• ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
logo
বুয়েট শিক্ষার্থী দীপের হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা!
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্র রাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তির সুযোগ নিয়ে আবারও বিভিন্ন গ্রুপে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বুয়েটে নিষিদ্ধ হওয়া ছাত্র শিবিরের সাবেক নেতা-কর্মীরা। সম্প্রতি ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে বিভিন্ন পোস্ট দেওয়ার পাশাপাশি বুয়েটে মৌলবাদী শক্তির হামলায় নিহত আরিফ রায়হান দ্বীপকে কেন্দ্র করে গুজব ও ঘৃণামূলক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে তার হত্যার ন্যায্যতা প্রমাণ করে বেশ কিছু পোস্ট করা হয়েছে ‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’ নামের ফেসবুক গ্রুপে। ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলে দীপের মাথায় ও পিঠে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ওই বছরের ২ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। আর এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন মেজবাহ নামের উগ্রবাদী বুয়েটের এক শিক্ষার্থী। যিনি হেফাজতে ইসলামের সমর্থক ছিলেন বলে জানা গেছে।    দীপের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতির সক্রিয় কর্মী ছিলেন দীপ। তাকে হত্যার আগে বিভিন্নভাবে তার নামে ও প্রগতিশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুৎসা রটানো হয়। আর এরপরই তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একইরকম ঘটনা ঘটেছিল বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী ও তৎকালীন ছাত্রলীগের তন্ময় আহমেদের সঙ্গেও। ২০১৩ সালে তিনিও শিবিরের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তন্ময় আহমেদ জানান, হামলার আগে তার বিরুদ্ধেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন গুজব ও উসকানিমূলক লেখালেখি শুরু হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বিরোধী তৎপরতা শুরু হলে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে বুয়েটে গোপনে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করা ছাত্র শিবির, হিযবুতসহ মৌলবাদী গোষ্ঠী। তারা অবস্থান নেয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে। তবে বিচারবিভাগের আদেশের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ছাত্র রাজনীতির পক্ষে বুয়েটের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা সরব হলে মৌলবাদী গোষ্ঠীর নিশানায় উঠে আসে তারা। এর মধ্যে আরিফ রায়হান দ্বীপকে হত্যা নিয়ে সকল পক্ষের শিক্ষার্থীরা যখন সরব এবং এ ধরণের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সকল শিক্ষার্থীরা যখন আন্দোলনে একাতাবদ্ধ হয়ে মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তখনই মৌলবাদী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময় আবারও দ্বীপকে নিয়ে নানা ঘৃণামূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফেসবুক পোস্ট করতে থাকে তারা। (এই লিংকে একাধিক পোস্ট রয়েছে: https://drive.google.com/drive/folders/159x4fHVZHSlniOU5zUjdb3klUJJM_T-h?usp=sharing ) বুয়েটের আড়িপেতে শোনা গ্রুপের একটি পোস্টে দেখা যায়, আরিফ রায়হান দ্বীপকে নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত করে, তার মৃত্যুতে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা রক্ষা পেয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়। এই পোস্টটি ছিল অ্যানোনিমাস। ঠিক তেমনি অ্যাননিমাস অপর এক পোস্টে বলা হয়, হেফাজতের জন্য খাবার তৈরি করা ইমামকে বহিষ্কারের পেছনে দ্বীপের যেই ভূমিকা ছিল, তার জন্য তাকে যে হত্যা করা হয়েছে সেটা হওয়ারই ছিল। শাহবাগ আন্দোলনকালে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল ছাত্রদের যেই জোট কাজ করেছে, সেখানে বুয়েট থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল আরিফ রায়হান দ্বীপের। তাকে হত্যার এমন ন্যায্যতা প্রদান বিষয়ক পোস্ট বুয়েটিয়ানদের গ্রুপে কিভাবে অনুমতি পায় তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এই প্রগতিশীল জোটের সাবেক ছাত্রনেতারা। বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ফ্রন্টের তৎকালীন সভাপতি ইমরান হাবিব রুমন বলেন, কোনো হত্যাকেই জাস্টিফাই করার কখনই সুযোগ নেই। বুয়েটে দ্বীপকে যেভাবে হত্যা করা হলো, সেটি আলোচনায়ও এলো না খুবভাবে। এটা আরও বেশি আলোচনা হওয়া দরকার ছিল। ওই সময় সারাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি যেভাবে আক্রমণ করছিল, তার মধ্যে মৌলভীবাজারেও ছাত্রফ্রন্টের নেতার ওপর হামলা হয়েছিল। আরও অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছিল। একটা প্যানিক তৈরি করা হচ্ছিল, যাতে মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমন করা যায়, ভয় দেখানো যায়, শাহবাগ কেন্দ্রিক মানুষের যে ঢল, তরুণ, যুবকদের ঢল তারা যাতে ভয় পায় সে চেষ্টা চলছিল।  ‘যদি ধরেও নেই, হেফাজতের জন্য খিঁচুড়ি রান্নার ঘটনায় দ্বীপের প্রতিবাদের কারণে ইমামকে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে, সেটি অনৈতিক কিছু না। ২০০১ সালে ইকসু নির্বাচনের পরে ইকসুতে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্রফ্রন্ট ও ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব ছিল। প্রত্যেক ক্রিয়াশীল সংগঠন সেখানে ছিল। ইকসু ও প্রত্যেক ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন বসে আমরা লিখিত একটা রেজ্যুলিউশন নিয়ে এসেছিলাম, বুয়েটে কোনো মৌলবাদী সংগঠন কাজ যাতে না করতে পারে। ইকসু দ্বারা লিখিত একটা স্টেটমেন্ট ছিল বুয়েটে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আমরা এলাউ করব না। এরকম একটা জায়গায় যদি হেফাজতে ইসলাম, যারা একটা মৌলবাদী গোষ্ঠী তাদের জন্য বুয়েটকে ব্যবহার করে, তাদের জন্য কেউ যদি খিঁচুড়ি রান্না করতে চায় বা করেও সেটা কেন একজন সচেতন ছাত্র প্রতিবাদ করবে না। অবশ্যই করা উচিৎ। সে যদি এ কারণে প্রতিবাদ করে সেটির ন্যায্যতা দেওয়া উচিৎ। কারণ ওর প্রতিবাদ যৌক্তিক ছিল। এটাকে কেন্দ্র করে কেউ যদি তার হত্যাকে জাস্টিফাই করতে চায় তাহলে এর চেয়ে ন্যাক্কারজনক অবস্থান হতে পারে না। যারা এ কথা বলছে, তারা কোন চিন্তার মানুষ কিভাবে এটা ভাবে তা আমি জানি না। একটা হত্যাকে জাস্টিফাই করছে।’ ছাত্র মৈত্রীর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, দ্বীপের হত্যাকাণ্ডকে কোনোভাবেই জাস্টিফাই করা যায় না। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ যদি বলে ওই হত্যা প্রয়োজন ছিল বা ন্যায়সঙ্গত ছিল তাহলে তার মস্তিষ্ক বিকৃত। কোনো হত্যাকাণ্ডই কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ যদি ন্যায়সঙ্গত বলে সে সুস্থ মানুষ নয়। ওই সময় আমার বাসায়ও জঙ্গি হামলা হয়েছিল। তারা একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। করেছিলও। শাহবাগ আন্দোলনে ‘স্লোগান কন্যা’ হিসেবে পরিচিত পাওয়া বামপন্থি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি লাকী আক্তার বলেন, শাহবাগ আন্দোলনের সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দ্বীপ হত্যাকাণ্ড। এটা প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর একটি আঘাত। তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। মৌলবাদী সংগঠন কর্তৃক নৃশংস হত্যার ঘটনা দেখা গেছে অনেক জায়গায়। বুয়েটের ছাত্র রাজনীতির যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে, এটা তারই একটি চিত্র। এ জন্য আমরা বলেছি, মৌলবাদী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে শিবিরের রাজনীতিও আমরা নিষিদ্ধ চাই। এটা আমাদের পুরোনো দাবি। কোনো হত্যাকে জাস্টিফাই করার সুযোগই নেই। বরঞ্চ এ ঘটনা যখন ঘটেছে, এর মধ্য দিয়ে ওইখানকার মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের যে বক্তব্য ছিল, তাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা ছিল খুবই নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা। এটা মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। দ্বীপ হত্যাকাণ্ড বা তন্ময় আহমেদকে হত্যার উদ্দেশ্যে যে নৃশংস হামলা হয়, তার আগে যেভাবে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও উস্কানিমূলক ছড়িয়ে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে। ঠিক একইভাবে বর্তমানে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে থাকাদের নিয়ে ঘৃণামূলক ও উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বুয়েটের আড়িপেতে শোনা ও শিবিরের বাঁশের কেল্লা গ্রুপে। প্রকাশ করা হচ্ছে তাদের ব্যক্তিগত পরিচয়। এসব পেজে এভাবে পরিচয় প্রকাশের কারণে জীবননাশের শঙ্কায় আছেন ওই সব শিক্ষার্থী ও সাবেক বুয়েটিয়ানরা। বুয়েটের আড়িপেতে শোনা গ্রুপে দেখা যায়, আন্দোলনে সাড়া না দিয়ে এক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়ায় তার নাম ও ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। এদিকে শিবিরের বাঁশের কেল্লা গ্রুপে দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীর পরিচয়, ব্যক্তিগত ঠিকানা বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ওই সাংবাদিক শিবিরকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘ইফতারের আড়ালে সক্রিয় হচ্ছে শিবির’।
০৫ এপ্রিল ২০২৪, ২২:৩৪
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়