• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

বিজেএস সাফল্য

মুটকোর্টের জাজ হওয়া থেকেই জুডিশিয়ারির স্বপ্ন নিশির

সাফায়িত সিফাত, কুবি প্রতিনিধি

  ১৫ মে ২০২২, ২০:১০
মুটকোর্টের জাজ হওয়া থেকেই জুডিশিয়ারির স্বপ্ন নিশির
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) থেকে প্রথম সহকারী জজ হিসাবে সুপারিশপ্রাপ্ত নিশি আক্তার

২১ এপ্রিল। মিডটার্ম পরীক্ষার ফাঁকে শুনলেন ১৪তম সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। তখন নিশি আক্তারের মনে জেঁকে বসলো চিন্তা— ‘হবে তো আমার’? কিছুক্ষণ পরেই পেলেন সুসংবাদ- কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) থেকে তিনিই প্রথম সহকারী জজ হিসাবে সুপারিশপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষা চলার সময়ও নিশি জানতেন না একটু পরই নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অংশ হতে চলেছেন তিনি।

এর আগে আইন বিভাগ থেকে স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন কুবির দশম ব্যাচের (বিভাগের প্রথম ব্যাচ) শিক্ষার্থী নিশি আক্তার। লক্ষীপুর সদরের চন্দ্রগঞ্জের কুশাখালির নিশি স্কুলজীবন থেকেই মেধার স্বাক্ষর রেখে আসছেন। স্বপ্নের বিচারবিভাগের লক্ষ্যে যাত্রা ও সফলতার নেপথ্য গল্প শুনতে নিশি আক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন আরটিভি নিউজের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সাফায়িত সিফাত—

প্রশ্ন: আপনার বিজেএস জার্নিটা শুরু হয়েছিলো কীভাবে?
নিশি: ৮ম সেমিস্টারে মুটিংয়ের একটা কোর্স ছিলো, যেখানে জাজরা এসে আমাদের ট্রায়াল শেখাতেন। প্রথম জাজ মাদক মামলার ট্রায়াল শিখিয়েছিলেন। তিনি এসে জিজ্ঞেস করলেন ফাস্ট কে। ক্লাসের সবাই যখন আমার কথা বললো, তিনি আমাকে সামনে নিয়ে গিয়ে বললেন- তুমি জাজ হবা। ঐদিন প্রথম জাজ হওয়ায় (মুটকোর্টে) কী রকম একটা অনুভূতি হয়েছিলো.. মনে হচ্ছিলো- ‘হ্যাঁ, আমি জাজ হবো’। বাসায় গিয়ে আব্বুকে ফোন দিয়ে বললাম- আব্বু আমি জাজ হবো, দোয়া করবেন। আম্মুকেও বললাম। ঐদিন থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু।

আর অনার্স থাকাকালীন মনে হয়নি চাকরির জন্য প্রিপারেশন নিবো। তাই আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। করোনার সময় শুধু বিসিএসের প্রিভিয়াস প্রশ্নগুলো দেখেছিলাম। তারপর ৮ম সেমিস্টার ফাইনালের সময় জুডিশিয়ারির সার্কুলার দিয়েছে। সেমিস্টার শেষ করেই পড়াশোনা শুরু করেছিলাম।

2

প্রশ্ন: প্রথম সহকারী জজ হয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছেন। প্রথম প্রচেষ্টাতেই সফল হয়ে কেমন লাগছে?
নিশি: এতো দ্রুত সফলতা পাওয়া কল্পনার বাইরে ছিলো। প্রথম কয়েকদিন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমার সবচেয়ে ভালো লাগছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় দিতে। কারণ এখানে আইন বিভাগ আমাদের দিয়েই শুরু হয়েছে। আমাদের স্বপ্নের আইন বিভাগ সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আমাদের হাত ধরেই।

প্রশ্ন: এই সাফল্যের পেছনে কার অবদান বেশি?
নিশি: অবদান বেশি বলতে গেলে বলবো আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র ফয়েজ আহমেদ দীপু ভাইয়ার কথা। সার্কুলার হওয়ার পরেই ভাইয়া আমাকে ফোন দিয়ে বললো, তোকে প্রিলি যেভাবেই হোক পাশ করতে হবে। ওর জন্যই প্রিপারেশন শুরু করেছিলাম। ছোট থেকেই ও শুধু আমার ভাই না, বন্ধুর মতো সবসময় পাশে থেকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এছাড়াও আছে আমার আব্বু, আম্মু, ভাইয়ারা। আর ডিপার্টমেন্টের স্যার-ম্যামরা সবসময় আমাদের জুডিশিয়ারির জন্য প্রস্তুত হওয়ার দিকনির্দেশনা, তাগিদ দিতেন।
এমনকি আমার সিপিসি, সিআরপিসি, এভিডেন্স এক্টসহ আরও কিছু বইয়ে সেকশনের পাশে লিখে রাখতাম ‘জুডিশিয়ারি’। স্যাররা বলে দিতো এটা জুডিশিয়ারির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা আমার প্রস্তুতিতে খুব কাজে দিয়েছে।

প্রশ্ন: বিজেএসে প্রিলি ও রিটেন পরীক্ষার মাঝের সময়টা কম থাকে। এক্ষেত্রে প্রস্তুতি কীভাবে গুছিয়ে নিয়েছেন?
নিশি: এই সময়টা আমি সম্পূর্ণ জেনারেল প্রিপারেশন নিয়েছিলাম। যেমন: ম্যাথ, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক, বাংলা, ইংরেজি। আর নিউজ দেখতাম, পড়তাম, কিছু আপডেট ইনফরমেশন তারিখসহ লিখে রাখতাম। আইন থেকে শুধু উত্তরাধিকারের কিছু ম্যাথ করেছি। আর যে বিষয়গুলো একদম পড়া ছিল না সেগুলো দেখেছি। সময় কম হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নেওয়া আসলে সম্ভব না, যতটুকু আয়ত্ত করা যায়।

প্রশ্ন: আইনের ধারা-উপধারা কিংবা কেইসগুলো প্রয়োগ ও আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে কি বিশেষ কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন?
নিশি: এগুলো মনে রাখার টেকনিক একটাই- বারবার রিভিশন দেওয়া। আর আমি ডিপার্টমেন্টের সেমিস্টারের সময় সেকশন-সাবসেকশন, কেইস রেফারেন্স এতো ভালোভাবে পড়েছিলাম যে একবার রিডিং পড়লেই আমার মনে থাকে। কোনো সেকশন ব্রিফ্লি না, ডিটেইলস পড়তাম সবসময়। আর কেইসের ক্ষেত্রে শুধু জাজমেন্ট। তবে কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কেইসের ফ্যাক্টসহ পড়তাম।

প্রশ্ন: টাইম ম্যানেজমেন্ট কীভাবে করেছেন?
নিশি: আমি কখনো রাত জেগে পড়তাম না, সর্বোচ্চ ১২ টা। আর সকালে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসে- টানা পড়তাম, গ্যাপ রাখতাম না। বিকেলেও কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে পড়তে বসতাম। আর পরীক্ষার হলে টাইম ম্যানেজমেন্ট প্রশ্ন কমন আসার উপর অনেকটা নির্ভর করে। সব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে ব্যালেন্স রাখার চেষ্টা করতাম। মার্জিন করতে সময় নষ্ট হওয়ায় পেইজ একটু ভেঙ্গে নিয়ে লিখতাম।

প্রশ্ন: অনেকেই দ্বিধা-দ্বন্দে থাকে বিজেএসের জন্য কোচিং করা জরুরি কি না বা না করলে সঠিকভাবে প্রস্তুত হওয়া সম্ভব কি না? এ বিষয়ে আপনার মত কী?
নিশি: আমি কোচিং করিনি। তবে করতে পারলে তো অবশ্যই ভালো, দিকনির্দেশনা বা পড়ার মধ্যে থাকা যায়। কিন্তু আমার করা হয়ে উঠেনি। প্রিলির সময় অলসতা করেই পড়িনি, তবে যেকোনো গ্রুপে ফ্রি ক্লাস থাকলে করতাম। আর রিটেন-ভাইবাতেও সময় কম পাওয়াতে করা হয়নি। ভাইবার সময় লিগ্যাল সোলে কিছু ফ্রি ক্লাস করেছি। সবসময় পড়াশোনার মধ্যে থাকা গেলে কোচিং ছাড়াও ভালো প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব। আসলে নিজের পড়াশোনা আর পরিশ্রম থাকলে সবই সম্ভব।

প্রশ্ন: প্রস্তুতির জন্য কী কী বই অনুসরণ করেছেন?
নিশি: প্রিলির জন্য বেয়ার এক্ট ভালোভাবে পড়লেই যথেষ্ট। তবে কিছু বিষয় ক্লিয়ার করার জন্য বেয়ার এক্টের পাশাপাশি আইন পাঠ ১ম, ২য় দু’টো পার্ট পড়েছি। আর লিখিত পরীক্ষার সময় একাডেমিক বইগুলোই পড়েছি। জেনারেলের জন্য যেকোনো একটা ডাইজেস্ট, জব সলুশন, বিসিএস প্রিভিয়াস প্রশ্ন, আর আমি ইংরেজির জন্য মাস্টার, বাংলার জন্য অগ্রদূত পড়েছি।

প্রশ্ন: আপনি কি শুধুই বিজেএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নাকি অন্য জবেরও?
নিশি: আমার প্রস্তুতি শুধু বিজেএস কেন্দ্রিক ছিলো। তবে ভালো করতে হলে জেনারেল প্রিপারেশন লাগবেই। বিসিএস প্রস্তুতি নিলে বিজেএস জেনারেল অংশের প্রস্তুতিও হয়ে যায়। তবে বিসিএস, বিজেএস ছাড়া অন্য কোন জবের পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো না, আবেদনও করা হয়নি।

প্রশ্ন: হাল আমলে বিসিএসের প্রতি সবার আকর্ষণ খুব বেশি দেখা যায়। আইনের ছাত্রদের আবার বিজেএস, বিসিএস দু’টোই। দুটা প্রস্তুতির পার্থক্য কীভাবে দেখছেন?
নিশি: বিজেএস এর মাধ্যমে আমরা যারাই জাজ হচ্ছি তাদের অধিকাংশই বিসিএস রিটেন-ভাইবা দেওয়া স্টুডেন্ট, যদিও আমার সেই সুযোগ হয়নি। অনেকেই আছেন বিসিএস ভালো করে বলেই বিজেএসে ভালো করে। যেহেতু আমরা আইনের স্টুডেন্ট, সব আইন-ই আমাদের মোটামুটি জানা। তাই সার্কুলার হওয়ার পর এক দেড় মাস সময়েও আইন শেষ করা সম্ভব। এর আগ পর্যন্ত বিসিএস কেন্দ্রিক প্রিপারেশন নিলে ওটা অনেক হেল্পফুল হয়। তবে বিসিএসের বড় সিলেবাস বিজেএসে অনেকটা কমে যায়, কারণ এখানে আইন অংশ বেশি।

প্রশ্ন: বিচার বিভাগের অংশ হতে যাচ্ছেন, এ বিভাগ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী? সাধারণ মানুষের আস্থা বৃদ্ধিতে কী করতে চান?
নিশি: বিচার বিভাগ আমার কাছে স্বপ্নের বিভাগ, যেখানে দেশের জনসাধারণের কাছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ আছে। মানুষকে তার ন্যায্য পাওনা দেওয়ার মাঝে যে আনন্দ আর সম্মান তা একমাত্র এই বিভাগের অংশ হয়েই সম্ভব। আমাদের বিচার বিভাগ যেন বরাবরের মতো সাধারণ মানুষের কাছে ন্যায় বিচার স্থান হিসেবে, আস্থার জায়গা হিসেবে থাকে সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করবো।

প্রশ্ন: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
নিশি: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুধু একটাই, জাতির পিতার দেখে যাওয়া সেই স্বপ্নের সোনার বাংলায় আমি যেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারি। যে মহান দায়িত্ব আমি পেয়েছি, বিচারক হওয়ার যে সম্মান অর্জন করেছি সেই সম্মান রক্ষায় আমি যেন এই প্রিয় স্বদেশ আর স্বদেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারি।

প্রশ্ন: ভবিষ্যতে যারা এ সেক্টরে সফল হতে চায় তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ।
নিশি: যারাই এই বিচার বিভাগের অংশ হতে চায় তাদের প্রতি পরামর্শ- পরিশ্রম, সততা আর সবার দোয়া ও সহযোগিতায় এগিয়ে গেলে সাফল্য আসবেই। আর ডিপার্টমেন্টে ভালো করলেই জুডিশিয়ারির পথ অনেকটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

মন্তব্য করুন

daraz
  • শিক্ষা এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
১২৫ বছর পুর্তিতে গাইবেন নাসির- কাজী শুভ- নিশি শ্রাবনী
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ে আগুন 
এবার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সহকারী প্রক্টরের পদত্যাগ
ফ্যান বন্ধ করা নিয়ে রুমমেটকে পেটাল কুবি শিক্ষার্থী
X
Fresh