• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

রিকশার একাল-সেকাল

আমির পারভেজ, আরটিভি অনলাইন রিপোর্ট

  ০১ অক্টোবর ২০১৬, ১১:৪২

বিকেলের সূর্যটা ডুবি ডুবি। পশ্চিম আকাশে সূর্যের রক্তিম আভা। প্রকৃতিতে অনেকটাই নিরবতা। কর্মব্যস্ত মানুষগুলো ফিরতি পথে। পিচঢালা এমনই পথে যাত্রী নিয়ে ছুটে চলেছে রিকশা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশে এ রিকশা খুবই জনপ্রিয়। যানজটের নগরীতে কেউ শখে রিকশায় চড়েন, কেউ সময় বাঁচাতে, কেউবা যাতায়াতের সুবিধায়। সাধারণত মধ্যম আয়ের মানুষের কাছে রিকশা খুবই জনপ্রিয়। রিকশাকে বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী বাহনও বলা হয়। এ দেশের গরিব শ্রেণীর মানুষের জীবিকা উপার্জনের অন্যতম মাধ্যমও এটি। জনপ্রিয় বাহনটি নিয়ে আছে অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য। তুলে ধরা হলো রিকশা’র একাল-সেকাল।

পরিচয়
বাংলা ‘রিকশা’ শব্দটি এসেছে জাপানি ‘জিন্রিকিশা’থেকে। জিন্ অর্থ মানুষ, রিকি অর্থ শক্তি, শা অর্থ বাহন। যার আভিধানিক অর্থ হলো `মনুষ্যবাহিত বাহন’।

ইতিহাস
রিকশা তার জন্মস্থান জাপান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। তবুও রিকশার বিস্তৃতি মূলত এশীয় ও পূর্ব-এশীয় দেশগুলোতে বেশি লক্ষ করা যায়। পালকির বিকল্প হিসেবে ১৮৬৫-৬৯ সালে রিকশা প্রথম কে আবিষ্কার করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হলো, জোনাথন স্কোবি নামে একজন মার্কিন মিশনারি ১৮৬৯ সালে রিকশা আবিষ্কার করেন। স্কোবি থাকতেন জাপানের সিমলায়। ১৯০০ সালে কলকাতায় প্রথম রিকশা আসে। তবে ওই সময় তা ব্যবহার হত মালপত্র বহনের কাজে। ১৯১৪ সালে কলকাতা পৌরসভা রিকশায় যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়। ততদিনে মিয়ানমারের রেঙ্গুনেও রিকশা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯১৯ সালে রেঙ্গুন থেকে রিকশা আসে চট্টগ্রামে। তবে ঢাকায় রিকশা চট্টগ্রাম থেকে আসেনি; এসেছে কলকতা থেকে। নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ীরা নিজস্ব কাজে ব্যবহারের জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় রিকশা আনেন।

বাংলাদেশে রিকশা
বাংলাদেশে রিকশা বহুল ব্যবহৃত পুরনো যানবাহন। এদেশের শহর গ্রামের আনাচে কানাচে রয়েছে রিকশা। রাজধানী ঢাকা বিশ্বে রিকশার রাজধানী নামেও পরিচিত। এ শহরে রোজ প্রায় ৪লক্ষ সাইকেল ও রিকশা চলাচল করে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্যমতে, ঢাকায় কমপক্ষে ৫ লক্ষাধিক রিকশা চলাচল করে এবং ঢাকার ৪০ শতাংশ মানুষই রিকশায় যাতায়াত করে। ২০১৫ সালের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের প্রকাশনায় এ সম্পর্কিত একটি বিশ্বরেকর্ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঢাকায় রিকশা একদিকে যেমন পুরনো বাহন, তেমনি এ রিকশার কারণে যানজটের ভোগান্তিও পোহাতে হয়। বাংলাদেশে রিকশার ঐতিহ্য থাকলেও বড় বড় সড়কগুলোতে রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

রিকশায় অঙ্কন
রিকশায় চিত্রাঙ্কন চিত্রকলায় আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। রিকশাচিত্র বলতে মূলত উজ্জ্বল রঙে আঁকা কিছু চিত্রকে বোঝায়, যা খুব সাবলিল ভঙিতে বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করতে সক্ষম। সাধারণত ভারত এবং বাংলাদেশের রিকশার পেছনে, হুডে রিকশায় এ বিশেষ চিত্রকলা দেখা যায়। বিশেষজ্ঞগণ এ ধরনের চিত্রকলাকে ফোক আর্ট, পপ আর্ট কিংবা ক্র্যাফট নামে আলোচনা করতে পছন্দ করেন।

চিত্রকরদের মতে, রিকশাচিত্রের টান বা আঁচড়গুলো খুবই সাবলিল, প্রাণবন্ত এবং স্পষ্ট এবং টানগুলো হয় ছোট ছোট ও নিখুঁত। অথচ এ বিশেষ চিত্রকলার জন্য নেই কোনো আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, একেবারে দেশজ কুটিরশিল্পের মতই শিল্পীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে শিখে থাকেন এ চিত্রশিল্প এবং নিজের কল্পনা থেকেই এঁকে থাকেন এসব চিত্র। যদিও উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকজন রিকশাচিত্রের মর্যাদা সম্পর্কে অতোটা অবগত নন এবং কিছুটা হেয় করেই দেখে থাকেন।

বাংলাদেশে রিকশাচিত্র ১৯৫০ এর দশক থেকে প্রচলিত, এবং রিকশার প্রায় সম্ভাব্য সবগুলো অংশই চিত্রিত করার একটা প্রয়াস দেখা যায়। জ্যামিতিক নকশার পাশাপাশি ফুল, পাখি এমনকি জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের ছবি আঁকারও প্রচলন ছিল। কখনো রিকশাচিত্রে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিফলিত হতো, আবার কখনো হয়তো নিছক কোনো বক্তব্য কিংবা সামাজিক কোনো বিষয় দেখা যেত। তবে আধুনিক জগতে বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি সহজলভ্য হওয়ায় হাতে আঁকা সেসব চিত্রকর্ম এখন আর সচরাচর দেখা যায় না, বরং বিভিন্ন জায়গা থেকে ছবি কম্পিউটারে কাটছাট করে সাজিয়ে টিনের ধাতব প্লেটে সেগুলো ছাপ দিয়ে খুব সহজেই তৈরি করা হয় এখনকার রিকশাচিত্রগুলো, সেখানে থাকেনা দেশজ কোনো ঐতিহ্য, থাকে না কোনো চিত্রকলার মোটিফ, বরং থাকে চলচ্চিত্রের পোস্টার কিংবা নায়ক-নায়িকার ছবি।

নানা দেশে রিকশা প্রদর্শনী
রিকশার জনপ্রিয়তা কিংবা ঐতিহ্য তুলে ধরা হয় বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কায় যৌথভাবে আয়োজিত বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-এর বাংলাদেশে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, যেখানে বাংলাদেশের রিকশায় করে মাঠে উপস্থিত হন অংশগ্রহণকারী দলগুলোর দলপতিরা। পাশাপাশি বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে বিশ্বকাপে আগত অতিথিদের বরণে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে রাস্তার পাশে ৭টি রিকশা পাশাপাশি বসিয়ে পেছনের প্রতিটি অক্ষর আলাদা আলাদাভাবে লিখে স্বাগত জানানো হয়। এছাড়া ঐবছর বিশ্বকাপকে উপলক্ষ করে সিএনএনগো ওয়েবসাইট প্রকাশ করে ঢাকার ১০টি বিষয়ের বর্ণনামূলক প্রতিবেদন, যে ১০টি বিষয় দিয়ে চেনা যাবে ঢাকাকে, তার তৃতীয়টিই ছিল রিকশাচিত্র। সেখানে তুলে ধরা হয় রিকশাচিত্রের ব্যবসা ঢাকায় খুব জমজমাট। ঢাকায় রিকশার সংখ্যা অনেক এবং প্রায় প্রতিটি রিকশার পেছনেই রিকশাচিত্র রয়েছে। রিকশাচিত্রগুলোয় স্থানীয় চলচ্চিত্র তারকা, মসজিদ, দেব-দেবী কিংবা প্রকৃতি-পরিবেশের চিত্র রয়েছে।

সেই অতীত থেকে বর্তমান সময়েও রিকশা চালনাকে সর্বনিম্ন জীবিকা ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়। খুব কম সংখ্যক যাত্রীর কাছ থেকে রিকশা চালকেরা প্রাপ্য সম্মান পেয়ে থাকেন। এ রিকশা চালকেরা কিছুটা পরিমাণ হলেও পরিবেশকে কার্বন মুক্ত করছে। রিকশা বাংলাদেশের এবং বিশেষ করে তার নকশা এবং শিল্পকলার জন্য একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। তাই এ রিকশাকে বাংলাদেশের ঐতিহ্য হিসাবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা আমাদেরেই দায়িত্ব।

এপি/ এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • ফিচার এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh