• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

রিপনচন্দ্র মল্লিকের গল্প ‘স্বর্ণসন্তান’

অনলাইন ডেস্ক
  ২৯ অক্টোবর ২০২১, ২১:১৬
স্বর্ণসন্তান’
কথাসাহিত্যিক রিপনচন্দ্র মল্লিক, ছবি : ফেসবুক থেকে নেওয়া

ধান-গম, সরিষা-আলু কিংবা আরও অনেক রবিশস্যের ভেতর দিয়ে কিলবিল করে চলা সাপের মতোনই আমাকে ফেলে রাখা হয়েছে। এভাবে ফেলে রাখা বলা ঠিক হবে না; তার চেয়ে বলতে পারি আমাকে এভাবেই জন্ম দেয়া হয়েছে। সেই কবে থেকে এই সময়ের কোনো মানুষ কিংবা কোনো বৃদ্ধ অথবা বৃদ্ধাও সে কথা সঠিকভাবে বলতে পারবে না। অথচ, আমি এখানে পড়ে আছি বছরের পর বছর। হয়তো কোনো কোনো মানুষ, যিনি ইতিহাসের খোঁজখবর রাখেন, এমন হাতেগোনা, খুবই কমসংখ্যক ইতিহাসবিদগণ কিছুটা আন্দাজে অথবা মিনমিন করে; কিছুটা সংশয় নিয়ে বলে থাকেন-এখানে আমার জন্ম নাকি তিনশ বছরের অধিককাল আগে হতে পারে। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেন, আটশ বছর থেকে এক হাজার বছরের কম নয়। আবার অন্য কোনো ইতিহাসবিদ বলেন, এক হাজার পাঁচশ বছর থেকে দুই হাজার বছর আগেই জন্ম হয়েছিল; অথবা কোনো কোনো বিদ্যান প্রিন্সিপাল নিজেকে অন্যদের চেয়ে জ্ঞানে-গুণে আরেকটু এগিয়ে নিতে বলে থাকেন, সম্রাট বিন্দুসার আমলের, আরও অনেক আগে থেকেই এই সমতলের জলাভূমির জনমানুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই হাতে হাতে আমাকে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু অক্ষমতার কারণে আমি তাদের বলতে পারছি না এখানে যখন কোনো মানুষের বসতি ছিল না; ছিল ঝোপ-জঙ্গল আর বিল-বাঁওড়ের জলাভূমি; অথবা মরে যাওয়া সাগরের বেলাভূমি, ঠিক তখন থেকেই আমি এখানকার জীবজন্তুদের পদরেখায়-রেখায় মিলেমিশে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সরু হয়ে জন্ম নিয়েছি। আমার মনে আছে, আমি জন্ম নেওয়ার কয়েক হাজার বছর পরেই প্রথমবারের মতো মানুষের পায়ের তলার ছোঁয়া পাই। যখন কয়েক হাজার বছর আগে প্রথম মানুষের পদচিহ্ন এসে আমার গায়ে লাগল তারপর থেকে একটু একটু করে আমিও কেমন করে যেন বদলে যেতে থাকি কেবল বদলে যেতেই থাকি। যদি খুব সহজ করে বলি তাহলে বলতে পারেন যেদিন মানুষের পায়ের ছাপ এসে আমার গায়ে পড়ল, আমি মূলত সেদিন থেকেই আধুনিক হয়ে উঠতে শুরু করি। মূলত মানুষের সংস্পর্শ পেয়েই আমার আজকের যে রূপ আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, সেটি সেই প্রথম স্পর্শের দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। তখন একদল মানুষ এসে বলাবলি করল, এই ঝোপ-জঙ্গল আর বিল-বাঁওড়ের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে চলার পথ বানাতে হবে।

সেই পথ ধরে আমরা যারা এখানে আছি কিংবা বেঁচে থাকব এবং আগামীতে যেসব মানুষ এই জনপদে আগত হবে, তারা সবাই যেন এই পথ দিয়ে হেঁটে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে চলে যেতে পারে, যেখানে যার সাধ হয়। সেই যে আমাকে বানানোর কাজ শুরু হলো তারপর থেকে আমাকে বানানো চলছেই আর চলছেই। আমিও হতে থাকি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহুরূপী। ফেলে আসা এই দীর্ঘসময়ে কত রূপে যে আমি বদলে গিয়েছি কিংবা এখনও বদলে যেতে থাকি কিংবা আগামীতে আরও বদলে যাব, সে কথা একটু খোলাসা করে, মানে একটু দীর্ঘ সময় নিয়ে না বললে কিছুতেই কিচ্ছু বলা হবে না। আমার এখন যে রূপ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এই তো গত দেড়শ বছর আগেও কিন্তু আমার রূপ মোটেও এই রকম ছিল না। তখন আমি মূলত ছিলাম একটি দীর্ঘ মেঠোপথ। যদিও সেই পথের বাঁকে বাঁকে কিংবা কিছু দূরত্বের ব্যবধান শেষে, শেষে নদী-নালা, বিল, হাওড়-বাঁওড় কিংবা বড়সর ডোবার উপস্থিতিতে আমি খণ্ডে খণ্ডে কেলবই এক অখণ্ড দীর্ঘ পথই ছিলাম। তখনের সেই রূপ, এখন কেউই বিশ্বাস করতে চাইবে না অথবা এখন সত্যিই তা কাউকে বিশ্বাস করানো আমার পক্ষেও খুবই মুশকিল হয়ে গেছে।

এখন যদি কোনো তরুণ অথবা কোনো তরুণী অথবা প্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারী-পুরুষ কিংবা মুখভর্তি ফকফকে দাড়ি-চুল, হাত-পায়ের খসখসে চামড়া; এমন যেকোনো মানুষকে ধরে এনে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে- ‘গত কয়েকশ বছর আগে আমার রূপ কেমন ছিল?’ আমি নিশ্চিত, শুধু নিশ্চিতই নয়, একশ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, এই ধরনের একটি প্রশ্ন শুনেই ওইসব মানুষের চোখে-মুখে তখন অসহায়ত্ব ফুটে উঠবে অথবা তারা কেউ কেউ বলতে চেষ্টা করবে, এই দীর্ঘ পথের রূপ তো একশ বছর আগে আর কেমনই-বা ছিল? এখন যে রকম দেখা যাচ্ছে, ঠিক এ রকমই হয়তো ছিল। তবে তা হয়তো এখনের তুলনায় আরও কিছুটা খারাপ ছিল। আমার একশ বছর আগে যে রূপ ছিল, তা কেউ জানে না। অথচ, আমার রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমিও এই বাংলায় গত দেড়শ বছরের ইতিহাসও দ্রুত থেকে দ্রুততর বদলে যেতে দেখেছি। এই আমি কত ঘটনার এক নীরব সাক্ষী হয়ে আছি, সে কথা আর বলে শেষ করতে পারব না। অথচ আমাকে কেউ ওইভাবে চিন্তা করতে পারে না। কিংবা আমাকেও দেয়নি কেউ সেই স্বীকৃতিটুকু। ধরুন, আমি জন্মের পর থেকে কত রাজা, কত সম্রাট আর কত সুলতান, নবাবের সম্পদ হয়েছিলাম। আজ তাদের কতজনের নাম মানুষ ভুলে গেছে। সবার নাম মনে রাখাও যে অনেক কঠিন। মনে রাখা শুধু কঠিনই আমি বলব না, আসলে মনে রাখা সম্ভব নয়। সময়ের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমিও হয়তো অনেকের নামও ভুলে গেছি। তবুও কম তো আর দেখলাম না।

