• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

অরুণ কুমার বিশ্বাস-এর ধারাবাহিক ‘আমাদের ব্যোমকেশ বক্সী’

অরুণ কুমার বিশ্বাস

  ০১ অক্টোবর ২০২০, ০২:৩৬
Arun Kumar Biswas's series 'Amader Byomkesh Bokshi'
অঞ্জন দত্ত পরিচালিত ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায়

থানা-পুলিশের সঙ্গে ব্যোমকেশের অম্ল-মধুর সম্পর্ক
শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বক্সী নানা কারণে একটি স্বতন্ত্র গোয়েন্দা চরিত্র হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন। তিনি শুধু সত্যান্বেষী নন, তাঁর চলনে বলনে ঋজুতা, অসম্ভব ধীশক্তি ও পর্যবেক্ষণশীলতা তাকে পাঠকপ্রিয় করে তোলে। থানা-পুলিশের সঙ্গে অবশ্য তার খুব একটা সদ্ভাব ছিল না বরং একরকম আড়াআড়ি যেন সবসময়ই চলে। অবশ্য একথা তিনি বিলক্ষণ জানতেন যে, যেকোনো অপরাধের তদন্ত করতে গেলে প্রাইভেট গোয়েন্দার পক্ষে পুলিশকে পাশ কাটিয়ে তা করা সম্ভব নয়। এই নিয়ে প্রায়শ পুলিশ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে ব্যোমকেশের টক্কর লাগতো। অবশ্য এক্ষেত্রে কোনান ডায়েলের শার্লক হোমস সেই তুলনায় ম্যাচুরিটির পরিচয় দিয়েছেন। ইন্সপেক্টর লেস্ট্রেড কিংবা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে গুড মুডে রেখেই কাজ করতেন মিস্টার হোমস।

কিন্তু ব্যোমকেশ প্রায়শ তা করতেন না। কারণ পুলিশের বড়কর্তা কমিশনারের সঙ্গে তার বেশ জানাশোনা। ফলে অধস্তন অফিসারদের খুব একটা পাত্তা না দিলেও চলে তা তিনি জানতেন। তবে সরাসরি তিনি কিন্তু কলকাতা পুলিশ সম্পর্কে কোনো বাজে মন্তব্য বা উন্নাসিক আচরণ কখনও করেননি; যা কিনা এডগার অ্যালান পো’র চরিত্র অগস্ত দ্যুঁপা হরহামেশাই করতেন। শুধু তাই নয়, দ্যুঁপা মনে করতেন যে প্যারিসের পুলিশ রীতির বাইরে তদন্ত করতেই শেখেনি এবং তারা জানে না ঘটনার ঠিক কোনখানে আলো ফেলতে হয়।

আগেই বলেছি, ব্যোমকেশের চরিত্রে ঋজুতা যেন সেঁটে বসানো আছে। পুলিশ যতই বাধা হয়ে দাঁড়াক, তিনি কিন্তু তার নিজের স্টাইলেই তদন্ত করতেন। ‘অর্থমনর্থম্’ (অগ্রহায়ণ, ১৩৪০) গল্পে পুলিশের সঙ্গে তার টানাপোড়েন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়। দোষ অবশ্য ব্যোমকেশের নয়, করালীবাবুর খুনের কেসে ডেপুটি কমিশনার বিধুবাবু তাকে ডেকে নিয়ে অপমান করলেই তিনিই বা ছেড়ে কথা বলবেন কেন! বলা বাহুল্য, তারা পূর্বপরিচিত এবং বিধুবাবু ব্যোমকেশকে খুব একটা পছন্দও করেন না। নেহাত তার বস পুলিশ কমিশনার বলেছেন বিধায় বিধুবাবু তাকে ফোন করে অকুস্থলে ডেকে নেন।

কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি বাধে। কেসের ব্যাপারে ‘গ্রাম্ভারিভাবে’ বিধুবাবু তাকে জ্ঞান দিতে শুরু করলেন। কিন্তু বিধুবাবুর মুরুব্বীয়ানা তার পছন্দ নয়। তিনি নিজের মতো কাজ করছেন, অমনি ফোঁস করে ওঠেন বিধুবাবু। বললেন, ‘বাজে প্রশ্ন, বাজে প্রশ্ন। একেবারে ফুলিশ!’ একটু পরে ডেপুটি কমিশনার বিধুবাবু আবার বললেন, ‘ঢের হয়েছে এবার উঠুন। যত সব বাজে প্রশ্ন করে বেচারীকে বিরক্ত করবার আপনার দরকার নেই। আপনি ক্রস একজামিন করতে জানেন না।’
ব্যোমকেশ এমনিতে ভদ্রলোক, তবে রেগে গেলে তার অন্য চেহারা। খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো ফুঁসে উঠে বললেন, যদি বার বার বিরক্ত করেন আমি তাহলে কমিশনার সাহেবকে জানাতে বাধ্য হব যে, আপনি আমার অনুসন্ধানে বাধা দিচ্ছেন।’

তার একটু আগে ব্যোমকেশ সত্যবতীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বাড়িতে এ রকম একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেলে পুলিশের অযাচিত উৎপাত কিছু সহ্য করতেই হয়। তাতে ভয়ানক রেগে যান বিধুবাবু। ‘পুলিশের নামে বদনাম দেবেন না। আপনি পুলিশ নন।’ অর্থাৎ ডেপুটি কমিশনার বিধুবাবুর সঙ্গে ব্যোমকেশের সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল- একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যা কিনা একজন ঝানু গোয়েন্দার পক্ষে মোটেও মানানসই নয়।

গোয়েন্দা-পুলিশের প্রতি ব্যোমকেশের খানিক অশ্রদ্ধা যে ছিল তার প্রমাণ পাই শরদিন্দুর ‘অচিন পাখি’ গল্পে। অবশ্য তার পেছনে বিশেষ কারণও ছিল। বীরেনবাবুর মেয়ের বিয়েতে ব্যোমকেশের সঙ্গে দেখা হয় রিটায়ার্ড দুঁদে পুলিশ অফিসার নীলমণি মজুমদারের সঙ্গে। ভদ্রলোক নিজেকে জাহির করতে গিয়ে পুরোনো এক কেসে ব্যোমকেশকে প্রায় চ্যালেঞ্জ করে বসলেন কিংবা বলা যায়, নীলমণি মজুমদার তাঁর বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে চাইলেন। কথায় বলে অতি চালাকের গলায় দড়ি। গলায় শেষে সত্যি সত্যি দড়ি পড়লো নীলমণি মজুমদারের। ব্যোমকেশ বিলক্ষণ বুঝলেন, হাসি নীলমণিরবাবুর অবৈধ মেয়ে আর তার মা অমলার সঙ্গে এককালে তার দৈহিক সম্পর্ক ছিল। মুখ ফসকে নীলমণি বলে ফেললেন যে, হাসির মায়ের নাম ছিল অমলা; যার নাম কিনা কেউ জানতো না। অমলা মারা যান হাসি ও সুরেশ্বর খুনের অন্তত দশ বছর আগে। তাছাড়া চৌকস ব্যোমকেশ এও অনুমান করেন যে, কারো থাইরয়েড কার্টিলেজ ভেঙে খুন করার বিদ্যেটা রিটায়ার্ড অফিসার নীলমণি মজুমদারেরই ভালো জানা থাকার কথা। এভাবেই ওভারস্মার্ট অফিসার ব্যোমকেশের কাছে ধরা খেয়ে মুখ চুন করে বসে রইলেন।
এই প্রসঙ্গে ‘হেঁয়ালির ছন্দ’ (১৯৬৪) গল্পের প্রণব দারোগার কথা উল্লেখ করা যায়। ভদ্রলোক যেন ব্যোমকেশের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতেন। শুধু সত্যান্বেষী ব্যোমকেশই বা বলি কেন, অজিত তার বিশেষ বন্ধু ও সহযোগী তাই নটবর নস্কর খুনের কেসে শক্ত অ্যালিবাই থাকা সত্ত্বেও অজিতকে প্রণব দারোগা নজরবন্দী করে রাখেন। অজিত তার সম্পর্কে বলে, ‘লোকটা (প্রণব দারোগা) আমাদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। কিন্তু এমন মিষ্টভাবে বিদ্বেষ প্রকাশ করে যে কিছু বলার থাকে না।’ অবশ্য ব্যোমকেশ নিজেও কিছু কম যান না। তিনি প্রণব দারোগার বেঁটেখাটো চেহারা নিয়ে টিপ্পনি কাটেন, এও বলেন যে, ‘প্রণব দারোগা একটা ইয়ে। বুদ্ধি নেই তা নয়, বিপরীত বুদ্ধি। ও কোনোকালে নটবর নস্করের খুনীকে ধরতে পারবে না।’

হইচই ওয়েব সিরিজে ব্যোমকেশ চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও সত্যবতী চরিত্রে রিধিমা ঘোষ

অবশ্য এর উল্টো চিত্রও আমরা দেখতে পাই। ব্যোমকেশ অকারণ কোনো অফিসারের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়াতেন না। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে তাঁর কিছু গুণমুগ্ধ ভাবশিষ্য বা অনুগত কর্মকর্তাও ছিলেন- যেমন রাখালবাবু। ইন্সপেক্টর রাখাল। ব্যোমকেশকে তিনি ভালোবেসে ‘ব্যোমকেশদা’ বলে সম্বোধন করতেন। ‘ছলনার ছন্দ’, ‘লোহার বিস্কুট’সহ বেশ কিছু গল্পে ইন্সপেক্টর রাখালবাবু যেচে এসে ব্যোমকেশের সাহায্য প্রার্থনা করেন।

কিন্তু তাই বলে তিনি যে খুব অহংকারী ছিলেন, তাও কিন্তু বলা যায় না। কেননা, নীলমণিবাবুর এক প্রশ্নের জবাবে ব্যোমকেশ বললেন, ‘কেসের তদন্ত করতে গিয়ে কখনও ভুল করিনি এত বড় কথা বলার স্পর্ধা আমার নেই। নীলমণিবাবু, আমি সত্যান্বেষী। ভুল-ভ্রান্তি অনেক করেছি; এমনও অনেকবার হয়েছে যে অপরাধীকে ধরতে পারিনি। কিন্তু সত্যের সন্ধান পাইনি এমন বোধ হয় কখনও হয়নি।’ অর্থাৎ নিরংহার ও আত্মপ্রত্যয়ী একজন সত্যান্বেষী আমাদের ব্যোমকেশ বক্সী।

ব্যোমকেশের পর্যবেক্ষণ
এককথায় বললে মাইক্রোস্কোপিক চোখ ছিল ব্যোমকেশ বক্সীর। তাঁর চোখের সেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রে মামুলি ধুলো থেকে শুরু করে দরজায় লাগানো চকচকে চাকতি পর্যন্ত এড়িয়ে যায়নি। ‘রক্তের দাগ’ গল্পে ঊষাপতিবাবুর ঘরের দরজায় চকচকে চাকতি লাগানো দেখেই মূলত ব্যোমকেশের মনে সন্দেহ জাগে। তাছাড়া তিনি লোকের মুখভঙ্গি বা শরীরী ভাষা খুব ভালো পড়তে পারতেন। তাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও উল্লেখ করবার মতো। আবার ‘অর্থমনর্থম’ গল্পে বিকলাঙ্গ ফণীকে পুলিশ যখন সন্দেহের তালিকায়ই রাখলেন না, ব্যোমকেশ কিন্তু তাকে সাসপেক্ট লিস্টের সবচেয়ে উপরে স্থান দিলেন। কারণ তিনি শুনেছেন, ভিকটিম করালীবাবু ফণীকে দেখতে পারতেন না বরং খোঁড়া বলে প্রায়ই তাকে উপহাস করতেন। ব্যোমকেশের মন বললো, রহস্য যদি কিছু থাকে এখানেই আছে। বিকলাঙ্গ যারা তারা তাদের শারীরিক অক্ষমতাকে কেউ উপহাস করলে সহজে নিতে পারে না। আর এটাই ছিল করালী খুনের অন্যতম কারণ।

ব্যোমকেশের এক বিদ্যেকে আমরা মার্কিন লেখক অ্যালান পো’র দ্যুঁপার সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তাঁর ট্রিলজি অর্থাৎ ‘দ্য মার্ডারস ইন দ্য রু মর্গ’, ‘দ্য মিস্ট্রি অফ মেরি রোজি’ এবং ‘দ্য পারলয়ন্ড লেটার’ গল্পে পাকে আমরা একজন মনঃসমীক্ষক হিসেবে দেখতে পাই। তিনি ঘটনার যৌক্তিক বিন্যাসের পাশাপাশি ইনটুইশনকেও গুরুত্ব দিতেন। দ্যুঁপার ভাষায় দ্য ‘ব্যাটল বিটুইন ব্রেন এন্ড ব্রন’। মন ও মগজ একসাথে চললে তাতে ভালো ফল পাওয়া যায়। দ্যুঁপার মতোন ব্যোমকেশকেও আমরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে দেখি না। অপরদিকে কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস এবং সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা- দুজনেই কিন্তু পিস্তল ব্যবহার করতেন। ফেলুদার কোল্ট আর হোমসের ছিল মার্ক থ্রি রিভলভার। [পর্ব-২]

অরুণ কুমার বিশ্বাস: কথাসাহিত্যিক

মন্তব্য করুন

daraz
  • শিল্প-সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh