উহুদের যুদ্ধের শিক্ষা যেন ভুলে না যাই। মুসলমানদের প্রাথমিক বিজয় কীভাবে হাতছাড়া হয়ে পরাজয় সে বিজয়কে গ্রাস করে। প্রতিরক্ষা ব্যূহ ছেড়ে বিজয় উদযাপনে মনোযোগী হয়ে পড়ায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। প্রাথমিক জয়ে প্রতিরক্ষা অরক্ষিত রেখে বিজয়ের আনন্দ উদযাপন, গনিমতের মাল বণ্টনে মশগুল হওয়ায় চরম মূল্য দিতে হয়েছিল মুজাহিদদের। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় অভ্যুত্থানের পর প্রতি অভ্যুত্থান মোকাবিলায় সজাগ ও সরব থাকতেই হবে, নচেৎ বিপদের আশঙ্কা। দল ও গোষ্ঠীর কৃতিত্ব নিতে সম্মিলিত মহৎ আন্দোলনকে পাশ কাটানো কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। ভারহীন কথা সমাজমাধ্যমে বলে নিজের প্রচারে নিজের দক্ষতা জাহির করতে গিয়ে জাতীয় ঐক্য নিয়ে দলীয় গন্ধ ছড়ানো অনুচিত। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো অর্বাচীনের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে। টাউট শ্রেণির লোক মতলববাজ দলীয় উচ্ছিষ্টভোগীরা ছাত্র-জনতার আন্দোলন কাউকে খুশি করতে তাকে রূপকার, সুরকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, মাস্টার মাইন্ড ইত্যাদি বিশেষণ বলে তোয়াজ করছে, তেল মারছে শ্রুতি কটুভাবে নিজের ফায়দা লুটতে।
বীরত্বের খেতাব কাড়াকাড়ির সময় এখন না। পিচ্ছিল সরু বিপৎসংকুল পথ দিয়ে চলছে দেশ। আন্দোলনে আহতরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। সব নাগরিক এখনো স্বস্তি খুঁজে পায়নি। হয়তো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিশ্চয়ই কোনো পাকা মস্তিষ্কের দীর্ঘদিনের প্রতিকূল পরিবেশে বৈরী পরিস্থিতিতে আন্দোলনের অভিজ্ঞ নেতার মেধা কাজ করতে পারে যা তিনি আঁচ করতে দেননি। সেই মেধা জাতীয় সম্মিলিত আন্দোলনের ধারায় একাকার হয়ে এক স্রোতে স্বৈরাচার ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু তা এখন বলারও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। শেখ হাসিনা জনগণের ধাওয়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন মাত্র। সমালোচকরা বলেন, তার অপমানের যন্ত্রণা সহ্য করার মতো পরিপক্বতা, ধৈর্য কোনোটা নেই। মাতা-পুত্র নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য নবীনদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপচারিতা করে বুকের ব্যথা বুকেই লুকিয়ে ক্ষমতা হারানোর বেদনা লাঘব করার চেষ্টা করছেন। বলছেন যেভাবে পদত্যাগ করতে হয় সেভাবে তিনি করেননি। টুস করে দেশে আসবেন। কথাটা সমালোচকদের বিনোদন জোগাচ্ছে। সাধারণ মানুষ, যারা কোনো দল-মতের না, তারাই সংখ্যায় বেশি। তারাই রাজপথ দখল করেছিল, ছাত্রদের সঙ্গে রক্ত দিয়েছে বেশি তারাই। ছাত্র-জনতা আমাদের দিয়েছে নতুন ভাবনার জগৎ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে গত বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন নিয়ে বেপরোয়া মতলববাজরা নির্লজ্জ চামচামির রেকর্ড বাজাচ্ছে। পতিত সরকারের মিডিয়া ফ্যাক্টরি ভোল পাল্টিয়ে নতুন সুরে আওয়াজ তুলছে। মতলববাজরা উঁচু গলায় নতুন সাজে জাতীয়তাবাদী হচ্ছে। এবারের আন্দোলনের লক্ষণীয় ছিল রাজনৈতিক পরিচয় কেউ দেয়নি, রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম ছিল না। এ অরাজনৈতিক আন্দোলনে কোথাও কোথাও রাজনৈতিক লোকজন কুলচিহ্নবাহী পতাকা ছাড়া, ঘোষণা ছাড়া, স্লোগান ছাড়া নীরবে ঢুকে পড়ছেন নির্দলীয় হয়ে আন্দোলনকে বেগবান করতে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না করে। সবাই এক হয়ে লড়াই করেছে সরকার পতনের আখেরি রূপ দিতে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দারুণ এক বিস্ময়। বাংলাদেশের ৫ আগস্ট আন্দোলন নতুন অভিনব মডেল। একদিকে যেমন কেউ নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়দানে উৎসাহ দেখাননি, অন্যদিকে যোগদানকারীদের বেশির ভাগই সচেতনভাবে রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে চেয়েছেন জাতিকে অরাজনৈতিক এক মঞ্চে ধরে রাখতে। রাজনৈতিক দলগুলো এ গণ আন্দোলনে নিজেদের ভূমিকা গোপন রেখেছে বলে মনে হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে সব রাজনৈতিক দল মিছিল নিয়ে মাঠে নামে।
মনে থাকার কথা পতিত সরকার ক্ষমতায় বসেই জামায়াত নিধন অভিযান চালায়। ফাঁসি জেল মামলার শিকলে বাঁধা সব নেতা। বিএনপি ১৮ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে রক্ত ঝরিয়ে, জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, হিজরত করে, জেল জুলুম খুন গুমের অভিশাপে পর্যুদস্ত ক্লান্ত। কর্মীদের বিলুপ্ত করতে গায়েবি মামলা-হামলা খুন গুম চলেছে। দানবীয় সরকার আর জাহেলি প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শক্তি যখন ক্ষয়িষ্ণু প্রায়, তখনই সাধারণ ছাত্ররা রাজপথ কাঁপাতে শুরু করল। বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ সফল করে তাদের শক্তি প্রদর্শন করে। চূড়ান্ত সমাবেশ ঢাকায়ও সফল হয়েছে। পুলিশ গোলাগুলির নাটক মঞ্চস্থ করে সব নেতা-নেত্রীকে জেলে ঢোকানোর অজুহাত বের করল।
এ আন্দোলন রাজনৈতিক পরিচয়হীন শুধু নির্দলীয় ছাত্র দিয়ে শুরু। ছাত্র আন্দোলনকে দলীয়করণ করার চেষ্টা করলে জাতীয় ঐক্য দুর্বল হবে। দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে পুঁজি করে কেউ দলীয় আন্দোলন আখ্যা দিয়ে আবার দুর্নীতি চর্চা করলে তাদের ছাত্র-নাগরিক প্রতিহত করবে। জাতির নীতি হবে এখন ৫ আগস্ট ও এর আগে যে গণহত্যা, জুলুম অত্যাচারের শিকার দেশের মানুষ হয়েছে, এর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নৈরাজ্য, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজির রাজনীতির ইতি টানতে হবে। সারা দেশে লুটপাট, সহিংসতা যারা করেছেন তাদের এখনই ইনসাফ, ন্যায়ের পথে ফেরাতে হবে। অনেকের সঙ্গে চরম অন্যায় করা হয়েছে। অন্যায়কারীদের দেশের আইনে অবশ্যই বিচার করতে হবে।
হাসিনার পলায়নকাণ্ডের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ঘটেচলা নানা উলটপালট দেখে পুরনো প্রবচনটি মনে পড়ে। গত চার দশকে রাজনৈতিক কর্মীদের দাপুটে হাবভাবের সমাজচিত্রের প্রেক্ষিতে মানুষের ধারণা হয়েছিল—এখানে সব আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি বা বাম-ডান দলের কর্মী সমর্থক থাকলেও বুঝি ‘মানুষ’ নেই। তারা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছিলেন—এসবের বাইরে স্রেফ ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে চাইলে, মানুষের মতো উচিত কথা বললে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়, হেনস্তা হতে হয়। কন্যাকে স্কুল-কলেজে পাঠাতে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হয়। আবার প্রমাণ হলো পচা রাজনীতির খোলসের আড়ালেও আদতে প্রচুর আদর্শিক অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক ‘মানুষ’ ছিলেন। এতদিন যারা ভয়ে ও অনিশ্চয়তায় খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার সাহস পাচ্ছিলেন না। সব ভীতি প্রলোভনের ঊর্ধ্বে ওঠে ভয়কে জয় করে তারাই রাত জেগে শাহবাগ, রাজপথ দখল করেছেন, মিছিল করেছেন, দীর্ঘ মানবশৃঙ্খল গড়েছেন, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাঁটতে হাঁটতে আওয়াজ তুলেছেন পেছনে ফিরে যাওয়ার সব পথ বন্ধ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকসহ ছাত্রদের ন্যায্য দাবির ডাকে বাংলাদেশ তো বটেই, মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকা ইউরোপ পাকিস্তান