জন্ম শতবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি
মোহিনীমোহন চৌধুরী: বাংলা সংগীতের এক অনন্য গীতিকার
‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কতো প্রাণ হলো বলি দান, লেখা আছে অশ্রুজলে’ জনপ্রিয় এই গানটির গীতিকার মোহিনীমোহন চৌধুরীর আজ শততম জন্মবার্ষিকী। মোহিনীমোহন চৌধুরীর জন্ম ১৯২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ (সাবেক ফরিদপুর) জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার ডহরপাড়া গ্রামে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে মোহিনীর অবস্থান তৃতীয়। লেখাপড়ার হাতেখড়ি গ্রামের বাড়িতেই। বাবা মতিলাল চৌধুরী কলকাতায় চাকরি করতেন। তাই তাকেও কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয় পড়ালেখার জন্য। মতিলাল কলকাতায় বিভিন্ন অঞ্চলে ভাড়া-বাড়িতে থাকতেন বলে মোহিনীকে প্রবেশিকা পর্যন্ত তিনটি স্কুল বদলাতে হয়। প্রথমে পঞ্চানন ইন্সটিটিউশন, পরে সরস্বতী ইন্সটিটিউশন ও সবশেষে রিপন কলেজিয়েট স্কুল। রিপন কলেজিয়েট স্কুল থেকে স্টার-নম্বর পেয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মোহিনীমোহন চৌধুরী।
রিপন কলেজ থেকেই প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করেন। কিন্তু ভালো ফল করা সত্ত্বেও সাংসারিক কারণে লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে।প্রবেশ করতে হয় চাকরিতে। এরপর দীর্ঘ সতেরো পর প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। রিপন কলেজে মোহিনীর সহপাঠী ছিলেন সলিল চৌধুরী।
মোহিনী চৌধুরী একবার গান লিখে খাতা জমা দিয়ে এলেন এইচএমবি অফিসে। মাঝে মধ্যেই খবর নিতেন এইচএমবি অফিসে। কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে জিপিওতে চাকরিতে যোগদান করেন। এইচএমবির কর্তা হেমচন্দ্র সোম একদিন অফিসের আলমিরা পরিষ্কার করতে গিয়ে অনেক কাগজপত্রের মধ্যে একটি খাতা আবিষ্কার করেন। খাতার উপরে লেখা ‘গুঞ্জন’। লেখকের নাম মোহিনী চৌধুরী। খাতাটা খুলে হেমবাবু পড়তে পড়তে চমকে উঠলেন। ‘রাজকুমারী ওলো নয়নপাতা খোল, সোনার টিয়া ডাকছে গাছে ওই বুঝি ভোর হল’। দেখার পরই এই গানটি সুর করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন বিখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্তের কাছে। তার সুরে গানটি রেকর্ড করা হলো। গাইলেন শিল্পী কুসুম গোস্বামী। ১৯৪৩ সালে রেকর্ড হলো তার অজান্তেই। কিন্তু কোনো কারণে এই গানের রেকর্ড রিলিজে বিলম্ব হলো। সেই ফাঁকে ‘পারিজাতের বনে চলো ইন্দ্রধনুর দেশে’মোহিনী চৌধুরীর লেখা এই গানটির রেকর্ড বেরিয়ে গেল – সুরকার পাঁচু বসু ও শিল্পী কুমারী অণিমা ঘোষের কণ্ঠে কলম্বিয়া থেকে। গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর প্রথম রেকর্ড হিসেবে চিহ্নিত আগস্ট ১৯৪৩-এ কলম্বিয়া থেকে প্রকাশিত এই রেকর্ডটি।