সবশেষ এই তো কয়েকশ বছর আগের কথা- নবাব সিরাজউদ্দৌলার মালিকানা থেকে আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিকানার হয়ে গেলাম। নবাবি আমলে আমি যে খুব ভালো অবস্থায় ছিলাম, সে কথা আমি মোটা দাগে হলফ করে বলতে চাই না। তখন আমি কাঁচামাটির আস্তরণে তৈরি হয়েছি। মেঘদেবতা আমার গায়ে এসে ঝরঝরিয়ে গড়িয়ে পড়লেই আমি প্রকৃতির মতো নরম হয়ে যেতাম। আমাকে তখন কেউই সহ্য করতে পারত না। তখন আমার দেহের ওপর দিয়ে মালবাহী কিংবা মানুষবাহী গরুর অথবা ঘোড়ার গাড়ি টংটং করে চলত। কখনো কখনো গরুর গাড়ির চাকা আমার শরীরে এমনভাবে দেবে যেত যে, গরু আর হাঁটতেই পারত না। তবে শুকনোর সময়ে অবশ্য বেশ ব্যস্তই থাকতে হতো আমাকে। সারাক্ষণ আমার গায়ের ওপর দিয়ে তখন মানুষ চলাচল করতেই থাকত। তখন গাড়িয়াল ভাইয়েরা বাতাসের মতোন প্রফুল্লচিত্তে গান ধরে, কখনো সুরে আবার কখনো বেসুরে গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে ছুটে চলত। তারপর এই সময়ের ব্যবধানে আমাকে কত যে বদলে যেতে হয়েছে, সেই হিসাব রাখা আমার পক্ষেও সম্ভব ছিল না কিংবা এখনও নেই।
তবে আমি যত রাজা, সম্রাট, মহারানির অধীনে ছিলাম, এদের ভেতরে পাকিস্তান আমলই আমার সবচেয়ে অসহ্য কাল ছিল। সবচেয়ে ক্লান্তিকর, ঘৃণা এবং ক্ষত-বিক্ষতময় যেন এক অনন্ত বেদনার কাল ছিল। উফ! সে সময় কী যে অসহ্য লাগত। সেই তেইশ বছর আমার গায়ে পড়েনি একটুকু শুশ্রুষার আঁচড়। আমাকে কেবল ব্যবহারই করা হয়েছে। সেই মেঠোপথ; প্রকৃতির প্রয়োজনে রূপের পরিবর্তন করে করে আমি যখন ক্লান্ত ঠিক তখনই ইংরেজ সাহেবরা আমার রূপের বড় পরিবর্তন করে ফেলে, যাতে আমিও বিস্মিত হয়ে যাই।

তখন কেবল আমার গায়ের ওপর দিয়ে সারি সারি ইটের নকশা এঁকে আমাকে আগের থেকে আরও বেশি মজবুত করা হয়েছে। তারপর থেকে বড় বড় ট্রাক-লড়ি, বাস আমার গায়ের ওপর দিয়ে শুধু চলেছেই আর চলেছেই। শুধু চললেই কী হবে? ইংরেজরা যখন বাংলায় এসে বাড়িঘর বানাতে লাগল, তখন কিন্তু আমার যৌবনের শুরু হয়েছিল এবং আমি তখন থেকে দিনে দিনে কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে শুরু করেছি। এই যেমন ধরুন সেই হাজার বছর আগে যেখানে আমার রেখায়-রেখায় ডোবা, নদী-নালা, জলাশয় কিংবা বড়সব ডোবা, বিল, বাঁওড় ছিল। সাদা মানুষগুলো এ দেশে আসার পর থেকে এসব ডোবা, নদী-নালা, জলাশয় কিংবা বড় সব ডোবা, বিল, বাঁওড়ের আশেপাশে দিয়ে কিংবা কোথাও কোথাও ব্রিজ-কালভার্ট কিংবা পোল বানিয়ে বানিয়ে আমাকে দীর্ঘ করা হয়েছে।

তখন আমার গায়ের ওপর দিয়ে শত শত কিংবা কখনো কখনো হাজার সৈন্যসামন্ত ঘোড়া নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছে। আমি তখন আমার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছি। আমি তখন বুঝতে শিখেছি আমি আসলে এই ভূখণ্ডের মানুষের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। এভাবেই চলতে থাকল দুইশ বছর। আমিও ধীরে ধীরে রূপ পাল্টাতে থাকি। তারচেয়ে বলি, আমার রূপ পাল্টাতে থাকে। পাল্টাতে পাল্টাতে আমি বেশ পাল্টে যেতেও পছন্দ করতে শুরু করি। তারপর থেকে আমার রূপ-সৌন্দর্য পাল্টানোর প্রক্রিয়া শুরু হলেই আমি মূলত খুশিতে টগবগ করতে থাকি। আসলে সবাই তার নিজের ভালো পরিবর্তন চায়। আমিও বেশ উপভোগ করতে থাকি। মেঠোপথ থেকে ইটের রাস্তায়, ইটের রাস্তা থেকে একদিন ইট-পাথরের হয়ে উঠি। দিনে দিনে কখন যেন আমি ইট-পাথরের সড়ক হয়ে যাই; আমি নিজেও তা টের পাই না। একদিন দেখি আমাকে ভেঙে ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা শুরু করে দিয়েছে। মানুষ বলাবলি করছিল, আমি যখন পাকা সড়ক হয়ে উঠি তখন নাকি আমরা প্রথমবার স্বাধীন হয়েছি। উর্দিরা নাকি আমাদের শাসন করে। আমাদের বাংলা হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। আমরা নাকি পাকিস্তানি। পাক মানে পবিত্র এবং স্থান মানে জায়গা বা জমিন। আমাদের বাংলাকেও পবিত্র জমিনের অংশ করে নেওয়া হয়েছে। এমন অর্জনে তখন মানুষের চোখে-মুখে দেখি বিলের জলের বাতাসে দুলতে থাকা শাপলা ফুলের পাপড়ির মতো আলোকিত খুশির ঝিলিক। কিন্তু তারপর থেকে দিন যায়, মাস যায়, বছরও চলে যায়। শুধু কি বছর! এককথায় বলতে পারি বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ চলে যায়। তবুও আমার আর কখনো সৌন্দর্য বাড়েনি। দিনে দিনে রূপ-যৌবনের সব সৌন্দর্য কমতে কমতে এখন আমি এতটাই ভাঙাচোরা হয়ে পড়েছি যে, আমাকে আর কেউ পছন্দ করছে না। সারাক্ষণ আমার ভাঙাচোরা দেহের ওপর দিয়ে যখন মানুষেরা চলাচল করে, তখনই শুনি তাদের চোখে-মুখে অশান্তির ছাপ। মুখ ফুটে ঝরতে থাকে উর্দি শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। আমার দেহের ওপর দিয়ে বছরের পর বছর ধরে গাড়িঘোড়া চলাচল করতে করতে আমার এই দীর্ঘ দেহখানা যে খানা-খন্দকে এবড়োখেবড়ো হয়ে সারা দেহ অসুখে ভরে গেছে, সেদিকে ওই উর্দি শাসকদের কোনো খেয়াল নেই। আমাকে তো চিকিৎসা করাতে হবে। সংস্কার নামের চিকিৎসা না করালে আমি যে মানুষকে সার্ভিস দিতে পারছি না, সেই ভাবনা তখন উর্দিদের মাথায় আসতে চাইত না।

আমার সারা শরীরে এত বড় বড় গর্ত হয়েছিল। তখন আমার শরীরজুড়ে গাড়িগুলো চলাচল করার সময়ে সে কী অসহ্য বেদনা অনুভব করতাম। সে কী ভয়াবহ গর্ত! এক একটি গর্ত দেখলে যেকোনো মানুষ ভয় পেয়ে জিহ্বাতে দাঁত বসিয়ে লজ্জা, ঘৃণা কিংবা কষ্ট অথবা তাদের ভেতরে দ্রোহ ফুটিয়ে ওঠাত। তখন যারা আমার গায়ের ওপর দিয়ে যানবাহন চালিয়ে চলে যেতেন, তাদেরও খুব কষ্ট পেতে হতো। আমার শরীরের সমস্ত জায়গাজুড়ে এত বড় বড় গর্ত যে, মানুষের সব ধরনের যান চিত-কাত, চিত-কাত হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চালাতে হতো। ফলে তাদেরও গা-গতর ভীষণ ব্যথা হয়ে যেত। তাই হয়তো নিজেদের শরীরের ব্যথায় কুঁকরে উঠে বলত- ‘আইয়ুব খান হালায় কি এই রাস্তাডা এট্টুও চোহে দ্যাহে না। এমন ভাঙা রাস্তা দিয়া কি আর আসা-যাওয়া করা যায়। এর থেইক্কা তো বিটিশরাই ভালো আছিল। মোসলমানরা মিল্লা পাকিস্তান বানাইয়া আমাগো বাঙালি মোসলমানগো লাভ কী হইল? তার চেয়ে ভালো অয়, আমাগো পাকিস্তান থেইক্কা আলাদা কইরা দেউক। আমরা আর হেগো লগে থাকমু না।’ আরেকজন বলে উঠত- ‘এই বাংলা পাকিস্তান বানাইয়া বাঙালিগো কোন লাভ হইছে। শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু নয়, বৌদ্ধ নয়, খ্রিস্টান নয়; কিংবা কোনো আদিবাসী নয়; আমাগো সব ধর্মের বাঙালিগো লাইগাই একটা আলাদা দ্যাশ বানানো লাগে।’ অন্য কোনো একজন বলে ওঠে- ‘শালার উর্দিরা আমাগো বাঙালিগো বাল দিয়াও জিগায় না। শেখ মুজিবের উচিত আমাগো পাকিস্তান থেইক্কা আলাদা কইরা ফ্যালানো। তাইলে যদি দ্যাশটারে বাঙালিরা মিল্লা একখান সোনার বাংলা বানাইতে পারি। সেই দ্যাশটা হইতে পারে আমাগো সোনার সন্তান। আমরা তারে যত্ন কইরা আমাগো মতন গড়ে তুলতে পারতাম।’ এমন ধরনের কথা আমাকে সারা দিনই শুনতে হয়। কেউ না কেউ আমার শরীরের ওপর দিয়ে চলাচলের সময় বলতেই থাকে। এতে বুঝতে পারি, শুধু আমিই কষ্টে আছি, ব্যাপারটা মনে হয় সে রকম নয়। এখানকার সব মানুষই কষ্টে আছে। এখানকার সব মানুষেরই দুঃখ আছে। এখানের সব মানুষের বুকেরই স্বপ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এই আমাকেই ধরুন, আমিও তো এখন আর কোনো স্বপ্ন দেখি না। দেখি না বলে আমি বলতে পারি, এখন আর আমি কোনো ধরনেরই স্বপ্ন দেখতে চাই না। আমার স্বপ্নগুলো এখন হারিয়ে গেছে। এই যে আমি গত কয়েক বছর ধরেই সারা শরীরে খানাখন্দক নিয়ে শুয়ে আছি, কেউ কি এসে-আমার শরীরজুড়ে যে বিশাল বিশাল গর্তের ঘা হয়েছে, কই, কেউ তো এখানে এসে দেখেও যায় না। সংস্কার করে আমার শরীরের ক্ষতগুলোকে সারিয়ে দিয়ে যাবে। উফ! আমি ব্যথা সহ্যই করতে পারি না। যখন আমার দেহের ভাঙাচোরা এসব ক্ষতগুলোর ওপর দিয়ে বড় বড় ভারী যান ছুটে চলে, তখন আমার সে কী কান্নার রোল। চিৎকারের শব্দ, হাহাকার। কখনোই আমার সে বেদনার শব্দ ওই পাকিস্তানি উর্দিরা শুনতে পায় না। শুনবে কী করে? আমার মতো যারা চিৎকার করে, মানুষের কানে নিজেদের আওয়াজ আমরা পৌঁছে দিতে পারি না। যারা অক্ষম, তাদের জন্য কেউ ভাবে না অথবা আমরা বলতে পারি- আমাদের অক্ষমদের কথা কেউ হৃদয়ের গভীরতম সূক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে পরিমাপ করতে পারে না কিংবা করেও না। অথচ, আমরা সবসময় সেসব বোধসম্পন্ন মানুষের মুখের দিকে চেয়ে থাকি, কিন্তু তারা কখনোই আমাদের মুখের দিকে চেয়ে দেখে না।

যদি তারা সত্যিই আমার মতো অক্ষমদের ব্যথা-বেদনা বুঝতে পারত, তবে ঠিকই তারা আমাকে নিয়ে একটু হলেও ভাবতে বসে যেত যে, আমাকে দ্রুত সারিয়ে তোলা দরকার। আমি যে শরীরজুড়ে বিশালাকৃতির জখম (খানা-খন্দক) নিয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছি, সে কথা তারা তাদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে পারত, কিন্তু আমারই দুর্ভাগ্য।

আমিও যে এই দেশ গঠনে কাজ করে যাচ্ছি, সে কথা কাউকেই উপলব্ধি করাতে পারছি না। এত দিনের কিংবা এত দীর্ঘ শত শত, হাজার হাজার বছরের ইতিহাস নাই-বা বলতে গেলাম, শুধুমাত্র গত উনিশশ একাত্তর সালের কথাই ধরুন। আমি কি কম ভূমিকা রেখেছি। এই অঞ্চলের গ্রামের পর গ্রাম, ছোট শহরের পর ছোট শহর, বড় শহরের পর বড় শহর কিংবা কোনো কোনো বিভাগীয় শহরও ছাড়িয়ে গেছে আমার বিস্তৃতি, এসব জনপদের সব ঘটনার এক বোবা সাক্ষী হয়ে রয়েছি। কখনো কখনো আমিও যুদ্ধের প্রধান অংশ হয়েছি, কখনো খণ্ডিত অংশ হয়েছি। আমার মনে পড়ে, সেই উনিশশ একাত্তর সালের কথা। সে বছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার বুকের ওপর দিয়ে শত শত, হাজার হাজার কিংবা লাখ লাখও হতে পারে; তো এত মানুষ ধাই ধাই করে সবাই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছুটে চলেছিল। সবার চোখে-মুখে দ্রোহ, ক্ষোভ, ঘৃণা, আনন্দ আর স্বস্তির চিহ্ন লেপ্টে ছিল। তখন সবার বুকের ভেতরে মশাল জ্বালানোর উত্তাপ দেখেছি। আমার বুকের ওপর দিয়ে তখন দলে দলে যেসব মানুষ ছুটে যাচ্ছিল রেসকোর্সে, তাদের সবার মুখে একই অর্থের সুর মিলেছে, তা হলো-চির মুক্তির উল্লাসধ্বনি। শোষণের শৃঙ্খলা খুলে ফেলার ধ্বনি। নিজেদের অধিকার ভোগ করার অঙ্গীকার ধ্বনি। উর্দিদের শাসনকাল খতমের ধ্বনি। মুজিবের দিকনির্দেশনা শোনার ধ্বনি।

যারা সাতই মার্চ আমার বুকের ওপর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছে, তারা যখন আবার ফিরতে শুরু করেছে। তাদের মুখে মুখে শেখ মুজিবের জয়গান। আমি শুনতে পেয়েছিলাম, রেসকোর্স-ফেরা তরুণেরা বলছেন- শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। আমরা এখন আর উর্দিদের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছি না। পুরোই আলাদা হয়ে যাচ্ছি। আমিও তো এমন খবর শোনার জন্য এতগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি; কিন্তু কিছুতেই এই খবর পাচ্ছিলাম না। আমাদের বিদেশিরাই শাসন করে যাবে, সে আমি এখন আর চাই না। তারা সবসময় নিজেদের প্রয়োজনে আমাদের চুষে চুষে সব নিয়ে যায়। আমাদের প্রয়োজন তারা কখনোই ভাবেনি কিংবা ভাবতে চায়ও না। আমি শুনছি, মানুষেরা বলাবলি করছে- শেখ মুজিব এবার একটা কামের কাম করছে। সাতই মার্চ রেসকোর্সে উর্দিদের থেকে বাংলাদেশ আলাদা করার ঘোষণা দিয়েছে। এই জনপদের মানুষেরাও তাই চাচ্ছিল; যা রেসকোর্সে বলে গেছেন আমাদের নেতা। তাই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এবং শুনতেই পাচ্ছি ঢাকাফেরত মানুষের চোখে-মুখে কী আনন্দ ধরছে, যখন সবাই ঢাকা থেকে ফিরতে শুরু করল, তাদের চোখে-মুখে আবার দেখতে পেলাম সেসব চিহ্ন।

তবে এবার সেই দ্রোহ বেশি শক্তিশালী। শেখ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিয়েছেন। এই ভূখণ্ডকে তিনি শুধু মুসলমান নয়। বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের জন্য এক রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়েছেন। পৃথিবীর বুকে বাঙালিদের জন্য একটি দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তার সেদিনের সেই সভায় যারা যারা উপস্থিত হওয়ার জন্য আমার বুকের ওপর দিয়ে গিয়েছেন, তারা আবার সবাই আমার বুকের ওপর দিয়েই ফিরে এসেছেন। তাদের মুখ থেকে শুধু উল্লাসধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণ হচ্ছিল- ‘এই দেশ শুধু হিন্দুর নয়, নয় এই দেশ শুধু মুসলমানের কিংবা বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের। আমরা বাঙালি, এই দেশ হবে বাংলাদেশ। আহ! এমন একটি দেশ, আমাদের আরও অনেক আগেই দরকার ছিল। কিন্তু আমরা তা পাইনি।’ এমন সব আক্ষেপ ও ক্ষোভ ঝরে পড়ছিল মানুষের মুখে মুখে, আমিও তাদের আত্মার কথোপকথনে মিলেমিশে একাকার হয়েছি।

তখন আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল উর্দিদের অবহেলায় হওয়া আমার শরীরজুড়ে অসুখের দিন বুঝি শেষ হতে যাচ্ছে। আমাদের অসন্তোষের দিন বুঝি শেষ হতে যাচ্ছে। আমাদের ব্যথা-বেদনার দিন বুঝি শেষ হতে যাচ্ছে। আমরা হয়তো শিগগিরই আমাদের স্বর্ণসন্তানকে জন্ম দিতে যাচ্ছি। সেই স্বপ্নের সন্তান আমরা কেবল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কিংবা শতাব্দীর পর শতাব্দী অথবা সহস্রাব্দ বছর ধরেই সেই স্বপ্ন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দেখে আসছে কিংবা এই আমি কালের সাক্ষী হয়ে তা দেখে যাচ্ছি। তো এতদিন ধরে আমার ভাঙাচোরা, ক্ষত-বিক্ষত দেহের ওপর দিয়ে যারা দুর্ভোগে চলাচল করত, তারাই এখন বলতে শুরু করেছে- ‘আমাদের স্বপ্নের সন্তান এই দ্যাশটা স্বাধীন হইলে, এই অসুস্থ সড়কেরও ট্রিটমেন্ট করা হবে। আমরা তখন সবাই আরামে যাতায়াত করতে পারব। আহ! কী সুখই না তখন হবে।’

কথাগুলো শুনে আমার খুব আনন্দ লাগছে। আবার মনের ভেতরে অশনিসংকেতও বেজে উঠছে। ১৯৪৭ সালেও আমার এই দীর্ঘদেহী বুকের ওপর দিয়েই তো মানুষেরা ঢাকায় গেল, আন্দোলন করল, স্বাধীন পাকিস্তান পেল। কিস্তু কই, আমি তো কিছুই পেলাম না। সেই ভাঙাচোরা ক্ষতবিক্ষত সড়ক-দেহ নিয়ে পড়ে আছি তো আছিই। বছরের পর বছর গেল। কই আমার অসুখ তো কেউ সারাল না। আমি তো সেই খানা-খন্দক নিয়েই পড়ে আছি। সারা অঙ্গেই এখন অসুখের বাসা; যা কালো চশমায় শাসকেরা চোখে দেখেনি আর এখনও কেউ দেখছে না। হয়তো আবার স্বাধীনতা পেলেও কোনো শাসক দেখবে না।

সেই সংশয় বুকে থেকেই যাচ্ছে। তারপরেও হোক যত কষ্ট, গ্লানি, বেদনা। তবুও আসুক আমাদের স্বাধীনতা।

পি/টিআই

মন্তব্য করুন

daraz
  • শিল্প-সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh