• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

সর্ষের ভূত তাড়াতে কক্সবাজারের এসপি থেকে কনস্টেবল সবাই বদলি

কাজী ফয়সাল

  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:৩৬
police, coxbazar
কক্সবাজার পুলিশ সুপারের কার্যালয়

সর্ষের ভূত তাড়াতেই যেনো কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সব সদস্য, মোট ১৪৮৭ জনকেই বদলি করে দেওয়া হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি জেলায় একযোগে এর আগে কখনো এতো বেশি সংখ্যক পুলিশ সদস্য বদলির ঘটনা ঘটেনি। যেটি ঘটলো কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভ সড়কের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ নিহত হবার পর। যে ঘটনায় গোটাদেশেই তোলপাড় শুরু হয়।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে আজ ২৫ সেপ্টেম্বর, মোট ৯ দিনেই কক্সবাজারের এসপি থেকে কনস্টেবল প্রত্যেককেই বদলি করা হয়েছে। বদলির ঘটনা শুরু হয় কক্সবাজারের এসপি এ বি এম মাসুদ হোসেনেকে দিয়ে। পরে ধাপে ধাপে ৭ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও এএসপি এবং সর্বশেষ জেলার ৮ টি থানায় কর্মরত ইন্সপেক্টর, এসআই, এএসআই, কনস্টেবল নিয়ে ১৪৭৯ জনকে বদলি করা হয়।

পুলিশের এসব বদলির প্রজ্ঞাপনে দেশের বিভিন্নস্থানে তাদের সবাইকেই নতুন কর্মস্থলে বদলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বদলিকৃতদের আগামী ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কক্সবাজারের কর্মস্থল ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে। এরপরেই আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর তাদেরকে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স অডিটরিয়ামে একটি বিশেষ ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর।

এই বৃহৎ সংখ্যক বদলির বিষয়ে আরটিভি নিউজের কথা হয় সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শ (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসর) এম সাখাওয়াত হোসেন এবং চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শ (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, পুলিশে চাকরিকালীন সময়ে আমি কখনো এমন গণহারে বদলির ঘটনা দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম কক্সবাজারে এমন ঘটনা ঘটলো। আমি আইজিপি থাকাকালীন সময়ে একটি জেলায় এতো সংখ্যক সদস্যকে বদলি করিনি।

মেজর সিনহা হত্যার রেশে পুলিশে এমন গণহারের বদলির ফলে পুলিশ তাদের ইমেজ ফেরাতে পারবে কিনা? এমন প্রশ্নে সাবেক এই আইজিপি বলেন, এই বদলি কি নির্দিষ্টভাবে মেজর সিনহা হত্যার কারণে হয়েছে, নাকি গোয়েন্দা রিপোর্টের প্রেক্ষিতে হয়েছে- সেটি দেখার বিষয়। যেহেতু ঘটনাটি ঘটেছে টেকনাফে, সেজন্য পুরো কক্সবাজার জেলার পুলিশকে বদলি করা হলো- এর কোনো যুক্তি আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আমি মনে করি, বদলির মাধ্যমে ইমেজ ফেরানো সম্ভব না, বরং কাজের মাধ্যমেই ইমেজ ফেরাতে হবে। এটি করতে হলে ওইখানে নিবিড়ভাবে ইন্সপেকশন, সুপারভিশন এগুলো বাড়াতে হবে। আমি মনে করি, যাদের সার্ভিস খারাপ তাদেরকে মাঠপর্যায়ে বদলি না করাই ভালো। এছাড়াও যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে জিরো টলারেন্স নীতির ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও ইমেজ রক্ষা ও বৃদ্ধি করতে জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্বপালন করতে পুলিশ সদস্যদের মোটিভেশন করতে হবে। কেবলমাত্র বদলির মাধ্যমে ইমেজ ফেরানো সম্ভব নয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসর) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বদলির মাধ্যমে ইমেজ ফেরানোর চেষ্টাটা অনেকটাই সঠিক। পুলিশের উধ্বোতন কর্মকর্তারা এখন রিয়েলাইজ করেছেনে যে, পুলিশের সথে সাধারণ মানুষের ডিসটেন্সটা কতোখানি বেড়ে গিয়েছে। বিভিন্ন সমালোচনমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এখন মানুষ পুলিশকে বিশ্বাস করতে পারছেন। কক্সবাজারে ওসি প্রদীপ ও তারমতো আরো কয়েকজনের ঘটনা- এটা পুলিশের ভাবমূর্তির উপর বড় ধরনের একটা ধাক্কা দিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই একটা ঘটনার কারণে সারাদেশের পুলিশ আজ প্রশ্নের মধ্যে পড়েছে। কক্সবাজার থেকে পুলিশের সবাইকে বদলির বিষয়টি। ওখানে তাদের ইমেজ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া মাত্র। এখন পুলিশের উর্ধ্বোতন কর্মকর্তারা রিয়েলাইজ করেছে- যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ পুলিশকে মোটেই বিশ্বাস করতে পারছে না। হয়রানি হচ্ছে মানুষজন। পুলিশকে যতোক্ষণ না পর্যন্ত পলেটিক্যাল গণ্ডি থেকে বের করে আনা যাচ্ছে, ততোক্ষণ পর্যন্ত পুলিশের পক্ষে কাজ করা ডিফিক্যাল্ট হয়ে যাবে। পলেটিক্যাল ছত্রছায়াতেই পুলিশ নিচের লেভেলের সদস্যরা দানবের মতো হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন বলেন, বদলির বিষয়টি একভাবে চিন্তা করলে রুটিন মাফিক হয়েছে। আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে বলতে হবে- টেকনাফের ঘটনাটি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, পারিপার্শিক অনেক বিষয়ও আছে। বদলিকৃত কেউ কেউ অনেকদিন এখানে কর্মরত ছিলেন। আবার যারা অনেকদিন ছিলেন না, তাদেরকেও বদলি করা হয়েছে। মেজর সিনহার ঘটনাটি খারাপভাবেই এসেছে। এসব সামগ্রিক বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে, আমাদের প্রয়োজন ছিলো কক্সবাজারের পুলিশে পরিবর্তন করা। যে কারণেই এই বদলি কার্যক্রম চালানো হয়। যেমন মনে করেন- কক্সবাজারে পুলিশ সুপার পরিবর্তন করা হলো, তাহলে সেখানে নতুন একজন পুলিশ সুপার এসে কি পুরো সিস্টেমটাকে পরিবর্তন করতে পারবেন? আমি মনে করি- আসলে তিনি তা পারবেন না। কারণ, আমরা যখন সার্বিক পরিবর্তন চাই, তখন শুধুমাত্র ইউনিট ইনচার্জকে পরিবর্তন করলেই সেটা সম্ভব হবে না। বাকিতো সব একই থেকে গেলো! তাই এই বিষয়গুলো বিবেচনা করেছি আমরা। আরো বিভিন্ন সাইট থেকে তাদের পূর্বের ইতিহাস, কারা কারা এখানে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছে এবং তাদের সম্পর্কে জনগণের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো। এসবকিছু মিলে আমাদের মনে হয়েছে কক্সবাজারের টোটাল সেটআপটাকে পরিবর্তন করতে হবে। তাই বদলির মাধ্যমে আমরা পরিবর্তন এনেছি। আমরা মনে করেছি- এই কক্সবাজারে যদি পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে টোটাল পরিবর্তন আনতে হবে। পুলিশের টোটাল সেটআপ পরিবর্তন আনতে হবে। উপর থেকে দুইজন একজন পরিবর্তন করে যদি নিচের এদের যদি ঠিক রাখা হয় তাহলে হবে না। যেমন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করলে সাব-ইন্সপেক্টররা যদি থেকে যায়, তাহলে কোনো একজন নতুন ওসি এসে, তার পক্ষে এটা পরিবর্তন করা সম্ভব না। এসমস্ত বিষয় চিন্তা করে আমরা টোটাল চেইঞ্জ করেছি।

তথ্য পাওয়া গেছে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর নানা আলোচনা ও সমালোচনার পর বদলি করা হয় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে। মাসুদ হোসেনকে রাজশাহী জেলার এসপি হিসেবে বদলি করা হয়।

এরপর গত ২১ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজার জেলার ৭ শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি করা হয়েছে। বদলিকৃত কর্মকর্তাদের মাঝে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.আদিবুল ইসলাম মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কক্সবাজার সদরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজওয়ান আহমেদ গাজীপুর জিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, মহেশখালী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার রতন কুমার দাশ গুপ্ত চট্টগ্রাম ৯ম এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার, ট্রাফিক পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার বাবুল চন্দ্র বণিক চট্টগ্রাম আরআরএফের সহকারী পুলিশ সুপার, চকরিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার কাজী মো. মতিউল ইসলাম নোয়াখালীর সহকারী পুলিশ সুপার ও ডিএসবির সহকারী পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলামকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসবে বদলি করা হয়েছে।

২৩ সেপ্টেম্বর ও ২৫ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজার জেলা থেকে ইন্সপেক্ট, এসআই, এসআই ও কনস্টেবল মোট ১৪৭৯ জনকে বদলি করা হয়। আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় সর্বশেষ বদলির প্রজ্ঞাপন জারি হয়। তাতে কেবল আজকেই ১৩৪০ জনকে বদলির আদেশ পাওয়া যায়।

উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই রাত ৯ টায় কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে।

কেএফ/ এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
পুলিশে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, আটক ১
টাঙ্গাইলে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৯০ জন
এসএসসি পাসে পুলিশে চাকরি, আবেদন যেভাবে
X
Fresh