১৯৪৪ সালে কমল দাশগুপ্তের সুরে মোহিনী চৌধুরীর লেখা গান গাইলেন জগন্ময় মিত্র, ‘ভুলি নাই ভুলি নাই, নয়ন তোমায় হারায়েছি প্রিয়া স্বপনে তোমারে পাই।’ জগন্ময় মিত্র-কমল দাশগুপ্ত জুটি সঙ্গে মোহিনীবাবুর কথা। দারুণ জনপ্রিয় হলো। এরপর গীতিকার মোহিনী চৌধুরীকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে’, ‘হায় কি যে করি এ মন নিয়া’, ‘ভুলি নাই – ভুলি নাই – নয়নে তোমারে হারায়েছি প্রিয়া’, ‘কে আমারে আজো পিছু ডাকে’, ‘ভুলায়ে আমায় দু’দিন শেষে কি হায় ভুলবে’, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলি দান’, ‘পৃথিবী আমারে চায় রেখো না বেঁধে আমায়’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড় তুমি যে বহ্নিশিখা’, ‘শতেক বরষ পরে – তুমি আর আমি ফিরে আসি যেন’, ‘যাদের জীবনভরা শুধু আঁখিজল’, ‘সেই যে দিনগুলি বাঁশী বাজানোর দিনগুলি’প্রভৃতি সোনাঝরা গান লিখেছেন প্রতিভাবান এই গীতিকার।
মোহিনী চৌধুরী গ্রামোফোন, চলচ্চিত্র, রেডিও– সব জায়গাতেই সম্মান ও প্রতাপের সঙ্গে কাজ করেছেন। গ্রামোফোনে গীতিকার হিসেবে প্রবেশ সম্ভব হয় এইচএমভির কর্তা হেমচন্দ্র সোমের সুবাদে। চলচ্চিত্রে সুযোগ পান শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও রেডিওতে শচীনদেব বর্মণের সৌজন্যে।
কোটালিপাড়ার রতাল গ্রামের সুরেশচন্দ্র কাব্যতীর্থের প্রথম কন্যা লীলার সঙ্গে ১৯৪৪ সালের ১২ জুলাই বিয়ে হয় মোহিনী চৌধুরীর। কলকাতার বেহালায় পৈতৃক ভবনেই মোহিনী-লীলার দাম্পত্যজীবনের সূচনা ও বিস্তার। লীলা ছিলেন সুন্দরী ও বিদূষী, সেইসঙ্গে সুগৃহিণীও। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন – গানের কণ্ঠও ছিল চমৎকার। সুখে-দুঃখে, শোকে-আনন্দে সারাজীবন স্বামীর পাশে ছিলেন।
প্রথম পর্যায়ে প্রেম-ভালোবাসা-বিরহ-বিষাদের গানই বেশি লিখেছিলেন মোহিনী চৌধুরী। সেসব গান জনপ্রিয়ও হয়েছিল। গীতিকার হিসেবে মোহিনীর সৌভাগ্য, তিনি শচীন দেববর্মণ, সত্য চৌধুরী, জগন্ময় মিত্র, যুথিকা রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য, সন্তোষ সেনগুপ্ত, রামকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমার, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তালাত মাহমুদ, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, গায়ত্রী বসু, ফিরোজা বেগম, জপমালা ঘোষ, নির্মলা মিশ্রের মতো শিল্পীকে পেয়েছিলেন। গীতা দত্ত, উৎপলা সেন, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র ও তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম রেকর্ড বের হয় মোহিনীর চৌধুরীর গানে।
মোহিনীর লেখা গানে সুরসৃষ্টি করেছেন সেকালের অসামান্য মেধাবী সব সুরকার। তাদের মধ্যে কমল দাশগুপ্ত, কৃষ্ণচন্দ্র দে, শচীন দেববর্মণ, শৈলেশ দত্ত গুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, কালীপদ সেন, গিরীণ চক্রবর্তী, দুর্গা সেন, সুধীরলাল চক্রবর্তী, নিতাই ঘটক, নরেশ ভট্টাচার্য, সুধীন দাশগুপ্ত, গোপেন মল্লিক, সন্তোষ মুখোপাধ্যায়, চিত্ত রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য। তবে মোহিনীর গানে সবচেয়ে বেশি সুরযোজনা করেছেন কমল দাশগুপ্ত।
ব্রিটিশদের নির্মম শাসণ-শোষণ, বিশ্বযুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিপ্লববাদ, সামাজিক সংকট, মানবিক অবক্ষয়, আকাল, দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশত্যাগ, উদ্বাস্তু-সমস্যা – এসব ঘটনা মোহিনী চৌধুরীকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। একসময় তিনি বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন – যুক্ত হন গণনাট্য সংঘ ও গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সঙ্গে।
