• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

‘আশুরা’ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেতনা

মাজহার খন্দকার

  ১২ অক্টোবর ২০১৬, ১৩:০৪

হিজরী ৬০ সালে ইয়াজিদের ক্ষমতা নেয়ার পরেই মুসলিম সাম্রাজ্যের নানা জায়গায় মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বেড়ে যায়। ইয়াজিদ তার বাইয়াত গ্রহণ করতে গোত্রপ্রধান ও সমাজপতিদের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে। অর্থ ও ক্ষমতার লোভে অনেকেই তার বাইয়াত গ্রহণ করলেও ইমাম হুসাইনের (রা.) অনুসারীরা তা অস্বীকার করেন।

ইয়াজিদের অত্যাচার নির্যাতনের নানা অভিযোগ আসতে থাকে ইমামের দরবারে। বিশেষ করে কুফাবাসী ইয়াজিদের পাপাচার ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে ইমামের সহায়তা চেয়ে অন্তত ১৮শ’ চিঠি লেখে। সবগুলো চিঠিতে ১শ’ মানুষের সই ছিল। ইমাম রাসুলের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য কুফাবাসীর পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

হিজরী ৬০ সালের রজব মাসের ২৮ তারিখ। ইমাম হুসাইন (রা.) তার স্বজন-পরিজনদের সঙ্গে নিয়ে মক্কার উদ্দেশে পাড়ি জমালেন। যাবারকালে তিনি তার ভাই মুহাম্মাদ ইবনে হানিফাকে একটি অসিয়্যতনামা লিখলেন। ঐ অসিয়্যতনামায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং তার রাসুলের প্রতি দরুদ পাঠানোর পর লিখেছিলেন:

'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটি হুসাইন ইবনে আলীর অসিয়্যত। আমি এখন মদীনা ছেড়ে যাচ্ছি। আমার এই মদীনা ত্যাগ শান্তির অন্বেষায় নয়, না কোনো ভয়-ভীতির কারণে। বরং আমার এ সফরের উদ্দেশ্য হলো আমার নানাজী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর দ্বীনের সংস্কার করা। আমি যেখানেই থাকি না কেন, জনগণকে সত্যের পথে ন্যায়ের পথে আসতে অনুপ্রাণিত করব এবং অন্যায় ও অসৎ পথে ধাবিত হওয়া থেকে বিরত রাখব।'

কুফার পরিস্থিতি জানার জন্য ইমামের পাঠানো দূত মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফার গভর্নর রক্তপিপাসু ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ শহীদ করেন। এ খবর ইমামের কাছে পৌঁছালে তার সঙ্গীরা কুফা না গিয়ে মদিনায় ফিরে যেতে পরামর্শ দেন।

এসময় ইমাম তার অবস্থান সুস্পষ্ট করার জন্য সুরা আহযাবের ২৩ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করলেন। ‘ঈমানদারদের মধ্যে অনেকে আল্লাহর সঙ্গে তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে। ওদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং অনেকে প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করেনি।’

এ জায়গায় ইমাম হুসাইন (রা.) এর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়

সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য, বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির বেড়াজাল থেকে ইসলামকে রক্ষার জন্য করণীয় ঠিক করলেন রাসুলে খোদার নাতি। তিনি বললেন, মৃত্যু ভয়ে আমি মিথ্যার কাছে মাথা নত করতে পারি না। ইয়াজিদ মিথ্যাকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে, রাসুলের আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পেছনে ফেরার কোন অবকাশ নেই।

ইমামের নির্দেশ পেয়ে সহযাত্রীরা কুফার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ২ মহররম মরু প্রান্তরে হুরের নেতৃত্বে ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী কারবালা প্রান্তরে ইমামের কাফেলাকে ঘিরে ধরে। হুর কুফায় যেতে নিষেধ করেন এবং ইয়াজিদের বাইয়ত গ্রহণের প্রস্তাব দেন। ইমাম হুসাইন স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন তার সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই চলবে। ইমামের বক্তব্যে হুরের মন পরিবর্তন হয়, তিনি ইয়াজিদের পক্ষ ত্যাগ করেন।

হিজরি ৬১ সালের ৫ মহররম থেকে ৯ মহররম পর্যন্ত ইমামের কাফেলাকে ঘিরে ইয়াজিদ প্রায় ৩০ হাজার সৈন্যের সমাগম ঘটায়। এদের মাঝে জাহর বিন কাইসের নেতৃত্বে ৫শ’সেনার একটি দল দিয়ে ফোরাত নদী অবরোধ করে সেনাপতি সিমারের নির্দেশে। এ ৫দিন ইমাম হুসাইন (রা.) শক্রপক্ষকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তার লড়াই ক্ষমতার জন্য নয়। সত্য ও রাসুলের বাণীকে প্রতিষ্ঠা করাই তার লক্ষ্য। অনেকে ইয়াজিদের পক্ষ ত্যাগ করলেও সিমারের মনে কোন আঁচড় লাগেনি।

৯ মহররম, সিমার নবী পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়। ইমাম হুসাইন (রা.) বিকেলে ১দিনের জন্য যুদ্ধ পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন যাতে ১০ মহররমের রাতটি শেষবারের মত ইবাদত বন্দেগিতে কাটানো যায়। শত্রুরা প্রথমে রাজি না হলেও পরে এ প্রস্তাবে রাজি হয়।

রাতে ইমাম হুসাইন তার সঙ্গীদের বলেন, জেনে রাখো আজকের এ রাতই হবে তোমাদের শেষ রাত। আমার সঙ্গে থাকলে তোমরা কেউ রেহাই পাবে না। আগামীকাল আমাকে ও আমার পরিবার পরিজনকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হবে। এমনকি আমার দুধের বাচ্চাকেও রেহাই দেবে না। আমার জন্য তোমরা কেন প্রাণ দেবে ? ইয়াজিদ শুধু আমাকে চায়, তোমাদেরকে নয়। এখন অন্ধকার রাত। যার ইচ্ছা চলে যাও, কেউ দেখতে পাবে না। ইমাম ভাষণ শেষ করে প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন। পার্থিব লাভের আশায় যারা মক্কা থেকে যোগ দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই চলে গেলেন। থেকে যায় মাত্র ১শ’ সঙ্গী।

ফজরের নামাজের পর ইমাম হুসাইন (রা.) আবারো শত্রু পক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে কোন ফল হলো না। প্রথমে ওমর ইবনে সাদ ইমামের শিবির লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করেন। প্রতিবাদে হুর এগিয়ে গিয়ে একাই কয়েকশ’ শত্রুকে হত্যা করে নিজে শহীদ হন।

এরপর একে একে ইমামের ছেলে আলী আকবার, ইমাম হাসানের ছেলে কাশেম সহ অনেকে যুদ্ধে শহীদ হন। ইমাম হুসাইন জোহরের নামাজ আদায়ের পর শিশুপুত্র আসগরকে নিয়ে শত্রুদের বললেন, তোমরা আমাকে চাও। কিন্তু এ ৬ মাসের শিশুর সঙ্গে তোমাদের শত্রুতা নেই। তোমরা তাকে কেন পানি দিচ্ছ না। এ অন্যায়, রাসুলের বংশধরের সঙ্গে যা করছ আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে।

এসময় একটি তীর শিশু আলী আসগরের বুকে বিঁধে । ইমাম তার রক্ত আকাশের দিকে নিক্ষেপ করে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলেন, তুমি জানো আমি কেন আজ এখানে। তুমি এর বিচার করবে। এরপর ইমাম শক্র পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

কয়েকশ’ বছর আগে কারবালা

সরাসরি কেউ যখন তার বিরুদ্ধে তলোয়ার নিতে সাহস পাচ্ছিল না। তখন সিমার তীর নিক্ষেপের নির্দেশ দেন। শ’ শ’ তীর ইমামের দেহ ছেদ করে দিল। প্রচুর রক্তক্ষরণে ইমাম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হয়ে যান। এবার ইয়াজিদের নির্দেশমতো তার মস্তক দেহ থেকে আলাদা করার জন্য যখন কেউ এগিয়ে আসেনি তখন শিমার তা নিজ হাতেই করলেন।

ইমাম হুসাইনের (রা.) ঐতিহাসিক আত্মদানের মধ্য দিয়ে রচিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও বেদনাঘন দিন ‘আশুরা’। মানবতার জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। যতদিন পৃথিবীর বুকে সূর্য উঠবে, বাতাস বইবে, সমুদ্রের ঢেউ প্রবাহিত হবে ততদিন মানুষ ঘৃণাভরে ইয়াজিদের নামটি উচ্চারণ করবে। আর বিশ্ব মানবতা কেঁদে শুধুই বলবে হায় হুসাইন, হায় হুসাইন।

এএইচ/এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • ফিচার এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh