• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

সন্তানের ‘হাইড্রোকাফেলাস’ রোগ, চিকিৎসায় সর্বস্ব বিক্রি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে পরিবার!

আরটিভি নিউজ ডেস্ক

  ২২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৫২
Affected children
আক্রান্ত শিশু

একমাত্র কন্যা শিশুর জীবন ও সুস্থতার জন্য বাড়ি-ঘরসহ সর্বস্ব বিক্রি করে ও ঋণগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে দিনমজুর কাওসার মুসুল্লির পরিবার। একমাত্র কন্যার মুখে ‘মা-বাবা’ ডাক শোনার জন্য ব্যাকুল মা ডালিয়া বেগম। জন্মের পর অতি আদরে নাম রাখেন আরিফা আক্তার। ফুটফুটে শিশুর বয়স যখন তিন মাস অতিক্রম করে তখন আরিফা আক্রান্ত হয়ে পড়ে ‘হাইড্রো কাফেলাস’ রোগে। সময় যতই গড়িয়ে যায় ততই শিশুটির মাথা বড় হতে থাকে। একমাত্র কন্যার সুস্থ্যতা ও জীবন বাঁচাতে চিকিৎসার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের তাজেপাড়া গ্রামের রিক্সাভ্যান শ্রমিক পারিবারটি।

সরেজমিন দেখা গেছে, বেলা ভূমি অধ্যুষিত তাজেপাড়া গ্রামটি। খাল-বিল আর সবুজ বন-বনাণীতে ঘেরা গ্রামের প্রতিটি মানুষ ব্যস্ত বাড়ির উঠানো তোলা ধান মাড়াই কিংবা শুকানো কাজে। গৃহিণীরা ব্যস্ত সাংসারিক কাজে ও শিশুর পরিচর্যায়। কিন্তু একমাত্র কন্যা শিশুর মুখে মা ডাক শুনতে ব্যাকুল হতভাগা মা ডালিয়া বেগম আরিফাকে কোলে নিয়ে মাথায় কোমল হাত বুলাচ্ছেন আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও অঝোর ধারায় দুচোখের পানি ঝরাচ্ছেন। কষ্টে কাতরাচ্ছে শিশুটি। পৌষের মিষ্টি রোদে ঘরের সামনে বসে বসে ঝিমাচ্ছেন অসহায় পিতা কাওসার মুসুল্লি।

এসময় অসুস্থ একমাত্র কন্যার বিষয়ে ডালিয়া বেগম বলেন, লতাচাপলী ইউনিয়নের আজিমপুর গ্রামের আমার পিতা আঃ রশিদ হাওলাদার ২০০৪ সালে একই ইউনিয়নের মুসুল্লীয়াবাদ গ্রামের ইউনুচ মুসুল্লির সেজ ছেলে কাওসার মুসুল্লির সঙ্গে বিয়ে দেয়। বিয়ের আট বছর পর ২০১২ সালে একটি মাত্র ছেলে আরাফাত জন্মগ্রহণ করে। ছয় বছর পর ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল একমাত্র কন্যা আরিফা জন্মগ্রহন করে। আরিফা জন্মের তিন মাস পর তার মাথা দিনে দিনে বড় হতে থাকে। কন্যার এমন পরিস্থিতিতে তাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাই পটুয়াখালী, বরিশালসহ বিভিন্ন স্থানে। একপর্যায়ে স্বামীর পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে কন্যার চিকিৎসা করানো হয় এবং আড়াই লাখ টাকা দিয়ে একই ইউনিয়নের তাজেপাড়া গ্রামে চার কড়া জমি ক্রয় করে বসত ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করি। কিন্তু একমাত্র মেয়ের অসুস্থতায় আমাদের দিন খুব খারাপ যাচ্ছে। মেয়ের চিকিৎসার জন্য এবং সংসার পরিচালনার জন্য হীডবাংলাদেশ এনজিও থেকে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ গ্রহ করি গতবছর। ইতোমধ্যে ২০ হাজার পরিশোধ করা হয়েছে। আশা এনজিও থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করা হলেও সেখানে ১৫ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া গ্রামবাসীর কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা সুদে টাকা এনে আয় রোজগারের জন্য একটি অটোরিকশা ক্রয় করা হয়। কিন্তু আয় কম হওয়ায় ঋণ এবং দেনা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় নিজেদের বসত ঘরসহ জমি বিক্রি করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। তবে এখন আর অর্থাভাবে আমার বুকে ধন একমাত্র কন্যার চিকিৎসা করাতে পারছেনা আমার স্বামী।

আরিফার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ডালিয়া বেগম আরও জনায়, দিন যতই যাচ্ছে ততই মেয়ের মাথা বড় হচ্ছে। এখন মাথার চাড়া অস্বাভাবিক ফাঁকা হয়ে গেছে। পানিতে মাথা থলথল করছে। আরিফার এখন তিন বছর বয়স। তিন বছরে ওর শরীর সেই তিন মাসের শিশুর মতোই রয়েছে কিন্তু মাথার ওজন প্রায় ১০ কেজি ওজন হয়েছে। এখন প্রায়ই সে অসুস্থ থাকে। বুকের দুধ পায়না। স্বাভাবিক সকল খাবার তাকে খাওয়ানো হচ্ছে। তবে তার দাঁত শক্ত হয়েছে। পুষ্টিহীনতার কারণে প্রায়ই জ্বর-সর্দি-কাশি থাকে। এখন আমার মেয়ের চোখ দিনে দিনে নীচের দিকে দেবে যাচ্ছে। গালের চামড়া টেনে চোখ মেলে যখন আমাকে না দেখে তখন তার চিৎকার শুরু হয়। আমি একজন মা আমার কন্যার মুখে মা ডাক শোনার জন্য অপেক্ষায় আছি। কিন্তু আমার মেয়ের চিকিৎসার জন্য আমাদের সর্বস্ব বিক্রি করে এখন পথের ফকির হয়ে গেছি। একমাত্র পুত্র সন্তান আরফাত দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। তাকেও ঠিকমতো লালন পালন করতে পারছিনা অর্থাভাবে। দেনাদারদের পাওনা এবং এনজিও কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় একপ্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। না খেয়ে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছি।

এবিষয় অসহায় পিতা কাওসার মুসুল্লি বলেন, আমার একমাত্র কন্যার অসুস্থতার জন্য আমি এখন পথের ফকির হয়ে গেছি। মেয়ের মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য এবং সুস্থতার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। এখন আমার চোখের পানি ছাড়া কিছুই নাই যে, যা দিয়ে আমার মেয়েকে চিকিৎসা করাবো। এক বছর ধরে মেয়েকে চিকিৎসা করাতে পারছিনা। মেয়েটি মাথার ব্যথায় দিন-রাত সমানে কান্না করছে। শুধু চেয়ে থাকি কিছুই করার শক্তি আমার নাই। পাষাণ পৃথিবীতে কেন আমাকে আল্লাহ এত বড় শাস্তি দিচ্ছে জানিনা।

এব্যাপারে প্রতিবেশী নান্নু হাওলাদার বলেন, আমরা শিশুটির চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা সহায়তা দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। এখন এই গ্রামের অসচ্ছল পরিবারের মানুষ বেশি। তাদের নিজেদেরই সংসার চলে টানাপোড়নে, অন্যকে আর কতদিন সাহায্য করবে ? আমি একজন পিতা আমি যখন আমার মেয়েকে অতি আদরে কোলে তুলি-আদর করি এবং বাবা ডাক শুনি। এই শিশুর বেলা তা সম্পূর্ণ উল্টো। শিশুটিকে বাঁচাতে সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে শিশুটি সুস্থ ও স্বাভাবিক হতে পারবে। বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে এই পরিবারটি।

এব্যাপারে কলাপাড়া হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার জে, এইচ , খাল লেলীন বলেন, মাথা বড় হওয়া যে কোন কারণে হতে পারে। এটি জন্মগতকারনেও হতে পারে আবার অন্যকোন কারণেও হতে পারে। তবে আরিফার মাথা বড় হওয়ার মুল কারণ হিসেবে বোঝা যাচ্ছে যে, তার মাথায় সি.এস.এফ জাতীয় একধরনের তরল পদার্থ সৃষ্টি হয়েছে।। ঢাকায় পিজি হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিউরোসার্জানের মাধ্যমে দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা করাতে পারলে শিশুটি সুস্থ হতে পারে। যত বেশি দেড়ি হবে ততই ওই শিশুটির জন্য সমস্যা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোঃ শহিদুল হক বলেন, আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিশুটিকে চিকিৎসার জন্য যথা সম্ভব সহযোগিতা করবো। তবে সমাজে বিত্তবানদের আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে শিশুটির দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আহ্বান করছি। শিশুটির জীবন ও ওই পরিবারটিকে রক্ষার জন্য সমাজের প্রতিটি মানুষ এগিয়ে আসলে পরিবারটি ও শিশুটির জীবন রক্ষা পাবে।

জিএ

মন্তব্য করুন

daraz
  • আসুন পাশে দাঁড়াই এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh