• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রতি খোলাচিঠি

আরিফুল ইসলাম সাব্বির, সংবাদকর্মী

  ০২ মে ২০২০, ০৮:২৫
কবি নির্মলেন্দু গুণ
কবি নির্মলেন্দু গুণ

প্রিয় কবি,

আপনি বলেছিলেন, প্রিয়তমাকে ছুঁতে গিয়ে কতবার হাত ফিরিয়ে নিয়েছি, তা জানে ঈশ্বর। আপনার এমন বহু কবিতায় আমি নিজের নতশিরকে অনুভব করেছি। আপনার কবিতায় খুঁজে পেয়েছি নিজেকে। আপনার লেখা পাঠ করে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছি। লেখার প্রতিটা শব্দে যে ব্যাখ্যাহীন মাদকতা আছে, আবেশ-আসর আছে, পাঠক হিসেবে এক নির্মল স্বাদ আস্বাদনের অদ্ভুত সব ক্ষমতা আছে আপনার লেখায় তা বুঝেছি আপনার লেখা পড়েই। আমাকে পাঠক হিসেবে গড়ে তোলার অন্যতম কৃতিত্ব রয়েছে আপনার।

জেনেছি, এক অগ্নিগর্ভ সময়ে লেখালেখির শুরু আপনার। যেই সময়ে জাতির পিতার হত্যার ঘটনা ঘটে সাহসে প্রতিবাদ করেছে আপনার কলম। আপনি বাকশালের প্রতিবাদ করেছেন, সমালোচনা করেছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর। আবার বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর আপনি প্রতিবাদে লিখেছেন কবিতা। আপনার লেখায় প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে আমি খুঁজে পেয়েছি বুক চিতিয়ে থাকা এক চিত্র। বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ের দিনগুলোতে আপনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে সক্রিয় ছিলেন। কবিতার মাধ্যমে একাত্মতার বাণী প্রচার করেছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্ম হওয়ার সেই বাণী অসংখ্য পাঠককে মুগ্ধ করেছে, বাংলা কবিতায় নির্মিত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র ধারা।

আপনি লিখেছেন,

‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।’

(আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি)

আবার আপনিই লিখেছেন,

'কতবার যে আমি তোমাকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবে-

`এই ওঠো,

আমি, আ…মি…।`

আর অমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।'


প্রিয় কবি, আপনাকে এই চিঠিটি লিখছি শুধু আপনার প্রতি নিজের মুগ্ধতা জানাবার জন্যে নয়। আপনার প্রশংসা বাক্য লেখবার জন্যে নয়। আপনার কবিতা পড়ে যে অদ্ভুত অনুভূতি গড়ে উঠেছে। আপনি আমার মত নির্দলীয় মানুষের মনের মানুষ হয়ে উঠেছেন সেই অধিকার থেকেই লিখছি। এই অধিকার আপনার কবিতার মধ্য দিয়ে আপনি আমাকে দিয়েছেন বোধ করছি। আপনার কবিতার যতটা মুগ্ধতার কথা বলেছি, ততটাই ব্যথিত হয়েছি, আপনি নিজেকে একটি বিশেষ দলের কবি হিসেবে দাবি করার মধ্য দিয়ে।

ফেসবুকের পাতায় আপনাকে অনুসরণ করার আপনার সকল নতুন লেখা তারা আমাকে নোটিফিকেশন আকারে পাঠায়। আপনার গতকালের ওই স্ট্যাটাসের পর থেকেই আপনার প্রতি তীব্র ক্ষোভ, অভিমান হচ্ছে। ব্যক্তি আপনি ছিলের আমার মত হাজারো মানুষের প্রিয় প্রেমের প্রতিবাদের কবি। কিন্তু আপনার এই স্ট্যাটাসে সেই স্থানের যারপরনাই স্খলন হয়েছে।

আমি রাজনীতি বিরোধী নই। কিন্তু আপনার যেই সার্বজনীনতা ছিল, আপনার যেই গ্রহণযোগ্যতা ছিল, যে কারণে আপনি ছিলেন আমাদের। আপনার কবিতাসহ পুরো সাহিত্যচর্চাকে আপনি একটি দলের নামে বিকিয়ে দিলেন! নিজেকে এখনো বোঝাতে পারছি না।

আপনি কবিতা লিখেছেন, আপনি দৃপ্ত গলায় আবৃতি করেছেন। আপনার লেখায় উঠে এসেছে ধনী, গরীব, হিন্দু, মুসলিম তথা গণমানুষের বার্তা। মনকষ্টে তীব্র যন্ত্রণায় ভোগা প্রেমিককে আপনি শিখিয়েছেন জোর করে হয় না। কিন্তু আপনি আপনার লেখাগুলোকে জোর করে একটা দলের করে দিলেন!

আপনি বাকশালের প্রতিবাদ করেছিলেন। অথচ, দেশের রাজনীতিতে এক তীব্র মহাকাল চলছে। কালোদিনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সারাদেশে যেই দলের নামে এত দুর্নীতির অভিযোগ। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ। খুন ধর্ষণের অভিযোগ। করোনার দিনে চাল চুরি, ত্রাণ চুরির ঘটনা ঘটছে। আমরা দেখেছি, এই দলের ক্ষমতার আমলেই দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। সেই দলের সমালোচনায় আপনি আর আগের মত মুখর হচ্ছেন না। তাতে আপত্তি ছিল না। একটা সময় বাঘেরও শক্তি কমে আসে। কিন্তু তাই বলে বাঘ তার নিজের সত্তা হারায় না। বাঘ তাকে বিকিয়ে দেয় না। আপনি যেভাবে একটি দলের হয়ে গেলেন তাতে স্পষ্ট যে আপনি নিজেকে বিকিয়েই দিয়েছেন। আমার তীব্র আপত্তি সেখানেই। আমি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছি আপনার এই কাণ্ডে।

আপনি কোন দলের না হয়েও ছিলেন বহুজনের দিশা। কিন্তু আজ আপনি এই বয়সে এসে সত্যিই বুড়িয়ে গেলেন! হৃদয় ভাঙ্গার কষ্ট আপনি জানেন। আপনি জানেন বিচ্ছেদের যন্ত্রণা। না জানলে কি এত গভীর করে তীব্র করে লেখা যায়? কিন্তু লেখে, লেখা পড়েই তো মানুষ শেখে! আপনি কেন শিখলেন না প্রিয় কবি?

আপনার এই উন্মোচিত মুখোশটা বড্ড বেমানান। বড় হতাশার। আপনার বইগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার তেমনটাই মনে হচ্ছে।

একটা লাইন মনে পড়ছে। ভোলগা থেকে গঙ্গায় কালিদাসকে তাঁর ছাত্র বলেছিলেন, ''আপনার তিরস্কার শুনতে আমি প্রস্তুত, কিন্তু আমি এটা সহ্য করতে রাজি নই যে, আমার গুরু গণতন্ত্র-হত্যাকারী গুপ্তরাজার সামনে চাটুকরের মতো পড়ে থাকবেন''।

প্রিয় নির্মলেন্দু গুণ, আপনি জানেন, পাড়ায় পাড়ায় আপনার এত নামডাক। এখনো গ্রামেগঞ্জে এখনো অনেক প্রেমিক নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যায়। এখনো প্রচুর প্রতিবাদী লিখে যায়। তাতে আপনার অতীতের কবিগুণের ভূমিকা রয়েছে। যেখানে আপনি সবার। আপনাকে অতীতে যেই রূপে দেখেছি। যেই মুখে দেখেছি। সেইরূপে আপনি ফিরবেন সেই প্রত্যাশা।

একজন পাঠক হিসেবে আমার প্রত্যাশা আপনি আবার লিখবেন। আপনি লিখবেন সকলের জন্যে। একক কোন গোষ্ঠীর হয়ে পড়বেন না আপনি। আপনার ফিরে আসার মধ্য দিয়ে আমরা আবার ফিরে পাব সেই আমাদের নির্মলেন্দু গুণকে। অথবা আপনি আর কিছুই বলবেন না আর। হারিয়ে যান।

যেমন লিখেছিলেন,

'একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি
কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।
একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে
পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব।'

আরিফুল ইসলাম সাব্বির
সংবাদকর্মী


মন্তব্য করুন

daraz
  • শিল্প-সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh