• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo
একুশ বলে দেয় বর্ণমালার কথা
অ, আ, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, প, ত, এ, ভ, ম শ- এই অক্ষরগুলোই আমাদের প্রাণ, জয়ের গান, বিশ্ব দরবারে পরিচয় করে দিতে যার ভূমিকা অপরিসীম। মায়ের ভাষা কথাটির পেছনে অনেক রক্তঝরা শহীদের স্মৃতি বিজড়িত। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সফিক, সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের মতো বাঙালির রক্তের বিনিময়ে আজ এ দিনটিকে আরও বেশি স্মরণীয় করে রেখেছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র। যেমনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষও আজকের এই দিনে সম্মান জানাবে আমাদের এই ভাষা শহীদদের প্রতি। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসন শোষণের পর। আজ আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলার মাটিতে এই মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছি সেই রক্তঝরা শহীদদের আন্দোলনের মাধ্যমে। পাকিস্তানি জান্তারা বরাবরই বাংলার মেধাবীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল মেধাশূন্য করে উর্দু ভাষাকে পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব; বাংলা মায়ের সন্তানরা এতটা দেশপ্রেমী যেখানে যে কোনো পরাশক্তিকে প্রতিহত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি কালজয়ী সাক্ষী হয়ে আছে আজকের এই বাংলাদেশ। যেই দেশটিতে আজ সবাই মুক্ত মনে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে।  এই বাংলা সংস্কৃতির ছোঁয়ায় আজ আমরা অনেক কিছুতে বিশ্ব দরবারে জানান দিতে পারছি মেধা বিকাশের মাধ্যমে। যেখানে আজ পৃথিবীর মানচিত্রে সিয়েরালিওন নামক রাষ্ট্রটি পর্যন্ত আজ আমাদের মায়ের ভাষাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ঐতিহাসিক গানটি পরিবেশন করে। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা কিংবা পর্যালোচনার ইতিহাস সবারই জানা। তারপরও এই মাতৃভাষার ঐতিহাসিক পটভূমিকে স্মরণ করে রাখতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পুনরায় প্রকাশ করতে হলো এই প্রজন্মের কাছে। কারণ নতুন প্রজন্মকে আরও বেশি দেশপ্রেমী চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে ইতিহাসকে স্মরণ করে। উৎখাত করতে হবে ১৯৫২, ১৯৭১’র সেই পাকিস্তানি অপশক্তিকে, যারা এখনো এই দেশের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের দোহাই দিয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রগতিশীল ও সুষ্ঠু ধারার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে। তাই প্রায় ১৭ কোটি বাঙালি সজাগ থাকবে অপশক্তিকে প্রতিরোধ ও পরিহার করে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই স্মরণীয় দিনটিকে মনে রেখে। বাংলাদেশকে সঠিক গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে পৌঁছে দিতে এবং সরকারের পাশাপাশি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবারও সৃষ্টি করতে হবে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সফলতার পটভূমি। ভাষার লড়াইয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পর্যালোচনা:- ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে। তাই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ওই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়- যার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় ভাষা আন্দোলন।  পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদী, ক্ষমতালোভী, ঔদ্ধত্য শাসকরা শুরু থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাতে থাকে। তাদের প্রথম টার্গেট ছিল কিভাবে কেড়ে নেবে এই বাংলা মায়ের মুখের ভাষা। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। প্রখ্যাত লেখক ড. আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়ার ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন’ নামক বইয়ের ১৭০ পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে বিভিন্ন ভাষাভাষির আনুপাতিক হার পরিলক্ষিত হয়। যেখানে বাংলাভাষার আনুপাতিক হার ছিল ৫৪.৬ শতাংশ, পাঞ্জাবি- ২৭.১%, পশতু- ৬.১%, উর্দু-৬%, সিন্ধি-৪.৮% এবং ইংরেজি ভাষার আনুপাতিক হার ছিল ১.৪। তাহলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাভাষার আনুপাতিক হার ছিল সবচেয়ে বেশি। আর মাত্র শতকরা ৬ শতাংশ ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।  ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় একই ঘোষণা দেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ফলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবী মহলে দারুণ ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয় এবং আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৫২’র ৩০ জানুয়ারি ঢাকাতে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনকে তীব্রতর করার লক্ষ্যে ওই দিনই এক জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কমিটি গঠিত হয়। আর এই কমিটির মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান ক্রমান্বয়ে জোরদার হতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে ২১ ফেব্রুয়ারির উক্ত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তখনকার গভর্নর নূরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল অগ্রসর হয় এবং কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মিছিল যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে আসে ঠিক তখনি পুলিশ মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ফলে মিছিল কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয় এবং রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ আরও নাম না জানা অনেক ছাত্র শহীদ হন। সরকারের এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথে নেমে আসেন এবং প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে।  ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের আপামর ছাত্রসমাজ বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে যে মাতৃভাষা অর্জিত হয়েছে তার গণ্ডি তখন শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রই। ভাষার জন্য বাঙালি জাতির এ আত্মত্যাগ আজ নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে। এই মাসটিকে আর স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবং সরকারিভাবে বাংলাভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করা হয় এই মহান চেতনাকে কেন্দ্র করে। আজ আমরা হাসি-আনন্দ, দুঃখ বেদনা সবকিছুই প্রকাশ করি মায়ের ভাষায়। তাই ভাষার এ গুরুত্বের কথা ভেবেই পৃথিবীর সব দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষা দিয়েই শিশুর মনে স্বদেশপ্রেমের সূত্রপাত ঘটে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৫২ সালের এই দিনে রক্তের বিনিময়ে অকাতরে জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাভাষার মর্যাদা- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি- আমি কি ভুলিতে পারি।’ লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৪:২৮

একুশ বরণে প্রস্তুত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার 
ভাষা কেবল ভাব প্রকাশের বাহনই নয়, একটা জাতির অস্তিত্ব আর আত্মপরিচয়েরও বাহক। সেই আত্মপরিচয়ই বাঙালির কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানের শোষক সরকার। বাংলার জমিনে বুনে দিতে চেয়েছিল উর্দু ভাষার বীজ। কিন্তু মেনে নেয়নি বাংলার বীর সন্তানরা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় সেদিন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বাররা অকাতরে ঢেলে দিয়েছিলেন বুকের তাজা রক্ত। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পুলিশের অস্ত্রের মুখে ভয়ডরহীন দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন নাম না জানা আরও অনেকে। জীবন দিয়ে রক্ষা করেছিলেন প্রাণের বাংলা ভাষার মর্যাদা। ফেব্রুয়ারি এলেই বাঙালির জীবনে ফিরে ফিরে আসে ’৫২-এর সেই ভাষা আন্দোলন আর একুশের মিছিলে বাংলার অকুতোভয় সৈনিকদের মহান আত্মদানের স্মৃতি। একুশের প্রথম প্রহর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ভাষা শহীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। ভোরে প্রভাতফেরী থেকে শুরু করে দিনব্যাপী বিভিন্ন আয়োজনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার হয় প্রাণের বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের।  এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতি ও বিশ্ববাসীর সামনে হাজির আরেকটি ২১ ফেব্রুয়ারি। জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা মহান এই দিনটিকে বরণ করে নিতে ইতোমধ্যে প্রস্তুত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। যথাযথ ও সুশৃঙ্খলভাবে দিবস উদযাপনের লক্ষ্যে শহীদ মিনার ঘিরে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শিল্পীদের আঁকা আলপনায় সেজেছে মিনারের মূল বেদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমে জগন্নাথ হলের দিক থেকে আসা রাস্তার দুপাশের দেয়ালও রেঙেছে রং-তুলির আঁচড়ে। জাদুকরি হাতের ছোঁয়ায় সেখানে ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে একুশ স্মরণে বিভিন্ন গান আর কবিতার লাইন।    মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে শহীদ মিনার ঘুরে দেখা মেলে এমন চিত্রের।   আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাদেই মহান একুশের প্রথম প্রহর। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রথম প্রহর থেকেই শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সমবেত হবে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতিবারের মতো এবারও শহীদ মিনার এলাকা রাঙানোর কাজ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা।     শহীদ মিনারের উত্তর পাশের দেয়ালের প্রতিটি ব্লকে লেখা হয়েছে বিভিন্ন লেখকের কবিতা ও উক্তি।   দেয়ালে লেখা হয়েছে কবি জসীম উদ্দীনের কবিতার অংশ- ‘এ ভাষারি মান রাখিতে/হয় যদিবা জীবন দিতে/চার কোটি ভাই রক্ত দিয়ে/পুরাবে এর মনের আশা।’ লেখা হয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের উক্তি, ‘মাতৃভাষায় যাহার শ্রদ্ধা নাই, সে মানুষ নহে।’ আবুল ফজলের ‘একুশ মানে মাথা নত না করা।’ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতার অংশ- ‘মাগো ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না/ বলো মা তাই কি হয়?’ এর পাশেই আঁকা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ের চিত্র। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানরত আন্দোলনকারীদের প্রতিচ্ছবি। ‘উর্দু নয় বাংলা’, ‘অ আ ক খ’ প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিলে গলা ফাটানো তরুণ-তরুণীদের ছবি, মৃত কিশোরের মরদেহ কোলে মায়ের চিত্র।   সড়কের অন্য পাশের দেয়ালে লাল রঙে লেখা হয়েছে জাতীয় সংগীতের প্রথম লাইন ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি।’ সঙ্গে আঁকা হয়েছে টেপা পুতুলের আদলে ঘোড়া, মাছ, পাখি, ময়ূর খরগোশ, নৌকাসহ বাংলার বিভিন্ন চিত্র।   চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নেসার হোসেন বলেন, একুশ বরণে এবার আমাদের শতাধিক সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী আঁকাআঁকিতে অংশ নিয়েছেন। রাঙানো হয়েছে রাস্তার পাশের ফুটপাতের সাদাকালো ব্লকগুলোও। সরকারপ্রধান হিসেবে এবার ২১তম বারের মতো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাষা শহীদদের প্রতি তার এই ২১টি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দূর্লভ ছবি দিয়ে শহীদ মিনারের দক্ষিণ পাশের প্রবেশমুখে প্রদর্শনী করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে আয়োজনের প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে সম্পন্ন।  এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টায় শহীদ মিনার প্রস্তুতির সার্বিক অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আগের বছরগুলোয় আমাদের কোথায় ভুল ছিল, কোথায় গ্যাপ ছিল, সেগুলো বিশ্লেষণ করে এবার তা কমানোর চেষ্টা করেছি। পুরো অনুষ্ঠান যেন ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হয়, সে ব্যবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বক্তৃতায় বাংলা ভাষার প্রতি অনুরক্ততা প্রকাশ করে যে কথা বলেছিলেন, তার ছবিসহ সে উক্তিও আমরা এখানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছি, যাতে তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস জানতে পারে।   একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে যাতায়াতের রুটম্যাপ একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে ঢাবি উপাচার্যের বাসভবনের গেট থেকে ফুলার রোড মোড়, টিএসসির সড়কদ্বীপ থেকে বকশীবাজার সড়ক, কাজী মোতাহার হোসেন থেকে শহীদ মিনারের সড়ক এবং দোয়েল চত্বর থেকে চানখারপুল পর্যন্ত সড়ক বন্ধ থাকবে।   শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর সেখান থেকে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের সামনের রাস্তা হয়ে দোয়েল চত্বর ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রাস্তা দিয়ে চানখারপুল হয়ে প্রস্থান করা যাবে। শহীদ মিনারের দিকে আসা যাবে না।   এ ছাড়া শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য জনসাধারণকে হোম ইকোনোমিকস মোড় দিয়ে আজিমপুর কবরস্থানের উত্তর গেটের দিকে গিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পর দক্ষিণ গেট দিয়ে ইডেন মোড় হয়ে বের হতে বলা হয়েছে।   চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এ বছর শহীদ মিনারে চারস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শহীদ মিনার এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল টিম, সোয়াত টিম, ফায়ার সার্ভিস, মেডিকেল টিমমহ অন্যান্য টিম নিরাপদ দূরত্বে প্রস্তুত থাকবে। শহীদ মিনার এলাকায় সার্বক্ষণিক তল্লাশি ব্যবস্থা এবং পেট্রলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ড্রোন পেট্রলিং, মোবাইল পেট্রলিং এবং সাইবার পেট্রলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:২১

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতীয় শিক্ষাক্রম
জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরের অন্যতম হাতিয়ার শিক্ষা। তবে যুগের চাহিদা ও পরিবর্তিত বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষাব্যবস্থায়ও এসেছে পরিবর্তন। ফলে প্রাচীন গুহাবাসী শিকারি ও আহরণজীবী মানুষের শিক্ষার সাথে কৃষিজীবী মানুষের শিক্ষার তফাত দেখা যায়, কৃষিজীবী মানুষের থেকে ভিন্নতর হয় শিল্পবিল্পব যুগের শিক্ষার বিষয় ও পদ্ধতি। অনানুষ্ঠানিক গুরুগৃহকেন্দ্রিক শিক্ষা থেকে খোলনলচে রূপান্তর ঘটে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবর্তিত হয় পঠন-পাঠন পদ্ধতি। একুশ শতকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চতুর্থ শিল্পবিল্পবের বাস্তবতায় তাই আরও একবার বাঁকবদল ঘটে শিক্ষার।  নতুন শতকের উপযোগী অভিযোজনক্ষম এবং রূপান্তরমূলক দক্ষতা সমৃদ্ধ নাগরিক সৃষ্টির লক্ষে পৃথিবীর ১০২টি দেশ ইতোমধ্যে তাদের শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করেছে।  এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাও তাদের শিক্ষাক্রম সংস্কারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে।  অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন নির্ভর এই শিক্ষাক্রমে সমন্বয় ঘটেছে আধুনিক শিখন চিন্তা ও প্রক্রিয়ার যেখানে শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতা অর্জন, এর ভিত্তিতে চিন্তন, তথ্য আহরণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে এবং বুঝতে পারবে।  শিখনের বিষয়বস্তুকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার পরিবর্তে সামগ্রিকভাবে দেখা, অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।  শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ভাষাদক্ষতা, গাণিতিক দক্ষতা, বিজ্ঞান, সমাজ ও পরিবেশ বিষয় জ্ঞান ও দক্ষতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও কর্ম, নৈতিক মূল্যবোধ, শিল্প-সংস্কৃতি ইত্যাদি সামগ্রিক বিষয়ে সমন্বয়ে ঘটেছে, যা ক্রমসম্প্রসারণের মাধ্যমে ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশে সহায়ক হবে। কিছু অভিভাবক ভয় পাচ্ছেন যে নতুন শিক্ষাক্রমের অনুসৃত পদ্ধতির বিজ্ঞান শিক্ষার পরিসর কমে যাবে বা পরীক্ষা নির্ভর পদ্ধতি না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় অনাগ্রহী হয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে এর বিপরীতটাই হবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতিতে একেবারে শিশুকাল থেকে যে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান ও বিষয়গত বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে তারা বেড়ে উঠবে তা তাদের জ্ঞান চর্চার বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আরও বেশি বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলবে।  অভিজ্ঞতাভিত্তিক এই শিখন পদ্ধতির ফলে তারা সহজেই অনেক বিষয় শিখতে পারবে যেটা শত পাতার তথ্য ও তত্ত্ব মুখস্থ করে অর্জন করা সম্ভব হতো না।  তাছাড়া এ ধরনের তাত্ত্বিক জ্ঞান একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ভুলে যায় যা তার বাস্তব জীবনে কোন কাজে আসে না। কিন্তু অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়ার পথটি দেখিয়ে দেয়, ফলে সে নিজের নিজের শেখার প্রক্রিয়াটি চালিয়ে নিতে পারে।  এখন যেকোনো বিষয় অনলাইনে সার্চ করে মুহূর্তেই পেয়ে যেতে পারি। ফলে তথ্য-তত্ত্বকে মস্তিষ্কে সংরক্ষণ করে রাখার চাইতে বরং এসব তথ্য ও তথ্য কীভাবে অনুসন্ধান করতে হবে, কিভাবে সেগুলো কাজে লাগানো যাবে, কীভাবে সমস্যার সমাধান খোঁজা যাবে, কীভাবে অন্যদের সাথে যোগাযোগ ও বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা যাবে, কীভাবে সমস্যা নিয়ে অন্যদের সাথে যৌথভাবে কাজ করা যায় এসব বিষয় শেখা খুব জরুরি। একুশ শতকের দক্ষতা বলতে এসব দক্ষতাকেই বোঝায় যা নতুন শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মুখস্থ নির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে গাঠনিক মূল্যায়ন কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে যেখানে নিয়মিতভিত্তিতে প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ যাচাইয়ের মাধ্যমে তাদের শিখন ঘাটতি নিরূপণ এবং সেসব ঘাটতি দূর করতে প্রয়োজনীয় নিরাময়ের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। ফলে গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর পরিবর্তে প্রত্যেক শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত শিখন যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হবে।  এছাড়া নির্দিষ্ট সময় বিরতিতে সাময়িক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামষ্টিক অর্জনও মূল্যায়ন করে তাদের অর্জনের স্বীকৃতি দেয়া এবং প্রত্যেকের সবল দিকগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও পেশা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করা সম্ভব হবে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম স্মার্ট জনসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে ২০৪১ এর উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।   লেখক : প্রভাষক, শিক্ষা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  
০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:০৩
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়