• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
logo

বিশ্বস্ত বিন্যাস

সালমান তারেক শাকিল

  ০৮ মার্চ ২০১৮, ১৪:৪৪

সেবছর প্রথমবার অন্ময়ীর মুখোমুখি হই। ওর মুখে হাসি লাজুক-লাজুক শুটিংয়ের কস্টিউম গায়ে, আমার মুখেও হাসি। কিন্তু উভয়ই প্রকাশ করছি না। আমি আমার রিপোর্টিংয়ের শক্ত ভাবনা চেহারায় ধরে রাখার চেষ্টায় অবিরত স্বাভাবিক থাকছি, আর অন্ময়ীও শুটিংয়ে স্ক্রিপ্টের প্রয়োজনে হাসছে এমন অভিব্যক্তি। আদতে আমরা দুজনেই দুজনের প্রথম দর্শনে অবাক বিস্ময় আর লজ্জায় ভারাক্রান্ত-দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম।

উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর ধরে লেকব্রিজ পার হয়ে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই ১২ নম্বর রোডের একটি বাড়ি। বাড়িটি শুটিংয়ের জন্যই কর্তাব্যক্তি বানিয়েছেন- এমন বাড়িতে এখন হরদম নাটকের শুটিং হয়। শুটিংয়ের ব্যাপার-স্যাপার তখনো আমার অনেক অপরিচিত, এমনকি এখনঅব্দি। বন্ধু স্বাধীন সিরাজী শুটিং, স্ক্রিপ্ট, লাইট, মেকাপ, কস্টিউম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা না দিলে একরকম অজ্ঞই, যতটা আমার আব্বা অজ্ঞ স্মার্ট ফোন সম্পর্কে।

প্রথমদিকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যখন মোবাইল ফোন যায়, একদিন রমজানে হঠাৎই ঢাকা থেকে খবর যায় আমার বড় ভাই আক্রান্ত হয়েছেন। পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে গেছে। এই খবর বাড়িতে পৌঁছায় তখন, যখন রমজানে তারাবির নামাজ আদায় করে আব্বা সবেমাত্র ঘরে ঢুকেছেন। আমাদের পুরনো বাড়ির মাঝখানের কক্ষটায় তখন মোবাইলফোনটি রাখা ছিল আর তাতে টেলিভিশনের এন্টেনার মতো একটি এন্টেনার তারও যুক্ত ছিল। এন্টেনাটি আমাদের বাড়ির মাঝখানের ঘর বরাবর সোজা আকাশের দিকে। লম্বা বরাকবাঁশে এন্টেনাটি স্থাপন করায় অনেক দূর থেকে অর্থাৎ দেড় কিলোমিটার দূরে আমাদের বাজার থেকেও বুঝা যেত- এইযে হাফিজ মিনহাজ উদ্দিনের বাড়িতে মোবাইল ফোন আছে। আব্বা নামাজ পড়ে এসে বড় ছেলের সংবাদ শুনে আম্মা, ছোটাপা আর আমার সাথে একই খাটে বসে মোবাইল ফোনে মনোযোগ দিলেন। বারবার কল করছি ঢাকায়- একে-ওকে। এরইমধ্যে কাউকে ফোন করতে গিয়ে তার নম্বর বন্ধ পাই- বলি, ‘আম্মা খুরসত ভাইয়ের নম্বর তো বন্ধ বলে।’ আব্বা পাশ থেকে জানতে চায়, কী বলে? আমি বলি, ‘এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব না।’আব্বা এবার স্বভাবজাত রাগেন, বলেন, ‘আরে বল না একটু লাইনটা দিতে।’আব্বার কথা শুনে আমরা বড় ভাই আমজাদের থানায় ঝামেলা করার দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েও ভ্যাক করে হেসে উঠি। অবশ্যই শুটিংয়ের ব্যাপার-স্যাপারে আমাকে নিয়ে কেউ এভাবে হাসেনি। তবে অন্ময়ী হেসেছে এভাবেই, আমাকে বোকা-বোকা রেখে। আর আমিও অন্ময়ীর ভ্যাক-ভ্যাক হাসিতে চিৎপটাং হয়েছি। ওর সাদা দাঁত যখন আমার সামনে বা মোবাইল ফোনে মেলে ধরে, সত্যিকার অর্থে আমাকে ভুলে যেতে হয় যে আমার হাতে একটা বিশেষ প্রতিবেদন আছে। এমনকি অন্ময়ী রহস্যময়ী- ওর নিত্যচলাফেরা নিয়ে। শুটিং না বুঝলেও এটা সম্ভবত বয়সের কারণে বুঝেছি, নারীরা রহস্যময়ী হয়, এটাই তাদের ধর্ম। কিন্তু অন্ময়ীর রহস্যময়তা আরও বেশি দ্বিধার, আরও বেশি বিভ্রান্তকর- এমনই যে কখনো-কখনো গহীন বনে হারিয়ে গেলে যে বোধ হয়। ব্যক্তিগত জীবনে গহীন বনে হারিয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ তৈরি না হলেও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে গভীর বনে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে নানা সময়ে নানা অনুষ্ঠান হয়েছে। ওই সব অনুষ্ঠান আমার খুবই প্রিয়। এমনকি খুব মধ্যরাতে চ্যানেলে রাতের কোনও দৃশ্য দেখালে নিজেকেও সেখানে আবিষ্কার করি। বিশেষ করে ভদকার গ্লাস হাতে থাকলে স্বেচ্ছায় ডুবে যাই গহীনে। গভীর জঙ্গলে। যেখানে অজানা শত্রুর বসবাস। নিশ্চিতভাবে জেনেও আমি শত্রুর অবস্থানে আমার রহস্য বেড়াজাল সৃষ্টি করি কখনো-কখনো। অন্ময়ীর ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি ঘটেছে বলে অনুভব করি। আমার ধারণা, অন্ময়ীর মতো নতুন নায়িকা এবং ছলছাতুরিহীন মেয়ের রহস্যময়তা আরও বেশি গভীর হয়, যে গভীরতা আমাদের পুকুরের। এই গভীরতা আরাধ্য। আমি কখনোই আমার বাল্যজীবন বা কৈশোর- কখনোই আমাদের পুকুরের তলানিতে গিয়ে পলিমাটি তুলে জলের উপরে বেটাগিরি দেখাতে পারিনি। আবার কখনো মনে হয় এই গভীরতা আমার সম্পাদকের যৌন জীবনের মতো, যার কোনও দিকদিশা আমি খুঁজে পাইনি। আমার চারপাশে যৌনসেবীদের বসবাস। অন্ময়ীর কথা বলতে গিয়ে বা গভীরতা মাপতে গিয়ে যৌনজীবনের কথা তোলায় বিষয়টা খানিকটা খটকাই লাগে। তবে এটাও ঠিক, অন্ময়ীর হাসিতে আমি চুমুক দিয়েছি অসংখ্য দিন। অন্ময়ীর খোলা পিঠে ছড়ানো চুল সরিয়ে হাতের স্পর্শে ছুঁয়ে দিয়েছি অনন্ত সময়। ওর ক্যারিয়ারের শুরুর সময়টিতে ছবিতে-ছবিতে আমি অন্ময়ীর প্রত্যেকটি লোমকূপ ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। অন্ময়ী নাও করেনি, হ্যাঁও করেনি। এই সম্মতি-অসম্মতির মাঝখানেই অন্ময়ীর বসবাস। আমি জানি, অন্ময়ী কোনও প্রেম করেনি। কারণ, প্রেম করলে অন্ময়ী ওমন রহস্যময়ী হতে পারতো না। হয়তো ওঁ বুঝে, ওর দ্বিধাই ওর শক্তি। কিন্তু পুরো জীবনে-মানে অন্ময়ীর এই মধ্যবয়স পর্যন্ত অন্ময়ী প্রেমে পড়েনি- এটা আমি মানতেও রাজি নই।

সেদিন আমি ওকে প্রথম সরাসরি দেখতে উত্তরায় চলে যাই, প্রেসক্লাবে আমার বিটের প্রোগ্রাম সত্ত্বেও। মিস করি, দৈনিকের কাজ করার যে সুবিধা, ষোলআনা পূরণ করি- সকাল থেকে দুপুর অব্দি সময় কাটিয়ে অন্ময়ীকে বিদায় বলে আসি। অবশ্য পুরো সময়টার মাত্র পনেরো থেকে বিশ মিনিট আমি থেকেছিলাম অন্ময়ীর শুটিং বাড়িতে। শুটিংবাড়ি আমার চমৎকার অপছন্দের-বিশেষ করে মেকাপ নিয়ে নায়ক-নায়িকাদের যে উপরিভাব উছলে পড়ে, তাতে আমার সাংবাদিক চেতনের আঁতে লাগে। এটা অসম্ভব- যে একজন নায়িকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে। প্রথমবার এ ঘটনা ঘটে ফিল্ম সোসাইটিতে। শহরের সবচেয়ে বড় শুটিং প্লেস।

নায়িকা সুসমিতার স্টোরি-ইন্টারভিউ করার তাগিদে ফিল্ম সোসাইটিতে গিয়েছিলাম অন্ময়ীকে আবিষ্কারের আরও দুবছর আগে। শুটিং বাড়িতে পৌঁছে নায়িকার সঙ্গে দেখা, দু’মিনিট আগেই ফোন করা সাংবাদিক মাত্র দু’মিনিট পর ব্যস্ততার কবলে পড়লেন। নায়িকা তার সোনালী আলুথালু চুল এক হাতে ধরে রেখে আমার সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের কুশল বিনিময়পর্ব সেরে বলে গেলেন, এই যে একটু বসেন, মেকাপটা নিয়ে আসছি। আমিও সুন্দরী নায়িকার খুব কাছ থেকে ঘ্রাণ নেয়ার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনলাম। কিন্তু এই প্রতীক্ষা ধীরে-ধীরে অপেক্ষার প্রগতিতে পড়ে গেলো। দু’ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও নায়িকাকে আসতে না দেখে, প্রডাকশনের একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে শুটিংবাড়ির দুতলায় মেকাপরুমে ঢুকে দেখি নায়িকা নেই, পাশের বারান্দায় বসে পাতলা চেয়ারে পা দুলাচ্ছেন আর চিকন সিগারেট ফুঁকছেন। বাম হাতে বাম কানে ধরা মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কেলাচ্ছেন আর বকবক করছেন। বেশিরভাগ কথাই কোনও বাক্য নেই। ও হ্যাঁ, ইয়েস, নো-নো-ইয়ার, সুইট, ইত্যকার শব্দ বেরুচ্ছে ট্রামের মতো শব্দ করে। নায়িকার অমন ব্যস্ততা দেখে দেরি করিনি, সোজা শুটিংবাড়ি থেকে বেরিয়ে বিকালে অফিসে এসে আমার ইমিডিয়েট বস খালিদ সাইফুল্লাহকে বললাম, ‘বস, কাল থেকে বিনোদন বিট করব না।’পরদিন খালিদ ভাইয়ের সুপারিশে সম্পাদক আমাকে রাজনৈতিক বিটে কাজ করার হুকুম দিলেন। আমিও সানন্দ্যে প্রেসক্লাবের সামনে রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়মিত প্রোগ্রাম করে রাজনৈতিক বিটে হাত মশকো করতে শুরু করলাম।

অন্ময়ীকে আবিষ্কার করার সময় আমি বিনোদন বিটে ছিলাম না, এরপরও ওকে ফেসবুক চ্যাটিংয়ে মিথ্যে বলি- ‘অন্ময়ী আপনি তো বেশ সুন্দর, আপনার একটা ইন্টারভিউ করতে চাই।’ আমাকে অবাক করে দিয়ে কয়েক ঘণ্টা পর অন্ময়ীর ফিরতি মেসেজ- ভাইয়া, আমি তো এখনও কাজই শুরু করিনি। কী ইন্টারভিউ করবেন? অন্ময়ীর চ্যাটে রাজ্যের দ্বিধা, পরিষ্কার একটা মানুষের ছাঁপ দেখে মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিই- এই মেয়েটার সাক্ষাৎকার আমি নেবই এবং বিনোদন বিটে কাজ না করলেও।

দীর্ঘ ছয়মাস পর অন্ময়ী আমাকে জানাল, তার শুটিং হচ্ছে উত্তরায় ১২ নম্বর সেক্টরে। সময় করে শনিবার আসতে।

আমিও প্রস্তুতি নিই দুদিন। বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার এ দুদিনে নিজের যত্ন নিই, বগলের নিচে চুল কেটে নিই, এমনকি উরুসন্ধিরও। আর আমি বরাবরই নতুন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে ফ্রেশ হয়ে যাই- এটা পুরুষ বা নারী। বিশেষ করে সুগন্ধি থাকতেই হবে। আর নিজের সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে সুন্দর-ফিট জামাটিই পরি। সেদিনও ব্যতিক্রম হয়নি। শুক্রবার সন্ধ্যায় চুল কেটে মুখের দাঁড়ি সামান্য রেখে পরদিন শনিবার সকাল ১১টার দিকে অন্ময়ীকে দেখতে হাজির হই। আমি যখন সবুজ সিএনজি থেকে ভাড়া মিটিয়ে নামি, তখনই রাস্তার উপর ফটোগ্রাফারকে দেখি ছবি তুলছে, একটু সামনেই নায়িকার কস্টিউমে অন্ময়ী দাঁড়িয়ে। মুখে লাজুক-লাজুক মৃন্ময়তা। চোখে-মুখে দ্বিধা। আর আমি সমস্ত বিস্ময় বুকে-চোখে নিয়ে তাকিয়ে লজ্জায় পড়তে থাকি। অন্ময়ী শুটিং বাড়ির ভেতরে নিয়ে ছবির পরিচালকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। পেটমোটা, মাথায় ক্যাপ পরা ওই গরমেও, হ্যান্ডশেক করে আমি অন্ময়ীর সঙ্গে টুকটাক কথা বলি। কেমন আছেন, ভালো। আপনি? আমি তো কিছুই করলাম, না। কী সাক্ষাৎকার নেবেন? আমি পকেটে থেকে পত্রিকার প্যাড বের করে দু’তিনটে তথ্য টুকে রাখি। কিন্তু অন্ময়ীর ব্যস্ততা দেখে ভাবি, চলে যাই। আমি দ্বিধায় পড়ে যাই, অন্ময়ীও। শট দিতে গিয়ে উপরে তাকিয়ে আমাকে দেখে, আমিও বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি অন্ময়ীর ঠোঁটের দিকে, ওর গ্রিবার দিকে, বুকের দিকে। আবার লজ্জায় পড়ি, অন্ময়ীও পড়ে। আমার চোখের ভাষা পড়তে পারছিল না কিনা, এ নিয়ে অন্ময়ীকে কোনও দিন জিজ্ঞেস করিনি। তবে একদিন জানতে চেয়েছি, সেটাও বহুদিন পর। প্রায় চারবছর পর। এর মধ্যে অন্ময়ীর সঙ্গে যোগাযোগ বলতে ফেসবুক বা কখনো-কখনো মোবাইল ফোন। ফোন করলেও অন্ময়ী বিরক্ত, আবার চ্যাট করলেও উত্তর আসে বিলম্বে। আমি বুঝতে থাকি, অন্ময়ী আমাকে সরাতে চাইছে কিনা।

অনেকদিন পর অন্ময়ীর কাছে জানতে চাই,

-তুই প্রেম করিস না?

অন্ময়ী হাসিরাগ মৃন্ময় হয়ে উত্তর দেয়

-না।

-সত্যিই?

-বলছি তো, না।

কিন্তু ওর স্ট্যাটাস, লাভ ইমো, এসবে আমার চিন্তা ধরে যায়, যা আর বাকি দুই বছর ছাড়ে না। এই চিন্তা আরও দীর্ঘ হতে থাকে। ওদিকে অন্ময়ীর কোনও ছবি মুক্তি পায় না। ওর কাছে জানতে চাইলে, একটাই উত্তর-

-জানি নারে। আমার তো মনে হয় কোনও ছবিই মুক্তি পাইবো না।

অন্ময়ী হেসে দেয়, ওর হাসি আমার বিশেষ প্রতিবেদন তৈরির ব্যস্ততা থামিয়ে দেয়। ওর হাসির শব্দ আমার মগজে বাজতেই থাকে, আমাদের বাড়ির ঝিঁঝিঁ পোকার মতো দারুণ স্বরে, আমার বিশেষ প্রতিবেদন লেখা বন্ধ হয়ে যায় ওর হাসিতে। এই দীর্ঘ ছয় বছর অন্ময়ীর হাসিতে, তুই-তোকারিতে আমি নিদেন বালক হয়ে থাকি-আমার বয়স বাড়তে থাকে, আমি চল্লিশের কোঠায় পড়তে থাকি, আমার হাঁটুতে জ্যাম ধরে থাকে শাহবাগের মতো, বাংলামোটরের মতো। আমার অস্থিগুলোয় শ্যাওলা ধরে ঢাকা গেটের মতো- অদ্যাবধি এই বয়সেও অন্ময়ীর হাসিতে প্রাণ জুড়িয়ে যায় খুব গরমে ঠাণ্ডা পানি পানের মতো। অন্ময়ী কী বুঝে? নাকি বুঝে না? আমি জানি না।

সেদিন দেখা করে আসার পর দীর্ঘদিন সরাসরি দেখাদেখি বন্ধ থাকে। অন্ময়ীও চুপ থাকে। সেই রহস্যময়তা ধারণ করে হেজাবি নারীর মতো, কালো, অন্ধকার। না কিছু দেখা যায়, না ছুঁয়ে দেওয়া যায়-পর্দানশীন নারীর চিৎকারের ভয়ে।

এই রহস্যময়তা একদিন ভেঙে দিই, অন্ময়ীও সেদিন আগে থেকে টের পেয়ে গিয়েছিল কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, অন্ময়ী রাগ করবে, রাগের ভূমিতে বেমক্কা ভূমিকম্পের মতো নড়ে উঠবে কিন্তু অন্ময়ী সেদিন জমে গিয়েছিল, বরফের মতো জমে থাকা আমি কখনো সরাসরি দেখিনি কিন্তু বরফ ছুঁয়েছি, শীতল, ঠাণ্ডা। অন্ময়ীও লিফটের ভেতরে আমার হঠাৎ ঠোঁটস্পর্শে থমকে গিয়েছিল, শীতল। এরপর প্রায় দুই ঘণ্টা অন্ময়ী আমার বাইকের পেছনে হাতদুটো শক্ত করে আমাকে এড়িয়ে স্ট্যান্ডে ধরেছিল। আমি অন্ময়ীর ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়ার আনন্দে বাইকে বেশি-বেশি হর্ন দিচ্ছিলাম। আর বহু পুরনো আরএক্স হোন্ডাটি নতুন মডেলের হরনেক্স হয়ে ওঠে। স্পিডে চালিয়ে-চালিয়ে ঠোঁট স্পর্শের উদযাপন করছিলাম।

সেদিন খুব কম কথা হয়েছিল দুজনের। এক প্লেট স্যুপ খেতে না পেরে বন্ধুদের দিতে হয়েছিল।

দুই.

অন্ময়ী আমাকে বলে,

-ভাবিকে নিয়ে ঘুরে আয়।

ভাবি বলতে আমার স্ত্রী, শমরিতা। অন্ময়ীকে শুরুতেই বলেছিলাম নিজের বিবাহের কথা, আমার সংসারের দুজনের অমিলের কথা। আমাদের দুজনের নানা বিবাদের কথা অন্ময়ীকে রাত-বিরাতে শুনিয়েছি। কিন্তু শুরু থেকেই অন্ময়ী স্ত্রীকে সঙ্গে রাখার কথা বলেছে। এও আবার সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে।

-ভাবিকে একদিন দেখতে আসবো।

-আসিস। আমি জানি, অন্ময়ীকে আমি বাসায় নেব না। যতদিন আমার স্ত্রী আছে। কারণ, প্রেম করার সুবাদে আমার মুখে আমার পছন্দের নারীর সব গুণের কথা জেনে এসেছে শমরিতা। শ্যামবর্ণ, বাদামের খোসার মতো ঠোঁট, সরুবাহু, বাহুলব্ধ কালো ত্বক, সতেজ চাউনি আর খোলা তরমুজের মতো টকটকে হাসি-আমার প্রিয়। আর এই নিজস্ব সৌন্দর্যের বিত্তবৈভবধারী একমাত্রই অন্ময়ী -সেটি তার ফেসবুকওয়ালের সূত্রে আমার স্ত্রী শমরিতার জানা ছিল। শমরিতা জানে, অন্ময়ীই আমার পছন্দের আদর্শ। এমনকি অন্ময়ীর জন্য আমি নিজেকে তলিয়ে দিতে পারি গোপনে-বিভাজনে, এও টের পেয়ে আমার স্ত্রী আমার অজান্তে তাকে একদিন ব্লক মেরে দেন। যদিও আমি খানিকটা মিথ্যে বলে অন্ময়ীর কাছ থেকে আবার ফ্রেন্ড একসেপ্ট আদায় করেছি।

