কয়েকটি রাষ্ট্র তৎপরতা শুরু করেছে।

জটিল সমীকরণে চীন রাশিয়া ও ইরান

মার্কিন কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স বিভাগের প্রধান বিশেষ করে তিনটি দেশের নাম করেছেন- চীন, রাশিয়া এবং ইরান। দেশগুলো ‘গোপনে এবং প্রকাশ্যে’ আমেরিকান ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলে উল্লেখ করেন ইভানিনা। শুধু তাই নয়, মার্কিন এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, চীন চাইছে না ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার জিতে হোয়াইট হাউজে থেকে যান, অন্যদিকে রাশিয়া ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের ক্ষতি করতে চাইছে।

২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে কাজ করেছে বলে মনে করে মার্কিন গোয়েন্দারা। ইভানিনা বলছেন, এবারও মস্কো চায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন ক্ষমতায় থেকে যান। অবশ্য রাশিয়া সবসময় বলে এসেছে তারা মার্কিন নির্বাচনে বা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কখনই মাথা ঘামায়নি।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট জানিয়েছে, রাশিয়া, চীন এবং ইরানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হ্যাকাররা ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রচারণার নথি হাতিয়ে নেয়া রুশ হ্যাকাররা এবারও তৎপর রয়েছে। এমনকি ট্রাম্প ও বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারণার ওপর হ্যাকাররা নজরদারি করছে বলেও দাবি করেছে মাইক্রোসফট।

গত বছরের শেষদিকে চীনের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। পরবর্তী কয়েক মাসে চীনের বাইরে বিভিন্ন ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। ১০ মাস হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত এই ভাইরাস নিয়ে কোনও কূলকিনারা করতে পারেনি বিশ্ব। কিন্তু শুরুতে এই ভাইরাস নিয়ে চীনের সঙ্গে রেষারেষিতে জড়ান ট্রাম্প।

শুধু কি তাই, এই করোনা সাধারণ ফ্লু ছাড়া কিছু নয় বলে ভাইরাসটিকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করেন ট্রাম্প। এছাড়া এটিকে চীনা ভাইরাস বলেও বেইজিংয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান ট্রাম্প। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএইচও’র বিরুদ্ধে চীনের প্রতি পক্ষপাতেরও অভিযোগ তোলেন। এর জেরে সংস্থাটি থেকে বেরিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র।

চীন থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও একক দেশ হিসেবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু সেই দেশটির প্রেসিডেন্টই এই ভাইরাস নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। এই পুরো সময়টাতে তাকে দুই-একবার ছাড়া মাস্ক পরে থাকতে দেখা যায়নি। তীব্র রোদে মরে যায় করোনা কিংবা এই ভাইরাসের চিকিৎসায় মানুষজনকে জীবাণুনাশক ইনজেকশন ব্যবহারের মতো পরামর্শও দিয়েছেন ট্রাম্প।

ডব্লিউএইচও থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এবং অন্যান্য সংস্থা যা করোনা নিয়ে যে পরামর্শ দিয়েছেন, ট্রাম্প ঠিক তার উল্টো পথেই হেঁটেছেন। এমনকি দেশটির শীর্ষ মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যান্থনি ফাউচ ও সিডিসি’র পরিচালক রবার্ট রেডফিল্ডের সঙ্গে স্বাস্থ্যগত প্রায় সব বিষয়েই দ্বিমত পোষণ করেছেন ট্রাম্প।

তবে এতকিছুর পরও অক্টোবরের শুরুতে স্ত্রী ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্পসহ করোনায় আক্রান্ত হন ট্রাম্প। ওইদিনই তাকে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়। কিন্তু মাত্র তিনদিন হাসপাতালে কাটিয়ে হোয়াইট হাউজে ফিরে আসেন ট্রাম্প। হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিতর্কের জন্ম দেন তিনি। আবার হোয়াইট হাউজে ফিরে মাস্ক ছুড়ে ফেলে দেন ট্রাম্প।

এরই মধ্যে নির্বাচনও ঘনিয়ে আসছে। তাই করোনা হওয়ার পর দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যেই প্রচার শুরু করেছেন ট্রাম্প। ফ্লোরিডায় সেই নির্বাচনী সভায় সমর্থকদের মধ্যে মাস্ক ছুঁড়ে মারেন ট্রাম্প। তিনি খুব শক্তিশালী বোধ করছেন সেটা বলতেও ভুলেননি। সব মিলিয়ে আগামী ৩ নভেম্বর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে বিগত চার বছরের আমলনামা পাবেন ট্রাম্প। এখন দেখার বিষয় সেই পরীক্ষা তিনি উতরে যেতে পারেন কিনা?

এ/ এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
রমজানের আলো নেই জেরুজালেমের রাস্তায়
X
Fresh