• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
logo

কান্দি ইউনিয়নের মতো সারাদেশে এমন সাংস্কৃতিক জাগরণ হোক

গোপাল বাগচী

  ১০ অক্টোবর ২০১৯, ১০:২৩
কান্দি ইউনিয়ন সারাদেশ সাংস্কৃতিক

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একেবারে সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায়! বিস্ময় জাগানিয়া বটে। এমন একটি ব্যতক্রমী অনুষ্ঠান উপহার দিয়ে উদাহরণ তৈরি করলো কোটালিপাড়ার কান্দি ইউনিয়ন যুব সংঘ-ঢাকা, তাদের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে। অনুষ্ঠান মানে কেবল আনুষ্ঠিকতা নয়, একেবারে শিল্প-সাহিত্যের সাক্ষাৎ সংযোগ ঘটিয়ে দিলো শহরের বাইরে স্লিগ্ধ শ্যামল শান্ত একটি গ্রামে, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে। তাঁদের মাঝে প্রত্যয় জাগিয়ে তুললো ব্যতিক্রম আয়োজনের মধ্য দিয়ে।

এতদিন মানুষ জানতো এসব কেবল শহরে বা টিভি-রেডিওর বিষয়, পাড়াগাঁয়ের নয়। উৎসাহব্যঞ্জক এমন কর্মকাণ্ড চলছিল ৭ থেকে ১০ অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত, চারদিন ধরে। ‘শাপলা ফুলে সূর্যোদয়’ শিরোনামে শিল্পকর্ম প্রদর্শনী আর শারদীয় বইমেলায় মুখর হয়ে উঠেছিল ধারাবাশাইল গ্রামে অবস্থিত শেখ হাসিনা আদর্শ মহাবিদ্যালয় মিলনায়তন। শারদীয় উৎসবের মধ্যেই আরেক উৎসবের স্বাদ। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ নিশ্চয়ই উৎসুক হয়ে ছিল, আমাদের ছেলেরা এ আবার কী করছে! কৌতূহলী চোখে দেখেছে- এতো এতো কিছু শিখেছে তাহলে ওরা। দুঃখ-দৈন্য, অভাব অনটনের সঙ্গে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁদের মাঝে শিল্পচর্চা! এর মানে পরিবর্তন আমাদের স্পর্শ করছে।

কয়েকদিনের এ আয়োজনটি ছিল যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমন সৌকর্যময়। শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ও শারদীয় বইমেলা, আনন্দ শোভাযাত্রা, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, আলোচনা, বৃত্তি ও পুরস্কার প্রদান, গুণিজন সম্মাননা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বলতেই হয়, এর মধ্যে শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ও শারদীয় বইমেলা ছিল নতুন সংযোজন। তাও আবার নিজ ইউনিয়নের চিত্রশিল্পী ও উপজেলার লেখকদের প্রাধান্য দিয়ে। এর আগে আমাদের এমন কোনো ধারণা ছিল না যে, এ ধরনের একটি আয়োজন সাধারণ মানুষের জন্য করা সম্ভব। নিঃসন্দেহে এটি কান্দি ইউনিয়ন যুব সংঘের সৃষ্টিশীল ভাবনার ফসল। সংঘের পরিচালনাকারীদের প্রশংসনীয় উদ্যোগের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

শিল্পী সুমন বিশ্বাস, অপু রায়, রেমন বিশ্বাস, জয়দেব বিশ্বাস, বিশ্বজিৎ রায়, সবুজ রায় ও প্রতাপ অধিকারীর শিল্পকর্ম এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হয়। অপরদিকে কোটালিপাড়ার যেসব লেখকের লেখা বই মেলায় ছিল তারা হলেন-খালেক বিন জয়েনউদদীন, রবীন্দ্রনাথ অধিকারী, সহদেব বৈদ্য, মুজিবুল হক, গোপাল বাগচী, অরুণ কুমার বিশ্বাস, মিন্টু রায়, দীপঙ্কর দীপক, প্রশান্ত হালদার ও সমীরণ রায়।

গ্রামের সেই সাধারণ মানুষ যারা উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাদের কাছে নদী, নৌকা, খেয়া পারাপার, খেজুর গাছ, সাঁকো, মাছ ধরা, শাপলা ফোটা বিল, পাখি, গ্রামীণ জনজীবন, এসব অতি পরিচিত এবং নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাদের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকার সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত এসব। কিন্তু এসব নিয়ে যে নিজেদের ছেলেরাই রঙে-রেখায় ফুটিয়ে তুলতে পারে অসাধারণ শিল্পকর্ম, এ ধারণা হয়তো তারা কোনোদিন করেওনি বা ভাবেওনা। কিন্তু আজ তারা শিল্পকর্মে প্রবেশ করেছে চারু ও কারুকলা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে। চমৎকার পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করছে। এটি আমার কাছে অত্যন্ত গর্বের বিষয়। নিশ্চয়ই দর্শকরা তাদের চিরাচরিত পরিবেশকে খুঁজে পেয়েছে মিলনায়তনের দেয়ালে টাঙানো ফ্রেমের মাঝে আঁকা চিত্র থেকে। ৭ জন তরুণ শিল্পীর প্রায় ৪০টি শিল্পকর্ম স্থান পায় প্রদর্শনীতে। কিশোর-নারী-পুরুষ সব বয়সের মানুষ তাদের সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছে এক ভিন্ন স্বাদে, আপনসত্তার অনুভবে। শিল্পের জয় সেখানেই যখন দর্শক-শ্রোতার অন্তর ছুঁয়ে যায়, সার্থকতা সেখানেই যখন মনকে সসীম থেকে অসীমে নিয়ে যায়। শ্রম-স্বেদেরও যে রূপ আছে, তা হয়তো কৃষক-শ্রমিক নিজেরাই জানে না। কিন্তু ছবিতে তা অপরূপ হয়ে ধরা পড়ে। শুধুই কি ছবি আঁকার কাজ! অনেকে আবার বইও লিখছেন। আপনজনদের লেখা বই নেড়েচেড়ে দেখছেন গভীর আগ্রহ নিয়ে।

কান্দি ইউনিয়নসহ কোটালিপাড়ায় অনেকে শিক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং রেখে চলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অবদান রাখা ২৫ জন গুণিজনকে সম্মাননা প্রদান করেছে সংগঠনটি। এরমধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাবেক প্রধান শিক্ষক তরণীকান্ত অধিকারী, সাবেক প্রধান শিক্ষক সহদেব বৈদ্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী অনিল কুমার দে, সাবেক অধ্যক্ষ নিত্যানন্দ বিশ্বাস, অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ বাড়ৈ, মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক, সাবেক অধ্যক্ষ গৌরাঙ্গলাল চৌধুরীসহ আরো অনেকে ছিলেন। কয়েকদিনের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ও শারদীয় বইমেলা। শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক ও চিত্রশিল্পী আশরাফুল আলম পপলু এবং শারদীয় বইমেলার উদ্বোধন করেন কথাসাহিত্যিক ও বাংলাদেশ কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার অরুণ কুমার বিশ্বাস। এভাবে একটি সফল ও সুন্দর অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়েছে আমরা যেন ক্রমে সভ্য পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে ওঠার পথে হাঁটছি। এ এক ভিন্ন মাত্রা বটে; একইসঙ্গে অপার আনন্দ।

আর কিছু না হোক, এ ভিন্নমাত্রার স্বাদটুকুন তো অন্তত ‘কান্দি ইউনিয়ন যুব সংঘ-ঢাকা’ এলাকার সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরেছে। তার চেয়েও বড় কথা, তারা এভাবে শুরু করে সাংস্কৃতিক জাগরণের একটি পথও খুলে দিয়েছে। সেতুবন্ধনের এ মহৎ কাজটুকু করে সংগঠনটি ও তাদের সদস্যরা নিজেদের দায়িত্বের মধ্যে নিয়ে গেছে। পাশাপাশি এ কাজে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন সেসব গুণিজন, সম্মানিত উদ্বোধক ও অতিথিবৃন্দ, সাংবাদিক, সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, কোটালিপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিমলকৃষ্ণ বিশ্বাস ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধি এবং বাইরে থেকেও যাঁরা সমর্থন দিয়েছেন তাঁদের সকলের সহযোগিতায় অনুষ্ঠানটি সফল ও সার্থক হয়েছে বলে মনে করি।

যাঁদের জন্য এ আয়োজন সেই সর্বসাধারণের বিপুল উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে, মৌলিকা চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তাঁরা আজ এক উজ্জ্বল সমাজের প্রত্যাশী। সকল কূপমণ্ডুকতা পরিহার করে একটি সংস্কৃতিবান ও রুচিশীল সমাজ, দেশ গড়ার জন্য তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কান্দি ইউনিয়ন যুব সংঘ-ঢাকার সাবেক সভাপতি প্রশান্ত অধিকারীর আন্তরিকতা, উদ্যোগ ও পরিকল্পনা এবং সংঘের বর্তমান সদস্যদের কর্ম-তৎপরতার ফলেই আয়োজনটি সফল ও সুন্দর হয়েছে। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য এটি অন্যান্য এলাকাতেও উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাবে এবং কোটালিপাড়ায় কোনো ধরনের অপসংস্কৃতির আয়োজন থেকে বিরত রাখতে প্রভাবিত করবে বলে বিশ্বাস করি।

গোপাল বাগচী: লেখক-প্রকৌশলী, পরিচালক, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ

মন্তব্য করুন

daraz
  • শিল্প-সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বর্ষবরণে সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজন
সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত
আজ পবিত্র শবেকদর
করোনায় আরও একজনের মৃত্যু
X
Fresh