অন্ময়ীর কথা শুনে আমি এড়িয়ে যাই, আর মনে-মনে চিত্রকল্প ও চিত্রনাট্য সাজাতে থাকি, অন্ময়ীকে মনের কথা খুলে বলব, এও বলব,

-তুই নায়িকা হ বা অনায়িকা। আমি তোকে ভালোবাসি। বিয়ে করব।

-কাকে বিয়ে করবি?

একদিন আমার প্রশ্নে অন্ময়ীর অকপট উত্তর ছিল,

-অনেক টাকাওয়ালা, যার অনেক পয়সা থাকবে, তাকে। যে আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

আমি এরপর ওই প্রসঙ্গ সামনে তুলিনি। অন্ময়ীও এড়িয়ে গেছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমার মতো দু-চার পয়সার সাংবাদিক-প্রেমিককে মানসিকভাবে দুর্বল করতে এরচে ভালো পদ্ধতি নেই। কারণ, আমার এখনও বিশ্বাস, অন্ময়ী সেদিন সত্য কথাটি গোপন করেছে। এটাই ওঁ বলতে চেয়েছিল,

-তোকেই বিয়ে করব, তোকেই ভালোবাসব।

আমার বিবাহিত জীবন ও স্ত্রী শমরিতার কথা ভেবে, আমাকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে অন্ময়ী, আর এটাই আমার পোক্ত ধারণা।

তিন.

শেষ বছরের শেষ মাস। মাসের শেষ শুক্রবার রাত নটায় মতিঝিলের একটি হল থেকে বেরিয়েই নিজের সদ্য শুটিং শেষ করা গান দেখাতে চাইলো অন্ময়ী। আমিও সানন্দ্যে সহাস্যে সম্মতি জানিয়ে ওর ব্যক্তিগত গাড়িতে ঢুকলাম। প্লেয়ারে ওর গান ছেড়ে পেছনে বসে পড়লো অন্ময়ী। আমি ড্রাইভিং সিটে বসে প্লেয়ারে চোখ রেখে পুরো গান দেখলাম। অন্ময়ী জানতে চাওয়ার আগেই বললাম,

-মেকাপটা একটু খাপছাড়া ছিল।

-হুমম, সেটা জানি।

-বাকি গানটা ভালো ছিল।

এরপর গাড়িতে ওর ভাই-বোন দুটো বসে পড়লো। শেলী ও হৃদয় ওঁদের বোনের গাড়ি নিয়েই এসেছিলে সিনেমা দেখতে। আমি আর অন্ময়ী বাইকে চড়ে আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। আগেরবার হোন্ডা-আরএক্স বাইকটি স্পিডে চালালেও আজকে তেমন গতি এলো না। অন্ময়ী আমার কাঁধে ডান হাত রেখে বসে আছে। আমার সামনে অসংখ্য লাইট, রঙ-বেরঙের লোকাল ও ননস্টপ বাস আর প্রাইভেট কার। মহানগরীর কোলাহল আর হর্ন- আমার কানের কাছে থেমে যাচ্ছিল, তখন দুই-চোখে আমার প্রত্যেকটা গাড়ির পেছনের গ্লাসে সিনেমার পর্দার মতো অন্ময়ীর সঙ্গে চিত্রনায়ক হায়দারের হাতে-পিঠে জড়াজড়ি করা গানটি ভাসছিল।

গ্রিনরোড

৬ মার্চ রাত ২টা।

ঢাকা

মন্তব্য করুন

daraz
  • শিল্প-সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বিএনপি এদেশের সাম্প্রদায়িকতার বিশ্বস্ত ঠিকানা : কাদের
X
Fresh