• ঢাকা রোববার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
logo

গণরুম বিলুপ্ত করে ইতিহাস সৃষ্টি করলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জাবি প্রতিনিধি, আরটিভি নিউজ

  ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ২২:২৯
ছবি : আরটিভি

দীর্ঘ প্রায় দেড়যুগ পর গণরুম বিলুপ্ত করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) প্রশাসন। রোববার (২০ অক্টোবর) থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হচ্ছে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে (৫৩তম ব্যাচ) ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের ক্লাস। নবীন শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে তাদের নির্ধারিত আবসিক হলে উঠতে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ দিনের গণরুম সংস্কৃতি এখন আর নেই। ছাত্রদের ৩টি এবং ছাত্রীদের জন্য ৩টি নবনির্মিত আবাসিক হলসহ মোট ২১টি আবাসিক হলে নবীন শিক্ষার্থীরা প্রথম দিনেই নিজ নিজ আসন বুঝে পেয়েছে। এতে দীর্ঘদিন পর পূর্ণাঙ্গ আবাসিক রূপ ফিরে পেলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। নিয়ম অনুযায়ী, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক হলগুলোয় একটি করে সিট বরাদ্দ নিশ্চিত থাকবে। কিন্তু গত দেড়যুগ ধরে একটু একটু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আবাসিক চরিত্র হারিয়ে অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।

পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিন থেকে একটি সিট, পড়ার জন্য একটি টেবিল ও চেয়ার নির্ধারিত থাকলেও এতোদিন তা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। নবীন শিক্ষার্থীদের ঠাঁই হতো হলের গনরুমে। কমন রুম, ডাইনিং রুম, রিডিং রুম, সংসদ রুম, নামাজের কক্ষ ও সাইবার রুমের মেঝেতে। সেখানে গাদাগাদি করে একজনের জায়গায় কম করে হলেও তিন থেকে চারজন শিক্ষার্থীকে থাকতে হতো। প্রথম বর্ষ গণরুমে পার করে দ্বিতীয় বর্ষে জুটতো ‘মিনি গণরুম’। সেখানে তাদের দু’জনের রুমে ছয় থেকে আটজন এবং চার জনের রুমে ১৪ থেকে ১৬ জন থাকতে হতো। এভাবে দ্বিতীয় বর্ষ পার করে তৃতীয় বর্ষে এসে একটি সিট জুটলেও পলিটিক্যাল-ননপলিটিক্যাল ভেদে চারজনের রুমে থাকতে হতো ৬-৭ জনকে। চতুর্থ বর্ষ বা মাস্টার্সে এসে শিক্ষার্থীরা চারজনের রুমে থাকার সুযোগ পেত। এমন চিত্র ছিল ছেলেদের হলগুলোতে। মেয়েদের হলে অপেক্ষাকৃত আগে সিট পাওয়া গেলেও হলভেদে তাদেরও প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে গণরুমে কাটাতে হতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের ১১টি এবং মেয়েদের ১০টিসহ মোট ২১টি হল রয়েছে। যার আসন সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় অধিক। মূলত আবাসিক হলগুলো এতদিন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তারাই শিক্ষার্থীদের সিট দিত। এছাড়া ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলেও অবৈধভাবে রুম দখল করে ৪ জনের রুমে ২ জন বা একা থাকত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে ছিল নীরব, গণরুম দূর করতে ছিল না কার্যকরী কোন পদক্ষেপ। ফলে ১০ তলা বিশিষ্ট নতুন ছয়টি হল নির্মাণের পরও সিট সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। কৃত্রিম সিট সংকট ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রথমবর্ষে এসে ‘গণরুমে’ উঠতে হবে এটাই হয়ে উঠে নিয়ম। তবে এবছর দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। জুলাই বিপ্লবের পর আগের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হওয়ার ফলে প্রতিটি হলেই সিট সংকট কেটে গেছে। হল প্রশাসন সিট বন্টনের দায়িত্ব নিয়ে প্রতিটি হলেই শিক্ষার্থীদের সিট নিশ্চিত করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন হলে নবীন শিক্ষার্থীদের বরন করে নিতে আয়োজন করেছে হল প্রশাসন ও হলের শিক্ষার্থীরা। নবীনদের ফুল, কলম এবং মিষ্টি দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা নোটিশ বোর্ড থেকে কক্ষ নম্বর দেখে নির্ধারিত সিটে উঠছেন। প্রতিটি কক্ষেই ছিল প্রত্যেকের জন্য একটি বেড, টেবিল ও চেয়ার। হলে শিক্ষার্থীদের কক্ষে গিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা।

নবীন শিক্ষার্থীদের উৎসবমুখর পদচারণায় মুখরিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো। প্রত্যেকে নিজেদের সিটে উঠতে পারায় সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। শেখ হাসিনা হলে সিট বরাদ্দ পাওয়া শিক্ষার্থী নাবিলা বিনতে হারুন বলেন, আগামীকাল আমাদের ক্লাস শুরু হবে। তার ঠিক একদিন আগেই আমরা হলে উঠতে পারলাম। গণরুম জটিলতা, র‌্যাগিং নিয়ে ভয় বা সংশয় থাকলেও এর কিছুই পাই নি। আমরা নির্ধারিত এলোটেড হলে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই কোনো ঝামেলা ছাড়াই সিটে উঠতে পেরেছি। পরিবার-পরিজন ছেড়ে আসার কষ্ট থাকলেও নতুন নতুন সহপাঠীদের সাথে পরিচিত হতে পেরে ভালো লাগছে। সব মিলিয়ে অসাধারণ অনুভূতি, যেন এক উৎসব মুখর পরিবেশ চারপাশে।

