অধিক আগুনের ঝুঁকিতে ঢাকার ৭৬ শতাংশ মার্কেট-শপিংমল
ঢাকায় অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। প্রতিটি ঘটনার পরই বেরিয়ে আসছে গাফিলতি ও তদারকির অভাবের চিত্র। ঝুঁকি সম্পর্কে না জেনে মানুষ খেতে যাচ্ছে, কেনাকাটা করছেন, সেই সঙ্গে বসবাসসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ছে, মারাও যাচ্ছে। একটি ঘটনা ঘটলে কয়েক দিন নড়েচড়ে বসে ফায়ার সার্ভিসসহ প্রশাসন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই, আর কার্যক্রম চলতে থাকে এসব ঝুকিপূর্ণ মার্কেট, শপিংমল ও ভবনে।
সারা দেশে ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৩৩৭টি মার্কেট ও শপিংমল পরিদর্শন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে আছে ২ হাজার ৮১টি ভবন। আর এর মধ্যে ৪২৪টি ভবন অতি ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে রাজধানীর ২ হাজার ৬০৩টি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০৬টি মার্কেট-শপিংমল। তালিকায় রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভবন।
ফায়ার সার্ভিসের ২০২৩ সালে পরিদর্শন প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, রাজধানীর ৫৮টি মার্কেট, সুপার মার্কেট ও শপিংমল অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকার ১ হাজার ২০৯টি ভবনের মধ্যে ১২৭টি ছিল অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। আর সাধারণ ঝুঁকিতে ছিল ৬০২টি। পরিদর্শন করা মার্কেট ও শপিংমলের মধ্যে প্রায় ৭৫ দশমিক ৯০ ভাগই অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব স্থাপনায় যে কোনো সময় আগুন লাগতে পারে।
অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো হলো : রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, বরিশাল প্লাজা মার্কেট, আলাউদ্দিন মার্কেট, শাকিল আনোয়ার টাওয়ার, শহিদুল্লাহ মার্কেট, শরীফ মার্কেট, মায়া কাটরা (২২ মার্কেট) ও সিদ্দিকবাজারের রোজনীল ভিস্তা।
মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা ভবনগুলো হলো : আলম সুপার মার্কেট, উত্তরা মার্কেট (খিলগাঁও), সালেহা শপিং কমপ্লেক্স, মনু মোল্লা শপিং কমপ্লেক্স, লন্ডন প্লাজা শপিংমল, এ কে ফেমাস টাওয়ার, রোজভ্যালি শপিংমল, মেহের প্লাজা, প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার, নিউ চিশতিয়া মার্কেট, চিশতিয়া মার্কেট, নেহার ভবন, ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্স, ইসমাইল ম্যানশন সুপার মার্কেট এবং সুবাস্তু অ্যারোমা শপিংমল।
সাধারণ ঝুঁকির মধ্যে থাকা ভবনগুলো হলো : বুড়িগঙ্গা সেতু মার্কেট, খিলগাঁও তালতলা সিটি করপোরেশন সুপার মার্কেট, তিলপাপাড়া মিনার মসজিদ মার্কেট, হাজী হোসেন প্লাজা, ইসলাম প্লাজা, নিউমার্কেট (কোনাপাড়া, ডেমরা), আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স, এ হাকিম কমপ্লেক্স, বাচ্চু মিয়া কমপ্লেক্স, ড্রিমওয়্যার, এশিয়ান শপিং কমপ্লেক্স, মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট, ফেয়ার প্লাজা, শেপাল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড, নাসা মেইনল্যান্ড, জাকারিয়া ম্যানশন, হাজী আব্দুল মালেক ম্যানশন, ইপিলিয়ন হোল্ডিং লিমিটেড, গ্লোব শপিং সেন্টার, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট, চাঁদনী চক মার্কেট, নিউ সুপার মার্কেট (উত্তর ডি ব্লক), নুরজাহান সুপার মার্কেট, হযরত বাকু শাহ হকার্স মার্কেট, ইসলামিয়া বই মার্কেট, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-১, সিটি প্লাজা ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২, হান্নান ম্যানশন, নগর প্লাজা, রোজ মেরিনাস মার্কেট এবং দুকু টাওয়ার।
জানা গেছে, কোনো কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন মালিককে বারবার নোটিশ দেওয়া হলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইনগতভাবে কিছুই করার থাকছে না। তবে ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার ফায়ার সার্ভিসের আছে। তবুও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবার ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে নির্দেশ দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। আগামী সপ্তাহ থেকেই মামলার কার্যক্রম শুরু হতে পারে।
নারীদের কাছে জনপ্রিয় মার্কেট ঢাকার গাউছিয়া ও উল্টো দিকে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ)। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সেখানে কেনাকাটা করতে যান। অথচ তারা জানেন না মার্কেট দুটি আগুনের অতি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে। গাউছিয়া ও ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটকে ২০১৯ সালে অগ্নিনিরাপত্তার দিক দিয়ে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে একাধিকবার নোটিশ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে গত বছরের এপ্রিলে আগুন লাগে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে।
গাউছিয়া মার্কেটের দোকানমালিক সমিতির বর্তমান সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদও বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, কমিটি বিষয়টি বলতে পারবে। তিনি কিছু জানেন না।
সাধারণ ঝুঁকিতে থাকা খিলগাঁও সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার মার্কেট পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জুয়েল বলেন, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আমাদের এখনো কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। কেন আমাদের ঝুঁকির তালিকায় রেখেছে জানি না। তবে যতটুকু জানি, আমাদের পানির রিজার্ভ ট্যাংকের ধারণক্ষমতা ১৫ হাজার লিটার। এটা খুবই অপ্রতুল। কম করে হলেও এখনে এক লাখ লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন রিজার্ভ ট্যাংক প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে মেয়র মহোদয়ের কাছে আবেদন জানানো হলেও লাভ হয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘আমরা নিয়মিত কাজের অংশ হিসাবেই ভবনের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শন করি। যেসব ভবনে নিরাপত্তার ঘাটতি থাকে, সেসব ভবন কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নোটিশ দিই। আইনে পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় আমরা এসব ভবনের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে এসব ভবনে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে পর্যায়ক্রমে মামলা করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।’
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। গড়ে প্রতিদিন ৭৭টি। এইসব আগুনের ঘটনায় সারা দেশে মোট ২৮১ জন আহত এবং ১০২ জন নিহত হয়েছেন। এইসব ঘটনায় ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকা মূল্যের সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া প্রতিবেদনগুলোতে ওই সব অনিয়ম এবং ঝুঁকির ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছে তার উল্লেখ করা হয়নি। বাস্তবে তারা কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়না। যেমন বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজের’ ব্যাপারে তারা তিন বার নোটিশ দিলেও আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন এন্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নোটিশের পর মামলা ও মেবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারি। তবে মামলা করে তেমন ফল হয়না। ২০১৪ সালের ফায়ার বিধিমালা স্থগিত থাকার ফলে মামলা কাজে আসে না। আর আমাদের নিজস্ব ম্যাজিষ্ট্রেট না থাকায় মেবাইল কোর্ট পারিচালনাও কঠিন।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সিল গালা করতে পারিনা। আইনে আমাদের সেই ক্ষমতা নাই। বার বার নোটিশ দেয়ার পরও যখন ভবন মালিক আমলে না নেয় তখন আমরা ভবনটি অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ বলে নোটিশ টানিয়ে দিই। কিন্তু আমরা চলে আসার পর তা তারা ছিড়ে ফেলেন।’
০৪ মার্চ ২০২৪, ১৪:৩৬