ও ভারতের নানা রাজ্যে, পৃথিবীর নানা দেশে বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে যে অগণিত মানুষ রাত ও রাজপথের দখল নিতে নেমে পড়েছিলেন, তার তুল্য স্বতঃস্ফূর্ততা কবে বিশ্ব দেখেছে বলা শক্ত। তার চেয়েও বড় কথা, এ গণ আন্দোলন যে উৎসাহ ও প্রেরণার জন্ম দিয়েছে তার সুদূরপ্রসারী অভিঘাত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতি মরিয়া হয়ে আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য চালিকাশক্তি দেখে সেনাবাহিনীও দেশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। কোনো নীলনকশা শেষ রক্ষা করতে পারেনি। দল গোষ্ঠীর বাহাদুরি সংকীর্ণ বিবেচনা না করে স্বাধীনতাকামী জনতার বাহাদুরির ইতিহাস এ আন্দোলন। আমজনতা তাদের নিজ বিবেকের তাড়নায় ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
তাদের একটাই স্বর, এক দাবি ছিল হাসিনা কবে যাবি! এক দফা শেখ হাসিনার পতন। সোজা আঙুলে ঘি না ওঠায় ছাত্র-জনতা ঢাকার চতুর্দিক থেকে গণভবনের দিকে অগ্রসর হয় হাসিনাকে হটাতে। অবস্থা বেগতিক দেখে বোনকে নিয়ে পালান শেখ হাসিনা। এখানে কোনো রাজনীতির ব্যানারে আন্দোলনের আলামত ছিল না। অবাক করা ঘটনা, দিনের পর দিন যে গণ আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছিল, সেগুলো এতই স্বতঃস্ফূর্ত যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেউ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর অপেক্ষা করেনি, নির্দেশনা আশা করেনি। প্রাথমিকভাবে ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবিতে পথে নামে। তাদের ওপর জুলুম অত্যাচার নির্যাতনের বুলডোজার চালিয়েও দমাতে পারেনি। নির্দলীয় প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিসর আমজনতার প্রতিবাদী মিছিল শামিল হওয়ার ও প্রতিবাদী-সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যায়। সাধারণ নাগরিকরা তো ছিলেনই, একই সঙ্গে পেশাজীবী শিক্ষক, অভিনেতা, কবি, সংগীতশিল্পী, আইনজীবী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, যৌনকর্মী, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ, রিকশাচালক, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দেখা গেছে প্রতিবাদে শামিল হতে! দিন যত এগোচ্ছিল, আন্দোলনের আগুনের তেজ ততই বাড়ছিল। ঢাকা শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল দেশের প্রান্তিক শহরে। ছাত্র-জনতা হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শহীদ হয়েছে। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর আর কোনো ছাত্র পেছাল না, শুধু জীবন দিতে উদগ্রীব হলো, দেশের মানুষকে জীবন দিয়ে মুক্ত করে গেল। এখানে রাজনৈতিক দলের কোনো গন্ধ নেই।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন যে আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল, তার বেশির ভাগই আহ্বান করছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন ছাত্র ও মানুষেরা, যাদের কথা অতীতে সেভাবে শোনা যায়নি। এমনকি তাদের অধিকাংশেরই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে উজ্জ্বল অংশগ্রহণের পূর্ব ইতিহাস নেই। ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের স্রোতের তোড়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে সরকার। যে কোনো মূল্যে জাতীয় সংহতি বজায় রাখতে হবে। দেশ বাঁচাতে আন্দোলনের সফলতা ক্ষুদ্র কর্তা হওয়ার যে আনন্দ, তার চেয়ে বেশি মহিমা দেশের সব মানুষের আন্দোলনের ফসল আজকের মুক্ত দেশ এটা প্রচার করা। আসুন দেশ গড়ি, দেশের ভালোমন্দের আপনি আমি সবাই অংশীদার, সবাইকে সম্পৃক্ত করি দেশের কাজে।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক
আরটিভি/এআর