প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ৫৩ ব্যাচকে হলে উঠানোর মধ্য দিয়ে একটি নতুন মাইলফলক তৈরি হলো। বিগত বহুবছর ধরে যে গনরুমের সংস্কৃতি ছিল আমরা এবার তা পুরোপুরি বন্ধ করতে পেরেছি। প্রতিটি শিক্ষার্থী হলে উঠার সাথেই সাথেই তারা তাদের সিটে উঠতে পেরেছে। প্রতিটি রুমেই শিক্ষার্থীরা তাদের বেড, চেয়ার ও টেবিল পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিটি হলে শিক্ষার্থীদের এ বিষয় গুলো নিশ্চিত করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, নবীন শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ হলে প্রথম দিনেই সিট পাবে, এটা তাদের অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে পেরে তার প্রশাসন আনন্দিত। তিনি বলেন, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে তার প্রশাসন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আবাসিক হলে এবং এ্যাকাডেমিক ভবনগুলোতেও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে তার প্রশাসন আন্তরিকভাবে কাজ করবে। এ লক্ষ্যে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

নবীন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ব্যবস্থা

এদিকে নবীন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে বলে জানিয়েছেন প্রক্টর এ কে এম রাশিদুল আলম। তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল সংলগ্ন গেইটে নিরাপত্তা চকি বসানো হয়েছে। সেখানে নিয়মিত নিরাপত্তা প্রহরীর পাশাপাশি অতিরিক্ত দশজন আনসার বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত করা হয়েছে। এছাড়া প্রধান গেইট ও জয় বাংলা গেইটেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তাকর্মীদের পালাক্রমে সারারাত টহল দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে গেইটগুলোতে অতিরিক্ত লাইট লাগানো হয়েছে।

যানবাহনের গতিসীমা মেনে চলার নির্দেশ

বিশ্ববিদ্যালয় কতৃর্পক্ষ আজ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধিত বা অনুমোদনকৃত অটো রিক্সা চলাচল করতে পারবে। অনুমোদনবিহীন অটো রিক্সা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে চলাচল করতে পারবে না। অনুমোদনকৃত অটো রিক্সাগুলোতে নিদিষ্টের গতিসীমা মেনে চলতে হবে এবং নির্ধারিত ভাড়া নিতে হবে। অন্যথায় প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে মোটর সাইকেল এবং অন্যান্য যান চলাচলেও নিদিষ্টর্ গতিসীমা মেনে সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নবীন শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানিয়ে র‌্যাগিং বিরোধী র‌্যালি ও মানববন্ধন, ‘এন্টি র‌্যাগিং সেল/স্কোয়াড গঠনের দাবি’

এদিকে নবীন শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানিয়ে র‌্যাগিংমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে র‌্যালি ও মানববন্ধন করেছে জাহাঙ্গীরনগর সংস্কার আন্দোলন। আজ শনিবার (১৯ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক-জব্বার হল থেকে র‌্যালিটি শুরু হয়ে মওলানা ভাসানী হল, আ ফ ম কামালউদ্দিন হল ও নতুন প্রশাসনিক ভবন হয়ে শহীদ মিনারে এসে মানববন্ধনের মাধ্যমে শেষ হয়।

এসময় জাহাঙ্গীরনগর সংস্কার আন্দোলনের আহবায়ক ইয়াহিয়া জিসান বলেন, একজন নবীন শিক্ষার্থী অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পরে তাদেরকে যে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা ছিল নজিরবিহীন। আমরা জুলাই বিপ্লবের পর একটি পরিবর্তন চেয়েছি যেখানে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা গণরুম ও র‌্যাগিং কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন র‌্যাগিং দেখতে চাই না।

ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী বলেন, আমি র‌্যাগিংমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার লক্ষ্যে জাহাঙ্গীরনগর সংস্কার আন্দোলনের এই র‌্যালির সাথে সংহতি প্রকাশ করছি। আমি সবাইকে আহবান জানাবো এতদিন পরে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি সেখানে যেন কোন ধরণের র‌্যাগিং কালচার না থাকে। সেই লক্ষ্যে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি নবীনদেরকে বলবো নিজেরা সচেতন থেকে র‌্যাগের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।

আরটিভি/এমএ

মন্তব্য করুন

Bangal
rtv Drama
Radhuni
  • ক্যাম্পাস এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
জাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটি গঠন
জাবিতে ছাত্রশিবিরের শীতবস্ত্র বিতরণ
আইনজীবী সাইফুল হত্যার প্রতিবাদে জাবিতে বিক্ষোভ 
জাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতির সংস্কার দাবিতে মানববন্ধন