১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে সেই কোপ পড়ে গণনাট্য সংঘের ওপরেও। তখন দলের সম্মতি ও সহায়তায় কলকাতার বেহালা অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা পায় ‘প্রগতি কৃষ্টি পরিষদ’। মোহিনী এই নতুন সংগঠনেও জড়িত হন এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। গভীর সমাজবীক্ষণ, অর্জিত বিশ্বাস ও প্রগতিপন্থি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তার শিল্পচেতনাকে নতুন মাত্রা দেয়। তার গান হয়ে ওঠে প্রচলিত বলয়মুক্ত এক নবজীবনের নতুন নির্মাণ। ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলি দান’ এখনো যে কোনো শহীদ স্মরণে অমর সংগীত হয়ে আছে। এছাড়াও তার লেখা গণসংগীত এখনো গণসংগ্রামে প্রেরণা যোগায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি গান লিখেছিলেন।
জনপ্রিয় গীতিকার হলেও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন না কখনোই।জিপিওতে চাকরির সময় একটু স্বচ্ছল থাকলেও সৃজনশীল কাজে ব্যাঘাত ঘটছিল। একসময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে সিনেমাতে গান লেখা ও সিনেমার সহকারী পরিচালক থেকে নিজে পরিচালক হয়ে ‘সাধনা’ নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল না হওয়ায়, নিজের যা সঞ্চয় ছিল সব খোয়ান। শুধু তাই নয়, ধার দেনায় ডুবে গিয়ে বাধ্য হয়ে আবার চাকরিতে ফেরেন। এবারের চাকরি বিজ্ঞানী ও সাংসদ মেঘনাধ সাহার সংসদীয় সচিব হিসেবে। কিন্তু এ চাকরির জন্য তাকে থাকতে হয় দিল্লীতে। স্মৃতির শহর, সংস্কৃতির শহর কলকাতা থেকে দূরে থাকতে তার ভালো লাগেনি। তাই একদিন চাকরি ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়।
এবার মোহিনী চৌধুরী তাদের আত্মীয় কলকাতার খ্যাতিমান শিল্পপতি (কোটালিপাড়ার জমিদারপুত্র) দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের একান্ত সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেবেন্দ্রনাথ কলকাতায় ছোট-বড়ো অনেকগুলো কলকারখানা, ব্যাংক-বীমা, কটনমিলের সত্ত্বাধিকারী ও মুখ্য-নিয়ন্ত্রক ছিলেন। বিখ্যাত বঙ্গলক্ষ্মী কটনমিল ছিল তারই শিল্প-প্রতিষ্ঠান। নানা কারণে দেবেন্দ্রনাথের ভাগ্য-বিপর্যয় ঘটে। ফলে ১৯৭১ সালে মোহিনীকেও চাকরি হারাতে হয়। আবার শুরু করেন গান নিয়ে নতুন জীবন। আজীবন সংগ্রামী মানুষটি ১৯৮৭ সালে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ চলচ্চিত্রে শেষ গান রচনা করেন। সেই ছবির জন্য নিজের দুটি গান রেকর্ডিংয়ের সময় সারাদিন স্টুডিওতে ছিলেন। বাড়ি ফিরে গান-ধারণের গল্প শোনান স্ত্রীকে। ১৯৮৭ সালের ২১ মে রাতেই অকস্মাৎ তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। এই মহান গীতিকার জনগণের ভালোবাসা ছাড়া কোনো পুরস্কার পাননি। জন্মশতবার্ষিকীতে মহান এই শিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সংস্কৃতিজন, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উদীচী।
পি
মন্তব্য করুন