• ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
logo

সন্তোষ ঢালীর চারটি কবিতা

সন্তোষ ঢালী

  ১০ অক্টোবর ২০২০, ২১:৪৮
Three poems by Santosh Dhali
আমি এই নদীর পার ধরে হেঁটে যেতে চাই যতদূর হাঁটতে পারে পা

[এক]

আমি এই নদীর পার ধরে হেঁটে যেতে চাই

আমি এই নদীর পার ধরে হেঁটে যেতে চাই যতদূর হাঁটতে পারে পা,
লতা, গুল্ম, পোকায়খাওয়া সবুজ, কাঁটাঝোপ, দূরের গ্রাম পেরিয়ে
অগস্ত্যের মতো কাল-কালান্তর-
কুড়ায়ে নেবো দু’পারের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার নুড়িগুলো
এ আমার যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ,
আমার কোনো কষ্ট নেই, পাথরের কষ্ট থাকে না;
নদীজলে মিশে যাওয়া চোখের কষ্ট দেখেছি যেতে যেতে ঘাটের কিনারে,
দেখেছি হৃদয় ভেঙে যাবার অধ্যবসায় সকাল সন্ধ্যা রাতে।
বহু বসন্ত শেষে আরেক বসন্ত- হায় বসন্ত!

সেই থেকে পাথরের হামাগুড়ি অন্তহীন-
আরও হাঁটতে হবে, হাঁটতে হবে এইসব ভাঙাঘাট উপল ডিঙিয়ে?
হাঁটতে হাঁটতে আমিও পাড়ভাঙা নদী হয়ে যাই এই পড়ন্তবেলায়
প্রকৃতি ওদিকে কৃষ্ণচূড়ার লালে লাল,
কার দুঃখের রঙে শিমূলের শাখায় রাতভর আগুন;
দুঃসহ নূপুরের মতো রক্তক্ষত পায়ের পাতায় সীমাহীন ক্লান্তি
আমার কণ্ঠের সুর নিয়ে কোকিল গায় তীরের ফলার চেয়ে ধারালো,
বসন্ত এফোঁড়-ওফোঁড় নিরালা বিকেলে,
এই নদীর পার ধরে আমি হেঁটে যেতে চাই মোহনা যতদূর-

এ আমার জন্মের ঋণ
সন্ধে আসুক পেঁচার কণ্ঠে মৃত্যুর মতো ধীরে
একা ফেলে চলে যাক নীড়েফেরা পাখি, ঘাসফড়িঙের দল
শিমূলফুলের তুলোয় লুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস
আমি হেঁটে যেতে চাই জন্ম-জন্মান্তর এই পথে, এই ধুলোমাটির বিছানায়-

[দুই]

নীলচে আলোর সিম্ফনি

নক্ষত্রখচিত নীলচে আলো ছিল মঞ্চে-
তুমি বসেছিলে সামনের দিকে
আমি তোমার পেছনে একখণ্ড প্রাগৈতিহাসিক পাথর;
আমাকে দেখতে পাওনি তুমি খেয়ালের ভুলে,
পথের পাশে ফুটে থাকলেও দু’একটা বুনোফুল
যেমন পথিক খেয়াল করে না অবলীলায়;
আমি দেখছিলাম তোমাকে-
গেরুয়া রঙের শাড়িতে বেশ মানিয়েছিল,
কণ্ঠে রুদ্রাক্ষের আদলে পোড়ামাটিরঙ মালা- বোষ্টমির মতো;
তোমার খোঁপায় সাদা একটা তারাফুল গোঁজা
তোমার মুখচ্ছবি দেখতে পাইনি আমি,
তাই ফুলটা দেখেই তোমাকে দেখার সাধ মিটিয়েছি।

তখন সেতারে তীব্র ঝালা, বাইরের মেঘগর্জনকে ঢেকেছিল
পাখোয়াজের তুমুল ঝড়, বুকের ভেতর অসম্ভব তোলপাড়,
অশান্ত সমুদ্রের সহস্র ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছিল তোমার পায়ে;
তুমি উদাসীন মৃত নক্ষত্রের মতো অসীম শূন্যে তখন সুর-তরঙ্গে নিমগ্ন।

কখন যেন ঝড় গেল থেমে, আলো গেল নিভে,
স্তব্ধ আকাশ। শান্ত সমুদ্র।
সৈকতে পড়ে আছে ভাঙা সেতার, বিধ্বস্ত পাখোয়াজ
আলপনার মতো কিছু অন্ধকার, বিকলাঙ্গ সুর;
ডানাভাঙা দোয়েলের মতো তার পাশেই
কুঁকড়ে পড়ে আছে আমার মেঘস্নাত মন।

[তিন]

ভোরের অপেক্ষায়

একটা ভোর দেখবো বলে কতটা রাত বিনিদ্র কাটিয়েছি একা
একটা ভোর দেখবো বলে কত পথ, কত সৈকত, কত নদীতীর,
কত টাইগার হিলে ঘুরেছি বহুবার উদ্ভ্রান্তের মতো;
আজও আমার ভোর দেখা হয়নি তেমন করে দু’চোখ ভরে।

মন্দ্রস্বরে ঘুমভাঙা পাখির কণ্ঠে স্বর্গীয় গান
ঘাস আর শিশিরের নিবিড় যুগলবন্দি আলোর সিম্ফনি
অমন করে প্রাণভরে শোনা হলো না কোনোদিন,
আহা, দোয়েলের সেই বাউল বাউল সুর আজও রয়ে গেছে অশ্রুত।

পাখিরা দূরের পথে চলে ডানার সুখে মিষ্টি আলোয়
পরিব্রাজক মেঘের পালকে লাগে পরিযায়ী হাওয়া-
আকাশজুড়ে ভৈরবীর সুরে ফোটা আলোর গান রয়ে গেল স্পর্শের দূরে;

আজ শ্রান্ত হৃদয়, পিপাসার্ত চোখে ভোরের নেশা
নির্ঘুম সহস্র রাতের ক্লান্তি চোখের পাতায়
আসি আসি করেও ভোর আসে না;
একটি ভোরের অপেক্ষায় কত জনম কাটাতে হয়
একালে সেকালে পরকালে?

কুসুমফোটা নিটোল একটা ভোর দেখবো বলে নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছি
অরুণাচলের দিকে-
জানালা খুলে রেখেছি, ভেঙে দিয়েছি দুয়ারের সমস্ত আগল
সেই মোহময় আলো আসবে বলে আমার আঙিনায়;
মেঘেদের নীরব প্রহসন সোনালি ভোর ঢেকে দেয় বারবার অনন্ত তিমিরে,
আমি ভোরের অপেক্ষায় থাকি অনন্ত অনন্তকাল

[চার]

তোমার স্পর্শ থেকে যাক

তোমার পদচিহ্ন থেকে যাক এই গেঁয়ো মাটির কণায়
তোমার স্পর্শ থেকে যাক পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে
তোমার নিশ্বাস জড়িয়ে থাকুক এখানের ভেজা হাওয়ায় প্রতিটা স্পন্দনে;
এই প্রকৃতি তোমার ছোঁয়ায় তোমার স্মৃতিতে ধন্য হতে চায়-

এই মাটি এই বাতাস বলবে একদিন এসেছিলে তুমি সবুজের কাছাকাছি
ভালোবেসে ছুঁয়েছিলে নিবিড় বেদনা কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের আশায়
তোমার স্পর্শে চৈতন্যের শাখায় থরে থরে ফুটেছিল রক্তজবা,
আর এখানের এই জলছোঁয়া মাঠের আত্মারা স্পন্দিত হয়েছিল
পিয়ানোর মতো কোনো টুংটাং মৃদু আর্তনাদে;

উপনিষদের মন্ত্রের মতো গেয়ে উঠেছিল ভোরের দোয়েল
আর তখন তরুণ পাতায় ফাল্গুনি হাওয়া দিয়েছিল অনাঘ্রাত দোল
তোমার সাড়া পেয়ে এই মৃত্তিকামগ্ন সবুজ হেসে উঠেছিল,
শুধু তোমার স্পর্শে এইসব স্বপ্নরা হয়ে উঠেছিল সুগন্ধি ফুল-

তোমার পদচিহ্ন থেকে যাক ঝরা ফুল প্রাণহীন শুকনো পাতায়
কেউ নয়, শুধু এই মাটিকণা রাখবে স্মরণ অনন্ত প্রহর।

সন্তোষ ঢালী: অধ্যাপক, কবি ও গল্পকার

মন্তব্য করুন

daraz
  • শিল্প-সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান
গান, কবিতায় শিশু একাডেমিতে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উদযাপন 
১১১টি কবিতা নিয়ে ননীগোপালের ‘স্পর্শহীন হাতের ছোঁয়া’ বইমেলায়
কবি বঙ্গ রাখালের দুটি কবিতার বই ‘কে বলে দাঁড়িয়ে আছি তোমার অপেক্ষায়’ ও ‘জন্মান্ধ ঘোড়া’ 
X
Fresh