করোনাকালীন সাংবাদিকতা
স্বজনদের কান্নায় গলা ভারী হয়ে আসছিল আমার (ভিডিও)
আমার অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে গেলো রোববার (২৮ জুন) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবস্থান করছি। এমন সময় বেলা পৌনে ১২টার দিকে জরুরি বিভাগের গেটের পাশে একটি অ্যাম্বুলেন্স আসে। অ্যাম্বুলেন্সের গেট খুলতেই চিৎকার করে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। কাছে গিয়ে জানলাম, নিউমোনিয়ার সমস্যা নিয়ে পাবনার বেড়া থানা এলাকা থেকে ঢাকায় এসেছেন তারা।
মৃত ব্যক্তির ছেলেরাই চিৎকার করে কাঁদছিলেন। কারণ ঢাকা শহরে তারা পাঁচটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন তাদের বাবা মতিন মোল্লাকে ভর্তি করাতে। কোনো হাসপাতালে তাদের বাবাকে ভর্তি নেয়নি। বাবাকে বাঁচানোর আশা নিয়ে তারা যখন হাসপাতালগুলোতে যাচ্ছিলেন তখন তাদের আশা জেগেছিল যে এবার হয়তো ভর্তি করানো যাবে। কিন্তু না, সবাই ফিরিয়ে দিয়েছে। অবশেষে ছেলে আর অ্যাম্বুলেন্সে থাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের সামনেই মতিন মোল্লার প্রাণ চলে যায়। তাদের চোখের সামনে জীবিত বাবাকে লাশ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। ছেলে কাওসারের বাবা হারানোর আর্তনাদে মনে হচ্ছিলো আমার বুকটা ফেটে যাবে। তার অসহায়ত্ব দেখে আমার গলা ভারী হয়ে আসছিল।
একই দিন বেলা এগারোটার দিকে চারটি হাসপাতাল ঘুরে কোথাও ভর্তি করাতে না পেরে কয়েকজন স্বজনসহ তারা ঢাকা মেডিকেলে আসেন প্রায় ৬০ বছর বয়সী মুমূর্ষ অবস্থায় এক মাকে নিয়ে। আই সি ইউ প্রয়োজন। ঢাকা মেডিকেলে আই সি ইউ খালি না থাকায় আবারো বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানোর উদ্দেশ্যে রওনা দেন তারা। তাদের কপালে কি ঘটেছে জানা যায়নি। কারণ তারা গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি। তাদের চেহারায় ছিল বিষন্নতা, হতাশা আর অসহায়ত্ব।
---------------------------------------------------------------
আরও পড়ুন: রোগী ভর্তি না করায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা থামছে না (ভিডিও)
---------------------------------------------------------------
এ ঘটনার মাত্র চারদিন আগে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নিউজ কাভারেজ করছিলাম। এমন সময় হঠাৎ চিৎকার! একটি মেয়ের অসহায় কান্না! অসুস্থ ব্যক্তির নাকে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে। নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। এমন দৃশ্য চোখে দেখা যায় না!! সহ্য করা যায় না!! একটু আগেই হাসপাতালটির পরিচালকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী। তাই বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন ফটোসাংবাদিক ওখানেই উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন পরিচালকও। অসুস্থ ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাতে দেরি হচ্ছিলো জরুরি বিভাগের সামনে হওয়ার পরেও। স্বজনের আহাজারি বহুদূর থেকে শোনা গেলেও ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী কেউ এগিয়ে এলেন না। এ দৃশ্য বিভিন্ন টিভি ক্যামেরাগুলো রেকর্ড করছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে পাশে থাকা পরিচালক নিজেই অ্যাম্বুলেন্স এর ভিতরে গিয়ে চেক করে বেরিয়ে এসে বললেন অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছেন অসুস্থ ব্যক্তি। কান্নার আওয়াজ আরও বাড়তে থাকে। রাগে-ক্ষোভে ডেথ সার্টিফিকেট না নিয়েই স্বজনরা অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়েন। কান্নার সাইরেন বাজিয়ে লাশ নিয়ে ফিরে যায় অ্যাম্বুলেন্স। রোগীটি ছিল নারায়ণগঞ্জের ডগাইর এলাকার। তারা নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে শেষ ভরসা হিসেবে এসেছিলেন মুগদা জেনারেল হাসপাতালে।
এতো গেলো অ্যাম্বুলেন্সে আসা সামর্থ্যবান রোগীদের কথা। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই? এমন অনেককে দেখা যায় ঢাকা মেডিকেলের সামনে অসহায় অবস্থায় বসে থাকেন ভর্তি হওয়ার আশায়, স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে। জিজ্ঞেস করলে বলেন- লোক আছে ভেতরে গেছে। আর কিছু বলতে চান না, হয়তো বলতে মানা। আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে অচেনা অনেক লোক এরা কেউ রোগী বা রোগীর স্বজন নয়; এদের আত্মীয়তা রোগী আর রোগীর স্বজনের টাকার সঙ্গে। গণমাধ্যমকর্মীরা এদের পথের কাঁটা। কোনো হাসপাতালের ভেতরে যেতে চাইলে তেড়ে আসেন আনসার সদস্যসহ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যরা। ওদের কোনো দোষ নেই। দোষ তাদের যারা এসি রুমে বসে এই আনসার সদস্য বা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না। অনেক হাসপাতালের পরিচালক, পরিচালকের পিএসসহ স্বাস্থ্য বিভাগের অনেকে ফোন ধরেন না। এসএমএস দিয়ে পরিচয় দিলেও নয়।গণমাধ্যম আর চিকিৎসক যেন একে অপরের শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অপমানিত বোধ করি চেয়ারগুলোতে কারা বসে আছেন এটা ভেবে।
২৯ জুন (সোমবার) বুড়িগঙ্গার লঞ্চমর্নিং বার্ড ডুবির পর বেলা তিনটা পর্যন্ত সবগুলো লাইভে ছিলাম। চোখের সামনে তরতাজা দেহগুলো তোলা হচ্ছিল। সবাই গুনছিল লাশ। আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছিলাম। উদ্ধারকর্মীদের সাথে কোনো চিকিৎসক নেই যারা পানিতে ডোবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মানুষকে কিভাবে বাঁচাতে হয় তার চিকিৎসা করবে। তা না করে মরদেহগুলোকে লাশের ব্যাগে ভরা হচ্ছিল। গণনা করা হচ্ছিল মৃতদেহ হিসেবে। আমার মনে হচ্ছিল অনেকে বেঁচে আছেন চেষ্টা কারো নেই। মাত্র দু ঘণ্টার ব্যবধান। পাশে মা হারানো সন্তানের আহাজারি। স্বামী হারানো স্ত্রীর।
করোনা আসার আগে এমন অবস্থা দেখা যায়নি। টাকা নিয়ে কাজ করেছে হাসপাতালগুলো। আর এখন টাকা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে কাজে আসছে না। সব মিলিয়ে মানুষের অমানবিক প্রচ্ছন্ন দিকটি প্রকট আকার ধারণ করেছে করোনাকালে।
পি
মন্তব্য করুন