• ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
logo
সৃজনের আনন্দে কড়া নাড়া : জোবায়ের মিলনের গল্প
গল্পের কাছে কেন যাই?  প্রথমতই একটা গল্প শুনতে চাই। মানুষের আগুন আবিষ্কার একটা বিরাট ঘটনা। সভ্যতার চাকা একটানা কয়েক দফা ঘুরে এসেছে আগুন আবিষ্কারে। এতকাল এমনও জেনে এসেছিলাম যে, আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষ একসময় পশুর কাঁচা মাংস খাওয়া ছেড়ে রান্নার করা মাংস খেলো, আর তাতে করে তার রেচক দন্ত ছোট হয়ে গেল, দাঁতের গোড়াও কমে গেল, ফলে মস্তিষ্ক আরও বড় হওয়ার সুযোগ পেলো। আর বড় মস্তিষ্ক মানেই উন্নততর প্রাণী, প্রাণীকূলের শীর্ষস্থানে উঠে এলো দুর্বল মানুষ। কিন্তু ইওয়ভাল নো হারারি তার অনবদ্য গ্রন্থ ‘সেপিয়েন্সে’ মানুষের শীর্ষে ওঠে আসার কারণ হিসেবে গল্পের কথা বলছে। স্পষ্টতই তিনি জানাচ্ছেন, গল্প বলা, গল্প শোনা এবং গল্পকে মেনে নেওয়ার এক সৃষ্টিশীলতা মানুষের মগজে আছে। একদল মানুষ স্বর্গ, নরক, দেব, দেবী আরও কত কী গল্প বানায়, আরেকদল মানুষ সেই সব গল্প অকাতরে মেনে নেয়। এই যে গল্পের কাছে মানুষের ফিরে যাওয়া তার মধ্যেই রয়েছে মানুষের সৃষ্টিশীলতা বিকাশে সর্বোত্তম সুযোগ। সেই দিক থেকে, আমি মানুষের অন্তর্গত হওয়ায় গল্পে বিশ্বাসী। গরু, মহিষ, হাতি, ঘোড়া, বাঘম ভাল্লুক, পাখিদের কেউ গল্প লেখে না, পড়ে না, তাদের গল্পের জগত নেই। আমাদের আছে। একজন জোবায়ের মিলন গল্প লেখে, একজন মুম রহমান সেই গল্প পড়ে এবং গল্পগুলোতে আস্থা রাখে। এইভাবে সৃষ্টিশীলতার ধারাটি চলে যুগ যুগ ধরে, গল্পের হাত ধরে। জোবায়ের মিলনের গল্পের সবচেয়ে বড় শক্তি, মূলত সেখানে গল্পই আছে। অর্থাৎ বিবিধ গল্প ভাঙার বিমূর্তকরণে তিনি যাননি। গল্প বয়ানের নানা কৌশল তার থাকলেও কোনোভাবেই সে গল্পকে গল্পহীনতার কূটকচালে নিয়ে যাননি।  ছোটগল্পের কাছে যখন যাই তার প্রবেশমুখটা তো প্রথম লাইন। গল্পের প্রথম লাইনটা বাড়ির দরজা বা ফটকের মতো। সে আমন্ত্রণ জানায়, কাছে টানে, ভেতরে ঢুকতে উৎসাহ দেয়। আমি তাই ছোটগল্পের ছোট পরিসরে উঁচুদরের একটা সূচনা চাই। আমি চাই প্রথম লাইনটাই আমাকে টান দিয়ে গল্পের ঘরে ঢুকিয়ে দিক। জোবায়ের মিলন সেই সব ছোটগল্পকারদের একজন যিনি আমার এই চাওয়া পূর্ণ করতে পেরেছেন। উদাহরণ দিয়ে বলি, ‘সৌরভের সন্ধানে’ শিরোনামের গল্পের প্রথম লাইন হলো, ‘ঘুম ভাঙার পর আমানত গাজী টের পায় তার শরীর থেকে একটা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।’ এইবার আমার গল্প পিপাসার্ত মন আমানত গাজীর পেছনে কিংবা সেই দূর্গন্ধের পেছনে যেতে প্রস্তুত হয়ে যায়। অথচ গল্পের নাম কিন্তু ‘সৌরভের সন্ধানে’, ধারণা করাই যায়, আমানত গাজীর দুর্গন্ধ থেকে আমরা শেষতক কোন একটা সৌরভের সীমানায় পৌঁছাতে পারব। এই যে একটা ধারণা একটি মাত্র লাইনে; গল্পের প্রথম লাইনে তৈরি হওয়া সেই ধারণাই পাঠক মুমকে বাকী পথ হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। জোবায়ের মিলনের একাধিক গল্পের সূচনা ধরে সুনিশ্চিতই এগুতে থাকি আমি, কেননা, সামনে একটা জমজমাট গল্পের সম্ভাবনা খুঁজে পাই। কয়েকটি গল্পের প্রথম লাইনেই লেখক জোবায়ের মিলন ছক্কা মেরেছেন। ‘পুকুরটিতে এ যাবৎ কতজনের লাশ ভেসে উঠেছে, এর সঠিক হিসাব নেই কারো কাছে (কুয়াশাকর্পুর, কাল, অন্ধকারের জীবাশ্ম)।’ ‘সাড়ে এগারো বছর পর লোকটির ফিরে আসার কথা শুনে আবার কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করে সবার (প্রত্যাবর্তন ও)।’ ‘চিঠিগুলো প্রথম হাতে পড়েছিল বাসা বদলের সময় (দায়মোচন)।’ বাংলা সাহিত্যে গল্পকার হিসেবে যারা নিজেদের ছাপটা রেখেছেন তাদের গল্পের জোর, গল্পের সূচনা, সমাপ্তি ও চরিত্র নির্মাণ অন্যতম সম্পদ। আরও একটি বড় ছুরি থাকে গল্পকারের খাপে, আদতে সব লেখকের খাপে, কেননা, লেখক, গল্পকার কিংবা কবি কিংবা প্রাবন্ধিক, তাকে শেষ পর্যন্ত শব্দের নকশিকাঁথা বুনেই এগোতে হয়। চরিত্র আর গল্প বেড়ে ওঠে শব্দের বিন্যাসে, বিভাজনে, বিস্তারে। জোবায়ের মিলনের ঝুলিতে এই শব্দ বুননের সবগুলো কলকব্জাই আছে। ‘জীবনঘানি’ গল্পের একটা অংশ পড়তে পারি, ‘প্রতিটি বিজলির ঘা ফয়জুন্নেছাকে মুহূর্তে ঝলসে দেয়। একটা খাড়া পাহাড় তার গায়ের ওপর ধসে পড়ে। সে কি এইখানে আছে, না নেই! বুঝতে পারে না। তার মাথায় ‘ত্রিশ হাজার টাকা।’ শব্দটি যেন শ্যালো মেশিন। চারদিকের দেয়াল যেন কার্তিক মেলার চড়কাগাছ। ফয়জুন্নেছা যেন সেই চড়কাগাছের মধ্যে বসা একটা বেলুন। ডাক্তার ডাক দেন, ‘পারবে তো টাকা জোগার করতে?’ এইটুকু বর্ণনা, সংলাপ ও বয়ানে আমরা ফয়জুন্নেসার বাস্তব জগতকে পরাবাস্তব এমনকি অবাস্তব জগত হয়েও ঘুরে আসতে দেখি বিজলি, পাহাড়, শ্যালো মেশিন, চড়কাগাছ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারে। এটা আনন্দের কথা যে, জোবায়ের মিলনের আস্তিনে পর্যাপ্ত শব্দ আছে আমাদেরকে নানা জগতে ঘুরিয়ে আনার। এই আনন্দের জন্য তার গল্প পাঠ আমাদের সৃজনশীলতার দুয়ারে আরও কড়া নাড়ে।    [বুক রিভিউ, সাহিত্য সমালোচনা, মতামত এবং নবীন-প্রবীণদের নতুন বই সম্পর্কে লেখা পাঠাতে ইমেইল করুন- [email protected]]
২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ২১:৩৪
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়