মায়ার জীবন
জীবন। কখনো বাবুই পাখির বাসা। তালপাতার সেপাই। শখের বুনন। স্নিগ্ধ আলো বাতাসে বাসাটি কতই না মায়াবী। দক্ষ লেখকের হাতের শব্দ গাথুনীতে তৈরি হয় এক অভিজাত শিল্প। ভাবনাটাও হয়ে ওঠে দারূন শৈল্পিক।
বিপরীতও আছে। একটু ঝড় এলেই আদুরে এই বাবুই পাখির বাসাটি উড়ে যেতে পারে। সকালের সোনারোদের আভায় দেখা মায়ামি বাসাটি সন্ধ্যার ঝড়ে বিপর্যস্ত। হঠাৎ এমনও হয়, বাবুই পাখিও নেই। এমনকি পাখির বাসাটিও। কিংবা কোনো মতে ঝুলে আছে তালপাতার আড়ালে। আমরা ইচ্ছে করলেও উপরে উঠে কিছু করতে পারি না। বলি, আহ কি হবে বাবুই পাখির! পেছনে তো একজন ঠিকই দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন। আমাদের চোখ হয়তো ওই পর্যন্ত পৌছাতে পারে না বলে, পাশের গাছে শক্ত করে বাধা বাসায় বাবুই পাখির মুখটা দেখতে পাইনি।
আমাদের জীবনটাও বাবুই পাখির মতোই। আমার দুই সন্তান প্রিয়ন্তি ও আহলান জন্মের পর যখন থেকে কথা বলতে শেখে তখন থেকেই আমাকে বাবুই বলে ডাকে। ওরা বড় হচ্ছে কিন্তু মুখ থেকে বাবুই ডাক সরছে না। এ এক অন্যরম ভালোবাসা হয়তো ওদের অবুঝ মনে। আমি বলি, সবাই তো তোমাদের এই কোমল ভালোবাসার ডাক নাও বুঝতে পারে। ওরা বলে বাবা বাবুই। ওদের কোমল মনে বাবুই নামটা গেথে আছে। কিন্তু বাবুই পাখির কষ্টটা ওরা দেখতে পায় না। হয়তো বাস্তবতার উচুনীচু সিড়িতে যখন পা পড়বে তখন সময় তাদের সেটা বলে দেবে।
আমার কাছে কিন্তু মানুষের জীবনটাকে ওই বাবুই পাখির জীবনই মনে হয়। উদ্বাস্তু। জীবন। আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখি যতনে আহলাদে। কিন্তু কখন কোন আউলা বাতাসে সব অদৃশ্য হয়ে যায়।
জগতের সব সৃষ্টির মধ্যে মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের বোধবিবেচনা দিয়েছেন। নিখুঁত নিপুণভাবে তৈরি করা একটি সুন্দর জীবন দিয়েছেন।
পায়ের নখ থেকে মাথার চুল- শুধু মানব দেহের অঙ্গ প্রতঙ্গ বিশ্লেষণ করলেই অনেক সময় পেরিয়ে যাবে। হিসাব মেলানো যাবে না। জীবনের ভেতরে এতো জীবন। কতো শত সহস্র ফাংশনাল জয়েন্ট। একটা যন্ত্র আরেকটিকে সুরক্ষা দিয়ে রাখছে। আর এতে যদি সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটে ভেতরে বড় ধরনের নড়াচড়া শুরু হয়। আমরা টের পাই। শত সহস্ত্র ফাংশনের মধ্যে একটি ইন-এ্যাকটিভ হয়ে পড়লে সর্বনাশ। মরণ এসে মূহুর্ত্তের মধ্যে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। হচ্ছেও তাই। আবার একই আদলের সমস্যায় পড়েও কেউ বা সেড়ে উঠেছেন। সকালের স্নিগ্ধ আলো চোখেমুখে মেখে বলছেন, জীবন অনেক সুন্দর।
মনে পড়ে হূমায়ুন আহমেদ মৃত্যুর আগে এই সুন্দর জীবনের আলোবাতাসে আরো কিছুদিন বাচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিয়তি এখানে জীবনের মেয়াদকাল লিমিট করে দিয়েছেন যে। কি করার আছে? আমাদের হাতে কিছু নেই। সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ একজনের হাতে। জীবন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠোনোর সময় মৃত্যূর সময়টাও লিখে দিয়েছেন। এই সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে সাথে বোনাস একটি বার্তাও জীবনের জন্য রয়েছে বলে মনে হয়। ভালো কাজ। ভালো চিন্তা মানুষের জীবনের মেয়াদ বাড়াতে সহায়তা করে। মহান সৃষ্টিকর্তা কাকে দিয়ে কোন কাজটি করাবেন তিনি ভালো জানেন। সে কারনে কার ওপর খুশি হবেন বা নাখোস তার ইচ্ছে। আমরা শুধু দেখি একই ধরনের অসুখে পড়ে একজন চলে যাচ্ছেন। আবার একজন বেচে গেলেন। কোনো সিম্পটম ছাড়াও কেউ হঠাৎই চলে যাচ্ছেন।
দেশে করোনা প্রকোপ দেখা দেখা দিলেও আমরা ঘরে বসে থাকতে পারিনি। পেশাগত প্রয়োজনেই অফিস করতে হয়। আর প্রয়োজনে অন্যত্র মুভও করতে হয়। চেষ্টা করেছি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে। এই সাবধানতা আর সচেতনতা নিয়ে আমি নিজে গানও লিখেছি। তারপরও নিজের অসাবধানতা বা অন্য কারো ভুলে কোথা থেকে এই অসুখ আমায় ধরে জানি না। মহান সৃষ্টিকর্তা ভালো জানেন। এটা একটা পরীক্ষাও হতে পারে।
কোভিড আক্রান্ত না হলে আমি নিজেও হয়তো জীবনের এই অর্থটা অনুধাবন করতে পারতাম না সেভাবে। বারো দিন ধরে কোভিডের সাথে লড়ছি। এখনো বেচে আছি। আর দুইদিন পর সেম্পল নেয়া হবে। ৮ আগস্ট ১০৪ ডিগ্রী জ্বর ওঠার পর পরিস্থিতি অবনতির দিকেই যাচ্ছিল। অক্সিজেন লেভেল নীচে নেমে যায়। এ পর্যায়ে চিকিৎসা. মানসিক শক্তি.আর মহান রবের প্রতি আস্থা- আমার সম্বল। অসুস্থ হবার এ খবরটি আমি সবাইকে সেভাবে জানাইনি। ভালোবাসার মানুষগুলো এমনিতেই নানা প্যারেশানিতে আছেন। অনেকেই দু:খের সমুদ্রে আছেন। আমরা আর কতজনের খবরাখবর ই বা জানি। ফলে কাউকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রাখতে চাইনি। তা ছাড়া আমার কথা বলাও বলা চলে এ কয়দিন বারন।
লেখক-মিজান মালিক, এডিটর, ইনভেস্টিগেশন
দৈনিক যুগান্তর
মন্তব্য করুন