• ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
logo

কালের বিবর্তনে দুর্গাপূজা : মিথ ও ইতিহাস

প্রশান্ত অধিকারী

  ২১ অক্টোবর ২০২০, ২০:৫০
Durga Puja in the evolution of time: myth and history
ভারতে মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারণা অতি প্রাচীন

দুর্গাপূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের। ভারতে মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারণা অতি প্রাচীন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ২২ হাজার বছর আগে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকে দেবী পূজার প্রচলন শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত রূপ লাভ করে।

বর্তমানে দুর্গাপূজা ভারতের আসাম, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে উদযাপন করা হয়। সেখানে পাঁচদিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় সবচেয়ে বড় সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে পালিত হয়। বর্তমানে পূর্ব ভারতের কলকাতা, হুগলি, শিলিগুড়ি, কুচবিহার, লতাগুড়ি, বাহারাপুর, জলপাইগুড়ি এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল যেমন- আসাম, বিহার, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাট, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালায় ঘটা করে এই উৎসব পালন করা হয়। নেপাল ও ভুটানে স্থানীয় রীতি-নীতি অনুসারে প্রধান উৎসব হিসেবে পালন করা হয়।
বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বগুরা এবং অন্যান্য জেলায়ও ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করা হয়। বিদেশে যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ফিজি, টোবাকো, কুয়েত, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হিন্দুরা বা বাঙালি হিন্দুদের নানা সংগঠন এই উৎসব পালন করে থাকে। বাংলা ভূখণ্ডে এই পূজাকে শারদীয় পূজা, শারদোৎসব এবং বসন্তকালে বাসন্তীপূজা বলা হয়। তবে বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, কেরালা, হিমাচল প্রদেশ, মহীশুর, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশে এ পূজাকে নবরাত্রি পূজা বলা হয়।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, দুর্গাপূজার প্রথম প্রবর্তক কৃষ্ণ, দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার দুর্গাপূজার আয়োজন করেন মহাদেব। আবার দেবী ভাগবত পুরান থেকে জানা যায়, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন। যদিও মূল বাল্মীকির রামায়ণে দুর্গাপূজার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব আছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ, গল্প বাংলা রামায়ণে তুলে ধরেন।

তাঁর এই অনুবাদকৃত রামায়ণ পরিচিতি পায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে, যা বাংলাভাষী হিন্দু সমাজে বেশ জনপ্রিয়। সেখানে তিনি কালিকাপুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দুর্গাপূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন।

সনাতন ধর্মের আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন। মার্কাণ্ডেয় পুরান মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কলিঙ্গে [বর্তমানে ওড়িষ্যা] দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দুর্গার, যা সংস্কারের ফলে মূল চেহারা হারিয়েছে। একাদশ ও দ্বাদশ শতক থেকে এখানে কালীপূজার সঙ্গে দুর্গাপূজাও হতো। ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালীপূজার সঙ্গে দুর্গাপূজা হতো।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দুর্গাপূজা করেন। আবার কারও মতে, ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দুর্গা পূজার প্রবর্তন করেন। আবার কেউ বলেন, ১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার দুর্গার ছেলে মেয়েসহ সপরিবারে পূজা চালু করেন।

১৭১১ সালে অহম রাজ্যের রাজধানী রংপুরে শারদীয় দুর্গাপূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার। পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃঞ্চদেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে দুর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন।
পাটনাতে ১৮০৯ সালের দুর্গাপূজার ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া যায়। ঊড়িষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। কাসিমবাজারের রাজা হরিনাথ ১৮৩২ সালে বারোয়ারি এই পূজা কলকাতায় পরিচিত করান। পরে তাদের দেখাদেখি আস্তে আস্তে তা উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালি জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্ভবত সেই থেকে বারোয়ারী পূজা শুরু।

১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোস জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে পূজা উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও দুর্গাপূজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল [যেমন- কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা, বঙ্কিচন্দ্রের ‘বন্দে মা তরম’ কবিতা, পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে ভারতের জাতীয় সংগীত]। ব্রিটিশ বাংলায় এই পূজা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারি বা কমিউনিটি পূজা হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বাংলার দুর্গাপূজার ইতিহাস বলতে গিয়ে অনেকে বাংলাদেশের রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের কথা উল্লেখ করেন। তিনি প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন বলে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ তাদের বইতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষলগ্নে, সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনায়। তারও পূর্বেকার সাহিত্যে ও অন্যান্য গ্রন্থে বাংলায় দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করে কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেন বলে মানুষের ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। বদলে গিয়েছিল দুর্গাপূজার সংজ্ঞা। আর সেই থেকেই কংসনারায়ণী মিথের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়।

বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা। দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরী-মল্ল রাজবংশের কুলদেবী। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন। এখানকার পূজা পদ্ধতি বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজার থেকে অনেকটাই আলাদা; কিছুটা আলাদা এখানকার দুর্গাপ্রতিমার গড়নও। মৃন্ময়ী দেবী সপরিবারা বটে, কিন্তু লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতী এখানে স্থানবদল করে থাকে। অর্থাৎ লক্ষ্মীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে লক্ষ্মী এবং কার্তিকের স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক। এই রূপে দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের রীতিকে জগৎমল্ল-প্রথা বলা হয়। বাঁকুড়া জেলার অনেক প্রাচীন পরিবারেও জগৎমল্ল-প্রথায় নির্মিত দুর্গামূর্তি পূজিত হয়। মল্ল রাজবাড়ির পূজায় দেবী পটের যে ব্যবহার দেখা যায়, তা অনেকটাই স্বতন্ত্র। বাংলার সাধারণ দুর্গাপূজায় এমন পটের ব্যবহার দেখা যায় না। এই পূজাও কংসনারায়ণ প্রবর্তিত পূজার অনেক আগে প্রচলন লাভ করে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন। সেও কংসনারায়ণের বহু আগে।

প্রাচীন দুর্গাপূজার এত নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও কীভাবে কংসনারায়ণী মিথের উদ্ভব হলো? এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের বিকল্প হিসেবে। সে যুগের বাজারে দুর্গাপূজা করতে তিনি খরচ করেছিলেন আট লাখ টাকা। বাংলার প্রাচীন জমিদারবাড়ির দুর্গাপূজাগুলোও সব কংসনারায়ণের পূজার পরপরই প্রবর্তিত হয় এবং কংসনারায়ণ-প্রদর্শিত পথে সাড়ম্বরে পালিত হতে থাকে। নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার, কোচবিহার রাজবাড়ি সর্বত্রই ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতেই দুর্গোৎসবের সূচনা। খুব সম্ভবত তখন থেকেই দুর্গাপূজার শাস্ত্রীয় রূপটি ছাপিয়ে আড়ম্বরের চাকচিক্যটাই বড়ো হয়ে ধরা দেয় মানুষের মনে।

তথ্যসূত্র
১. পূজাবিজ্ঞান, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
২. হিন্দুদের দেবদেবী, তৃতীয় খণ্ড, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা।
৩. মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা।
৪. পুরোহিত দর্পণ, সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, সত্যনারায়ণ লাইব্রেরি, কলকাতা।
৫. পূজা-পার্বণ, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা।
৬. সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস, ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা।
৭. Durga Puja : Yesterday, Today & Tomorrow, Sudeshna Banerjee, Rupa & Co.,New Delhi.

মন্তব্য করুন

daraz
  • মুক্তমত এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh