একলা আকাশ
"আসমান তুই কাঁদিস কেন
অট্টালিকার পাহাড়ে
মিছে হাসি, মিছে কান্না
পথে পথের আড়ালে
ওহ গ্রিন সিগনাল, রেড ওয়াইন
দেয়ালে, দেয়ালে
এই শহর, যাদুর শহর
প্রাণের শহর ঢাকারে"
ব্যস্ততম শহর ঢাকা। জীবন আর জীবিকার তাগিদে মানুষ প্রতিনিয়ত ছুটে চলে যে শহরে। সেই শহরের গুলশানের একটি প্রতিষ্ঠিত অফিস। নান্দনিকতায় যেমন সাজানো গোছানো পরিপাটি, তেমনি কর্পোরেট অফিসের টোটাল পরিবেশটাই ধারণ করে আছে অফিসটি। আকাশ সেই অফিসের একজন বড় কর্মকর্তা, কাজ পাগল এবং পারফেকশনিস্ট মানুষ। তার কাজে যেমন ভুল হয় না, ঠিক তেমনি সে চায় না, অফিসের কেউ কাজে কোনো ভুল করুক। আর যদি কেউ করেই ফেলে, তাহলে তার জন্য আছে কঠিন ঝাড়ি। অফিসে এই নিয়ে বেশ গসিপিং হয়। আকাশ সেটা জানলেও কম্প্লিমেন্ট হিসেবেই দেখে। সেই আকাশের আজ কাজে-কর্মে ভুল হচ্ছে। আকাশের স্ত্রী নীরা সকালে তাকে একটা টেক্সট করেছে -"I think it will be better to go for permanent separation." মেসেজটা পড়ে উত্তেজিত হয়ে পড়লেও নিজেকে সামলে নিয়ে কাজের ব্যস্ততায়, ওটা নিয়ে চিন্তা করার মতো অবকাশ তার হয়নি। লাঞ্চ শেষে হঠাৎ করে আবার সেটা মনে পড়াতে মেজাজটা একটু চড়ে গেল, টেবিলের উপরে থাকা বেলটাতে খুব জোরে চাপ দিল, অথচ আস্তে চাপ দিলেও যে পরিমাণ আওয়াজ হবে জোরে চাপ দিলেও সেই একই আওয়াজই হবে। জোরে হবে না, সেটা জানে আকাশ। অফিস এসিস্ট্যান্ট জামাল হোসেন তার দরজায় টোকা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। আকাশ একটু উঁচু গলায় বলল
-এতক্ষণ লাগে আসতে, কোথায় থাকো?
জামাল নীচু মাথা উঁচু করে তাকিয়ে বলল
-স্যার, কিছু লাগবে?
আকাশ: কড়া করে এক কাপ চা দাও।
জামাল: স্যার দুধ চা না লাল চা?
আকাশ নিজেকে সংযত করে বলল
-লাল চা।
জামাল ‘জি স্যার’ বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
আকাশ জামালের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
সারাদিন একা একা থেকে ইদানিং বেশ বোর হয়ে যায় নীরা। গান শুনে, টিভি দেখে, বই পড়ে কতক্ষণ আর ভালো লাগে। কথা বলার মতো একজন থাকলে গল্প করে সময় কাটানো যেত। সারাদিন তাই সে প্রতীক্ষা করে থাকে কখন আসবে আকাশ। কথার ঝুলি নিয়ে বসবে। সন্ধ্যার পরের সময় যেন আর কাটতে চায় না। ইউটিউবে পছন্দের কিছু গান চালিয়ে দিয়ে, এক কাপ কফি নিয়ে নীরা তার ফ্ল্যাটের বারান্দার ছোট্ট টি টেবিল সংলগ্ন চেয়ারে গিয়ে বসে। দশ তলার উপরে এই বারান্দাটা নীরার সবথেকে পছন্দের। বারান্দাটা বেশ বড়, পছন্দের নানা রকমের অর্কিড, বনসাই, পাতাবাহার গাছ আর বাহারী ফুলগাছ আছে তার সংগ্রহে। কিছু আছে বারান্দার গ্রিলে ঝুলানো। চেয়ারে বসলে ঝুলন্ত গাছগুলোর মাঝ দিয়ে দূরের দিগন্ত দেখা যায়, যদিও ঢাকা শহরের দিগন্তে বিল্ডিং ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমেছে। আকাশে ভরা চাঁদ, "আরে আজ তো দেখি ফুল মুন" মনটা ভালো হয়ে যায় হঠাৎই। মনে মনে একটা কিছু ঠিক করে ফেলে সে, আর আকাশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বারান্দার লাইটটা অফ করে সে, জোসনার আলো ধরার চেষ্টা করে, আরাম করে কফিতে চুমুক দেয়। বাহ্ কফিটা আজ বেশ লাগছে। একটা গান শেষ হয়ে আরেকটা গান শুরু হয়েছে
"প্রাণ চায় চক্ষু না চায়,
মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা।
সুন্দর এসে ফিরে যায়,
তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা॥"
ঢাকা শহরের রাস্তা, সব মানুষ কি আজ বাড়ি যাবার জন্য একত্রে বের হয়েছে নাকি? আকাশ গাড়িতে বসে অস্থিরতায় ভোগে। কোনো গাড়িই আজ নড়ছে না, এ যেন এক স্থির চিত্র। আকাশ ড্রাইভার আনিসকে বলে
-আনিস এসি কি চলছে?
আনিস: জি স্যার।
আকাশ: আর একটু বাড়ান।
আনিস: আচ্ছা স্যার।
আকাশ গলার বোতামটা খুলে টাইটা ঢিলা করে, জামার হাতার বোতাম খুলে, হাতা গুটিয়ে, জুতা খুলে সিটে আরাম করে বসল। সে জানে আজ অনেকটা সময় এই রাস্তাতেই কাটাতে হবে। কী কারণে জ্যাম সেটা জানার ইচ্ছে প্রথম দিকে হতো, উত্তর জানা যায় না। তাই উত্তর খোঁজার চেষ্টা এখন সে আর করে না।
রাত নটা দশ বাজে, ইউটিউবের জুকবক্সের সব গান শেষ। এখনও আকাশ আসেনি। কী হলো? নীরা বারান্দায় বসেই আকাশকে একটা ফোন দেয়। তিনটি রিং হবার পর ফোনটা কেটে দেয়া হলো। এর পর পরই বাসার কলিং বেলটা বেজে উঠলো। এই সময়ের কলিং বেলের আওয়াজের মতো মধুর কিছু আর হতেই পারে না। নীরা ছুটে গিয়ে দরজা খোলে, দেখে আকাশ জুতা খুলে স্যু র্যাকে জুতা রাখছে।
নীরা: তোমার আজ এতো দেরি হলো?
আকাশ: ঢাকা শহর আজ থেমে ছিল বেশ কিছুক্ষণ।
নীরা: ধ্যাৎ, সেটা আবার হয় নাকি?
আকাশ: আরে রাস্তায় ভীষণ জ্যাম।
নীরা: আচ্ছা, তুমি ফ্রেস হয়ে নাও। তোমার সাথে কথা আছে।
আকাশ: কথা আছে মানে?
নীরা: কথা আছে মানে, কথা আছে।
আকাশ একটু রেগে গিয়ে: ফ্রেশ হওয়া লাগবে না, তুমি এখনই বলো।
নীরা: না, এই অবস্থায় বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি আগে ফ্রেশ হও।
আকাশ নীরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
নীরা আকাশের জন্য আনারসের জুস বানাতে লাগলো।
ফ্রেশ হয়ে আকাশ যথারীতি বারান্দার দিকে গেল। গিয়ে দেখল, নীরা আনারসের জুস, পানি আর বিস্কুট নিয়ে আগেই টেবিলে বসে আছে। আকাশ পাশের চেয়ারটাতে চুপচাপ বসল। নীরা তার দিকে বিস্কুট, জুস আর পানি এগিয়ে দিল।
আকাশ একটা বিস্কুট মুখে দিয়ে জুসের গ্লাসটা হাতে নিল।
নীরা খেয়াল করল, আকাশ অন্যদিন তার সাথে যেমনটি কথা বলে আজ বলছে না। চুপচাপ বিস্কুট আর জুস খাচ্ছে। সারাদিন ধরে অপেক্ষার পর আকাশের এই নির্লিপ্ততায় তার মেজাজ বিগড়ে গেল।
নীরা রাগের সাথে: কী হলো? কথা বলছো না যে আজ?
আকাশ: কেন বল তো?
নীরা: না, চুপচাপ আছো তো, তাই।
আকাশ: সব দিন কি সমান যায়?
নীরা: তোমাকে কতদিন বলেছি, অফিসের কোনো ইস্যু মাথায় করে নিয়ে বাসায় আসবে না।
আকাশ: হ্যাঁ, তুমি যেন কী বলবে বলছিলে?
নীরা খুব আবেগ নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বলল
-দেখো আজ পূর্ণিমা
আকাশ শীতল কণ্ঠে বলে
-তো?
নীরা: এই চলোনা দুজনে ছাদে যাই, জোসনায় ভিজি।
আকাশ নীরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলে
-গেলে তুমি কি খুশী হবে?
নীরা: ভীষণ, ভীষণ
আকাশ: ওকে, চলো তাহলে।
আকাশ গ্লাসের পানিটা একবারে খেয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
-আমি রেডি চলো
নীরা খুশী মনে বলে
-আচ্ছা চলো
বারোতলা বিল্ডিংয়ের ছাদ, বেশ বড়। ছাদের রেলিং ঘেঁষে টিনের বড় বড় ব্যারেল কেটে নানা রকমের গাছ লাগানো। আর গাছগুলো আকারেও বেশ বড়। মধ্যগগনে চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। সারা ছাদ জোসনাতে মাখামখি হয়ে আছে। বেশ স্নিগ্ধ সে আলো আর মোহনীয় এক পরিবেশ। স্পষ্ট দেখা যায়, বিল্ডিংয়ের বীমগুলো আড়াআড়িভাবে ছাদের উপর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত চলে গিয়েছে।
ছাদের দরজায় এসে বিমোহিত নীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে জোরে এক চিৎকার করে বলল
-ওয়াউ
পিছনে আকাশ মনে মনে ভাবে এতো উচ্ছাস মেয়েটি পায় কোথা থেকে?
নীরা গদগদ হয়ে
-তুমি এখনো চুপচাপ? এই সৌন্দর্য্য দেখেও তোমার ভিতরটা আন্দোলিত হয় না? তুমি কেমন মানুষ গো?
আকাশ কথাগুলো হজম করে, ঠিক যেমনটি করে সে তার বসের কথাগুলোও হজম করে ফেলে।
আকাশ ছাদের মাঝামাঝি একটা বিম দেখিয়ে বলে
-চলো ওখানটায় গিয়ে বসি।
নীরা: হ্যাঁ, চলো বসি।
বেশ কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ বসে থাকার পর নীরা উপরের আকাশ থেকে নিচের আকাশের দিকে চেয়ে বলল
-তুমি এতোক্ষণ ধরে কী ভাবলে?
আকাশ: না। ভাবছি এইসব দেখে একটা মেয়ে কিভাবে এতো আহ্লাদিত হয়?
নীরা: তোমাকে একটা কথা বলি?
আকাশ: বলো।
নীরা: জীবনকে এবং সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করতে জানতে হয়। আর সেটা যদি না পারো, তাহলে এই সুন্দর পৃথিবীতে জন্ম নেয়া কেন?
এতোক্ষণ নীরার সব কথা হজম করতে পারলেও এই কথাটি তাকে ক্ষতবিক্ষত করে। কেন যেন রাগ চড়ে যায়
-দেখো নীরা আমি আজ কোনোভাবেই তোমার মতো মনের অবস্থায় নেই, আমি আছি বিরাট একটা সমস্যায়।
নীরা: তোমার নিত্য নতুন সমস্যা লেগেই আছে, অফিসের নিশ্চয়ই। তোমাকে কতবার বলেছি, বাসায় তোমার অফিসের জঞ্জাল নিয়ে আসবে না।
আকাশ: দেখো নীরা, আমার উপর যে দায়িত্বটা অফিস দিয়ে রেখেছে সেটা তো আমাকে পালন করতেই হবে। বড় একটা পোস্টে চাকরি যেহেতু করি সেহেতু আমাকে তো অফিসকে সেই অনুযায়ী আউটপুট দিতেই হবে। আর এই আউটপুট দেয়া কখনও কখনও বেশ চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। আজ আমি সেরকম এক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি।
নীরা: তুমি সব সময়ই একই কথা বলো। সব সময়ই তোমার চ্যালেঞ্জ থাকে।
আকাশকে আজ রাতে অফিসের কিছু বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবতে হবে। সামনে তার ক্যারিয়ারের অনেকটাই ডিপেন্ড করছে এই চ্যালেঞ্জ জেতার উপর। তাই যথা সম্ভব ঠাণ্ডা থেকে বলে
-দেখো নীরা, আমার মনে হয়, আমাদের তিন বছরের এই সংসার জীবনে তুমি আমার উপর ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়েছে তাই আমার ভিতরে কোনো পজেটিভ কিছু তুমি এখন আর দেখতে পারছো না। একটা ব্রেক দরকার। আলাদাভাবে দুজন কিছুদিন থেকে, নতুন করে আমরা একজন আরেকজনকে আবিষ্কার করতে পারি কি পজিটিভলি?
নীরা: তুমি কী বলতে চাইছো? আমি ঠিক পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারিনি।
আকাশ: বুঝতে না পারার কিছু নেই। আমরা দুজন কিছুদিন বিচ্ছিন্নভাবে থেকে একজন আরেকজনকে বোঝার চেষ্টা করি। যেহেতু আমরা একে অপরের মধ্যে আর ভালো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
নীরা উত্তরে কিছু না বলে চুপ করে রইল। আকাশও চুপচাপ বসে রইল। শুধু চুপ করে থাকলো না, ছাদের রেলিংয়ের পাশে টিনের ব্যারেলের মধ্যে লাগানো হাসনা হেনা গাছটি আর মধ্য গগনে ওঠা পূর্ণিমার চাঁদ। হাসনা হেনা তার সুবাস ছড়িয়ে দিতে লাগল, চাঁদও তার স্নিগ্ধ আলোয় চারপাশ আলোকিত করে রাখল।
জামাল দরজায় টোকা দেয়াতে আকাশের সম্বিৎ ফিরলো।
-ইয়েস, কাম ইন
জামাল: স্যার চা।
চা টেবিলে রেখে আকাশকে জামাল বলল
-স্যার, আর কিছু লাগবে?
আকাশ: না, ঠিক আছে, তুমি এখন যাও।
আকাশ চায়ে চুমুক দিলো এবং সেই সাথে ভাবনায়ও ডুব দিলো
ঐ রাতের পরদিন সকালে আকাশ যথারীতি অফিসে এলো, কাজে নিমগ্ন হলো। কিছুক্ষণ পরে মোবাইল ফোনে নীরার একটা টেক্সট এলো "I am going to my father's house, please don't try to communicate."
ভাবতে ভাবতে চা শেষ হয়ে গেল।
আকাশ জানালার দিকে তাকাল। এখন পড়ন্ত বিকেল, সূর্য পশ্চিমে হেলে আছে। কাজের চাপটা এই সময় একটু কম থাকে। এখন সে পুরোপুরি একা। মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে। বাইরে সোনালী রংয়ের মতো আলো। আকাশ রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় বের হয়ে দুই হাতে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আট তলার উপর থেকে নিচে ব্যস্ত রাস্তা, সবাই যার যার ঘরে ফিরছে মনে হয়। আকাশ পকেট থেকে সিগারেটের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে উপরের দিকে ধোঁয়া ছাড়লো। উপরের আকাশটা তার মতো রেগেই কি লাল হয়ে আছে নাকি? আজ নীরা'র টেক্সটা পাবার পর এখনকার আকাশের মতই তার রাগ; না এটা ঠিক রাগ না, অভিমান হয়েছিল। অভিমানী মন একবার উত্তর লিখতে চেয়েছিল "Yes it is." কিন্তু কেন যেন মায়ার কারণে সেটা সে করতে পারেনি তখন। উদাস মনে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করল, নীরাকে ফোন করার জন্য। কিন্ত না, ফোনটা নীরাকে করা হলো না। মনটা সায় দিলো না। সিগারেটে আবার একটা টান দিয়ে আনমনে সে আকাশ দেখতে লাগলো।
ক্রিং ক্রিং করে বেলটা বেজে উঠলো, অফিস সহকারী ইদ্রিস শব্দ শুনে বুঝলেন সৈকত সাহেবের কল। ইদ্রিস দরজা খুলে সৈকতের রুমে ঢুকল।
ইদ্রিস: স্যার
সৈকত: আমাকে আদা লেবু দিয়ে একটা চা দাও তো।
ইদ্রিস: জি স্যার।
সৈকত: আর হ্যাঁ, আমাকে চা দিয়ে তুমি ফারুক সাহেবকে আমার সাথে দেখা করতে বলবে।
ইদ্রিস: জী স্যার।
কিছুদিন যাবৎ সৈকতের ব্যবসায় মন্দা চলছে। লুব অয়েলের ব্যবসা তার। দেশের প্রায় সব জেলাতেই তার ডিস্ট্রিবিউটার আছে। হঠাৎ করে বিক্রিটা কমে গেল কেন? সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সে। ইদ্রিস এরই মধ্যে চা নিয়ে এলো।
সৈকত চা মুখে দিয়ে ইদ্রিস'কে বললো
-তোমার হয়েছেটা কী? চিনি দাওনি তো।
ইদ্রিস: সরি স্যার, চিনি দিয়ে নিয়ে আসছি।
ইদ্রিস রুম থেকে বেরিয়ে যেতে না যেতেই সৈকতের
ফোনটা বেজে উঠল। সুমীর ফোন।
সৈকত: আরে সুমি, কী ব্যাপার বলো?
সুমি: তেমন কিছু না, আসলে তোমার কথা মনে হলো তাই ফোন করলাম।
এর মধ্যে ইদ্রিস সৈকত'কে চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে এবার স্বস্তি বোধ করলো।
সৈকত: কেমন আছো সুমি?
সুমি: তুমি যেমন দেখেছো !!!
সৈকত: হেয়ালী কিন্তু মন্দ লাগছে না।
সুমি: শোন আজ একটা নতুন রান্না করেছি, তোমাকে যদি এখনই খাওয়াতে পারতাম।
সৈকত: চলে আসি তাহলে!
সুমি: আরে এখনই এসে কী করবে? ওটা তো ভাতের সাথে খেতে হবে, এখন কি ভাত খাবার সময়?
সৈকত: তা ঠিক, তা ঠিক।
সুমি: তুমি আজ সময় মতো আসছো তো?
সৈকত: চেষ্টা করবো।
এরই মধ্যে ফারুক সাহেব এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। সৈকত "আচ্ছা, পরে কথা হবে" বলে ফোনটা কেটে দিয়ে ফারুক সাহেবকে বসার জন্য ইঙ্গিত করলেন।
সৈকত: দেখুন ফারুক সাহেব, আপনি আমাদের সেলস্ ম্যানেজার। আমাদের ইয়ারলি একটা রেভেনিউ টার্গেট আছে। আপনি সেটা নিশ্চয়ই জানেন।
ফারুক: জী স্যার, আমি এবং আমার টিম সেটা জানে।
সৈকত: গত দুই মাসে আমরা একটু পিছিয়ে পড়েছি বলে আপনার মনে হয় না? আপনি কী বলেন?
ফারুক: স্যার, আপনি ঠিকই ধরেছেন। গত দুই মাসে আমরা একটু পিছিয়ে পড়েছি ঠিকই কিন্তু বাকী মাসগুলোতে আমরা আমাদের যে টার্গেট সেটা ফুলফিল করতে পারবো, আশা রাখি।
টেবিলে রাখা ফোনটা আবার বেজে উঠলো। সৈকত দেখলো আকাশ ফোন দিয়েছে।
সৈকত: আরে আকাশ যে, জাস্ট এ মিনিট বন্ধু। ফারুক, আই লাইক ইয়োর কনফিডেন্স। ধন্যবাদ, আপনি আসুন, পরে কথা হবে।
-হ্যাঁ, আকাশ বল তোর খবর কী?
আকাশ: আজ আমার মনটা খুব খারাপ, আই নিড ইয়োর কোম্পেনি ব্যাডলি।
সৈকত: তুই এতো আপসেট কেন?
আকাশ: তুই 'টিপসি ড্রাগন'-এ ঠিক সাড়ে সাত'টায় চলে আয়। কথা হবে। ছাড়ছি।
সৈকত: ঠিক আছে।
জেলা শহরের মধ্যে পুরোনো একটা দোতলা বাড়ি। বাড়িটা মূল শহরের শেষ প্রান্তে, শান্ত কোলাহল মুক্ত পরিবেশ। এই বাড়িটাকে স্থানীয়ভাবে সবাই রহমান স্যারের বাড়ি হিসেবেই চেনে। রহমান সাহেব শহরের একটি সরকারি হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। ভালো মানুষ, একই সাথে ভালো শিক্ষক হিসেবে শহরে বেশ নাম আছে। রহমান সাহেবের এখন পড়ার সময়। তিনি তার পড়ার ঘরের ইজি চেয়ারে আধাশোয়া হয়ে একটা বইয়ের গভীরে ডুবে আছেন। সারা ঘরের পুরো দেয়ালজুড়ে শুধু বই আর বই। জাহানারা একটা ট্রে'তে দুই কাপ চা, দুই গ্লাস পানি আর কিছু বিস্কুট নিয়ে রহমান সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। রহমান সাহেব সেটা খেয়ালই করলেন না। জাহানারা ট্রে'টা ইজি চেয়ারের পাশের টেবিলের উপর রাখলেন এবং একটা চেয়ার টেনে এনে কাছাকাছি বসলেন। এবার রহমান সাহেব জাহানারার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালেন
-কী ব্যাপার বলো তো?
জাহানারা: মানে?
রহমান সাহেব: মানে হলো, তুমি তো রোজ সন্ধ্যায় আমাকে চা নাস্তা দিয়ে চলে যাও, আমি সেই নাস্তা খেতে মাঝে মধ্যে ভুলেও যাই। সে যাইহোক, আজ ঘটা করে আমার পাশে এসে বসলে যে বড়।
জাহানারা: তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।
রহমান সাহেব: সে তো তোমার বসা দেখেই বুঝতে পেরেছি। তা চা দেবে, নাকি আগেই কথা শুরু করবে?
জাহানারা চেয়ার ছেড়ে উঠে একটা চায়ের কাপ রহমান সাহেবকে দিয়ে, আরেকটা কাপ নিজে নিয়ে, আবার চেয়ারে বসলেন। রহমান সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন
-কথা না থাকলেও তো মাঝে মাঝে বসতে পারো?
জাহানারা কাপে এক চুমুক দিয়ে বললেন
-হ্যাঁ, সেটা মাঝে মাঝে করা যেতেই পারে, তবে পাছে যদি তুমি বিরক্ত হও, এটা মনে করেই আর বসা হয়ে ওঠেনি।
রহমান সাহেব: তাই নাকি! আচ্ছা সে যাইহোক, এখন কী বলবে বলো? ব্যাপার বেশ জরুরি বলেই তো মনে হচ্ছে, বিশেষ করে তোমার প্রস্তুতি দেখে।
জাহানারা: হ্যাঁ, আমার কাছে জরুরি তো বটেই। তবে, তোমার কাছে সেটা জরুরি নাও হতে পারে।
রহমান সাহেব: তোমার এই আপেক্ষিকতা বোঝার ব্যাপারটা আমাকে মুগ্ধ করে, এতে করে আলোচনাটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় চালিয়ে নেয়া যায় বা বলতে পারো, চালাতে ইচ্ছাও করে।
জাহানারা: একটা মানুষের সাথে দীর্ঘদিন একসাথে এবং পজিটিভলি বসবাস করলে এমন অনেক কিছুই বোঝা যায়। যা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য খুবই জরুরি।
চা খেতে খেতে জাহানারার এই কথাগুলো শুনে রহমান সাহেব স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে রইলেন।
জাহানারা: আচ্ছা, তুমি এরকম করে আমার দিকে তাকিয়ে আছো যে, ব্যাপারটা কী?
রহমান সাহেব: ভাবছি, তোমার কথাটাই ভাবছি। তুমি খুব মূল্যবান একটা কথা বলেছ। যাইহোক, কী যেন বলতে চাইছিলে তুমি?
জাহানারা: বড় মেয়ে নীরা তার সংসার ছেড়ে এখানে এসে আছে প্রায় তিনমাস হয়ে গেল। তোমার কী এ বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হয়?
রহমান সাহেব: না, স্বাভাবিক মনে হয় না, আবার একইসাথে এটাও বলতে চাই, আমি তোমার মতো আপসেটও নই।
জাহানারা খুব আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন
-কেন, বলো তো?
রহমান সাহেব: দেখো জাহানারা, আমাদের মেয়ে নীরা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং ম্যাচুউরড। হ্যাঁ মানছি, নিশ্চয়ই আকাশের সাথে তার কোনো একটা সমস্যা হয়েছে।
জাহানারা: আমরা বাবা মা হয়ে কি সেই সমস্যার সমাধান করতে পারি না?
রহমান সাহেব: অবশ্যই পারি, কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে না। দেখো, এটা একান্তই ওদের দুজনার বিষয়। এটা ওরাই মিটিয়ে ফেলবে, সেটাই আমি চাই।
জাহানারা: যদি না মেটে, তাহলে?
রহমান সাহেব: না মিটলেও তো আমি কোনো সমস্যা দেখি না।
জাহানারা: তুমি এসব কী বলছো? মেয়েটার কী হবে, একবার ভেবে দেখেছো?
রহমান সাহেব: কিচ্ছু হবে না। নীরা শিক্ষিত একটা মেয়ে তাছাড়া একাকী নিজের মতো করে চলার সব রকম যোগ্যতা তার আছে। আমরা তাকে বা আমাদের ছোট মেয়ে সারাহ'কে তো সেইভাবে মানুষ করিনি যে, তারা স্বাবলম্বী হয়ে চলতে পারবে না।
জাহানারা: কিন্তু নীরা তো কোনো জব করে না।
রহমান সাহেব: পরিস্থিতি সেরকম হলে নিশ্চয়ই সে জব করবে। তবে তোমার কী মনে হয়, পরিস্থিতি তেমন হবে?
জাহানারা: দেখো এই তিন মাসে আকাশ একদিনও নীরা'কে ফোন পর্যন্ত করেনি। তাছাড়া পুরুষ মানুষের মন, বিগড়ে যেতে কতক্ষণ?
রহমান সাহেব: আচ্ছা, তোমার দৃষ্টিতে আকাশ ছেলেটা কেমন?
জাহানারা: যে ছেলের কারণে আমার মেয়েটি চলে এসেছে এবং এই তিন মাসের ভিতরে মেয়েটি আমার তার কাছে ফিরে যাবার নামটি পর্যন্ত করছে না, তাকে আমি একজন মা হয়ে ভালো বলি কিভাবে?
রহমান সাহেব: দেখো আমি দীর্ঘদিন ধরে মাস্টারি করছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, আকাশ ভালো ছেলে আর নীরাও ভালো মেয়ে। একটা ভালো ছেলে আর একটা ভালো মেয়ে একসাথে থাকলে ঝগড়াঝাটি একটু বেশিই হয়। কিন্তু ফাইনালি এদের একজনকে ছাড়া আরেকজনের চলে না।
জাহানারা: একটা মানুষ ছেলে হিসেবে ভালো হলেই স্বামী হিসেবেও যে সে ভালো হবে, তার কী গ্যারান্টি আছে? একজন মানুষকে তো অনেক রকম সম্পর্ক মেইনটেইন করে চলতে হয়। সব দিকেই যে একজন ভালো হবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।
রহমান সাহেব: তোমার কথায় যুক্তি আছে, তবে সেটা আমাদের মেয়ের বেলায়ও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। আর হ্যাঁ, একটা মানুষ যদি প্রকৃতপক্ষেই ভালো হয় তবে সে সব সম্পর্কেরই মূল্য বুঝবে। বেশি টেনশন করো না। আমি বলছি তোমাকে, এই সংকট অচিরেই কেটে যাবে, তুমি দেখে নিও।
জাহানারা, বিস্ময়ে রহমান সাহেবের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নীচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রহমান সাহেব চা শেষ করে ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে, ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। দৃষ্টি দূরে, দেখছেন সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আকাশ তার অফিস কক্ষে, গভীর মনোযোগে অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট বার বার পড়ছেন। কাচের দরজায় হালকা টোকাতে তার মনোযোগ বিঘ্নিত হলো।
-ইয়েস, কাম ইন
জামাল: স্যার, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। চা নাস্তা কিছু দেব?
আকাশ সাথে সাথে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে ছ'টা বাজে। ডকুমেন্টটা তড়িঘড়ি করে ফাইলে রেখে জামাল'কে বলল -না, আজ আর নাস্তা করার মতো সময় নেই, তুমি তাড়াতাড়ি আমাকে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দাও।
জামাল জি, আচ্ছা বলে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।
আকাশ সাইড টেবিলে রাখা বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢালল। এরপর সে তার ডেস্ক থেকে পিএস হাসান'কে পিএবিএক্স নাম্বারে কল করল।
হাসান: হ্যালো স্যার
আকাশ: আগামীকাল সকালে আমার শিডিউল কী?
হাসান: স্যার সকাল দশটায় একাউন্টস ম্যানেজারের সাথে মিটিং ফিক্স করা আছে।
আকাশ পানিটা পান করে বলল
-এরপর?
হাসান: দুপুর বারটায় চাইনিজ ডেলিগেটসদের একটা এপোয়েন্টমেন্ট দেয়া আছে। তারা আসবে মিটিং করতে।
আকাশ: ও হ্যাঁ, আচ্ছা আগামীকাল আমি দেরিতে আসবো, তুমি একাউন্টস ম্যানেজারকে লাঞ্চের পরে টাইম দাও। আমি বারোটার মিটিংয়ের আগে অফিসে ঢুকবো। এখন ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে পার্কিং থেকে গাড়ি ওঠাতে বলো। আমি বের হব।
হাসান: ওকে স্যার, আমি বলছি।
আকাশ ফোনটাকে রেখে দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে জামাল কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আকাশ: শোন, আমি কফিটা খেয়েই বের হয়ে যাব, তুমি রুমটা লক করে দিও। ঠিক আছে?
জামাল: জি স্যার।
আকাশ তড়িঘড়ি করে কফি খেতে লাগল।
ক্রিং ক্রিং করে টেলিফোন বেজে উঠলো। আকাশ ফোনটা ধরলেন।
-কী ব্যাপার, হাসান?
হাসান: স্যার গাড়ি উঠেছে।
আকাশ: থ্যাংকস।
অনেক অনেক দিন পরে নিজের পুরোনো ঘরে বেশ কিছুদিন যাবৎ দিন কাটছে, যেখানে কেটেছে তার কৈশোর, তারুণ্য। একসময়ে এই ঘরটা কত প্রিয় ছিল নীরার। ছেলেবেলার কত স্মৃতি তার কাছে এসে ডানা ঝাপটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অতীতের কিছু সুখস্মৃতি আর বর্তমানের টানাপোড়েনে বিক্ষিপ্ত মন আজ বিষন্ন। এখন এই ঘরটাকে ভালো লাগলেও ছেড়ে আসা ঘরটাকে কেন যেন মনে পড়ছে বার বার! নীরা ঘর সংলগ্ন ব্যালকনির রেলিংয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই গোধূলী লগ্নে শূন্য দৃষ্টি মেলে সামনে তাকিয়ে আছে শুধু, কিন্তু সামনে কিছুই দেখছে না সে। মনের দৃষ্টি খোলা আছে, কতকিছুই যে সেখানে আনাগোনা করছে, অতীত বর্তমান সব। তবে কান পাতা আছে একটা গানে, বেজে চলেছে তার এক সময়ের প্রিয় সিডি প্লেয়ারে।
"সবারে বাস রে ভালো,
নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে।
আছে তোর যাহা ভালো।।
ফুলের মতো দে সবারে।
নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে।
করি’ তুই আপন আপন
হারালি যা ছিল আপন;।।
এবার তোর ভরা আপন;
বিলিয়ে দে তুই যারে তারে।
নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে।
যারে তুই ভাবিস ফণী
তারও মাথায় আছে মণি।।
বাজা তোর
বাজা তোর প্রেমের বাঁশি
ভবের বনে ভয় বা কারে।"
"আপু, এই আপু কোথায় তুই" বলতে বলতে সারাহ নীরার ঘরে ঢুকেই
-আপু ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে, লাইটটা পর্যন্ত জ্বালাসনি, কী যে করিস না তুই?
আলো জ্বলতেই নীরা ঘরে এসে বিছানার উপর এসে বসে, সারাহ'কে বলে
-আয়, বস আমার কাছে
সারাহ নীরার কাছে বসে গলা জড়িয়ে ধরে বলে
-অতুল প্রসাদের গান শুনছিস, তা ফনির ভিতর মনি মিলল?
নীরা: পাকামো করিসনে।
সারাহ: পাকামো কোথায় করলাম? পাকামো করলে তো বলতাম, দুলাভাইয়ের কথা ভাবছিস?
নীরা: তুই বড় হয়ে গেছিস রে!
সারাহ: আপু আমি এখন অনার্স থার্ড ইয়ারে, এটা ভুলে গেলে তো চলবে না।
নীরা না জানার ভান করে বলে
-তাই নাকি?
নীরা সারাহ'র নাক টিপে দেয়।
সারাহ: আপু, তোর এই অভ্যাসটা এখনো গেলো না, না?
নীরা: কিছু অভ্যাস আসলে আজীবনের।
কথাটি বলে খিল খিল করে হেসে ওঠে নীরা।
সারাহ: তোর হাসিটা এখনো কী সুন্দর
নীরা: তাই নাকি!
সারাহ: কেন? দুলাভাই কখনো তোকে বলেনি?
নীরা: সব মানুষ কি একরকম হয়? সবার এক্সপ্রেশনও এক রকম হয় না।
সারাহ: তার মানে, বলেনি তাইতো?
নীরা: আচ্ছা, বলেনি। তাতে হলোটা কী?
সারাহ: বলছিস কী? এতো সুন্দর মুখের এতো সুন্দর একটা হাসির কোনো কমপ্লিমেন্ট থাকবে না?
নীরা: থাকবে না কেন? তাই বলে সেটা কি বলেই বোঝাতে হবে?
সারাহ: বুঝেছি, তুই দুলাভাইয়ের প্রেমে ডুবে আছিস।
কথাটি বলে সারাহ একটা দুষ্টুমী ভরা হাসি দিল।
নীরা: শোন, এক এক জন মানুষের ভালোবাসা এক এক রকমের। কেউ প্রকাশ করতে পারে আবার কেউ প্রকাশ করতে পারে না। তবে, প্রকাশ করতে না পারা মানে কি ভালোবাসার ঘাটতি?
সারাহ: মানেটা কী দাঁড়ালো তাহলে? দুলাভাই তোকে ভালোবাসে, তাই তো?
নীরা: হ্যাঁ, ভীষণ ভালোবাসে।
সারাহ: তুই, এতো নিশ্চিত হলি কিভাবে?
নীরা: মানুষটার সাথে আমি তিনটা বছর ধরে একসাথে আছি, আর আমি নিশ্চিত হবো না?
নীরার চোখে পানি, সারাহ সেই পানি মুছে দেবার কোনো চেষ্টা করলো না। তার মনে হলো নীরার চোখের এই পানি কখনই বৃথা না। সে নীরাকে চুপচাপ জড়িয়ে ধরে থাকলো।
ঢাকা শহরে সন্ধ্যা নেমেছে। রাস্তায় সোডিয়াম বাতির আলো, বিভিন্ন রেস্তোরাঁর নিয়ন লাইটের সাইনবোর্ড, এলইডি ভিডিও ডিসপ্লেতে নানান বিজ্ঞাপন, রাস্তায় সারি সারি প্রাইভেট কার আর গাড়ি, সেগুলোর সামনের হলুদ লাইট আর পিছনের লাল লাইট এই নিয়েই রাতের ঢাকা। 'টিপসি ড্রাগন' হোটেল এন্ড বারের সামনেও নিয়ন লাইটের সাইনবোর্ড। সামনে কিছুটা খোলা জায়গা আছে। অনেকগুলো জিপ, প্রাইভেট কার আর অল্প কিছু মোটরবাইক পার্ক করা আছে। সৈকত এসে তিনতলাতে কর্নারের একটা টেবিলে বসেছে অল্প কিছুক্ষণ হলো। ভিতরে হালকা আলো আঁধারের খেলা। কোথাও একটু নীল, কোথাও একটু সবুজ আবার কোথাও একটু হলুদ। পুরো হোটেলটাতে হালকা ভলিউমে বিদেশি ইন্স্ট্রুমেন্টাল মিউজিক বেজে চলছে। সেন্ট্রাল এসি, তবে রিটার্ন ডাক্টের পারফরমেন্স খুব ভালো, না হলে সিগারেটের ধোঁয়ায় এখানে বসাটা দুষ্কর হয়ে যেত। টেবিলের উপর একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল, কিছু টিস্যু পেপার ভাঁজ করে সোজা করে রাখা, আছে একটা এসট্রে। একজন ওয়েটার সৈকতের কাছে এলো
-গুড ইভনিং, স্যার
সৈকত: গুড ইভনিং
-স্যার, এখনই কি অর্ডার প্লেস করবেন? নাকি পরে?
সৈকত: আমি কি আপনার নামটা জানতে পারি?
-সিওর স্যার, আমি মোস্তফা। আপনাদের সেবাই নিয়োজিত।
সৈকত: মোস্তফা, আপনি আপাতত এখানে এক প্লেট শশা স্লাইস করে কেটে বিট লবন আর অল্প মরিচ কুচি দিয়ে সার্ভ করবেন, সাথে দেবেন এক প্লেট মিক্সড কাঁচা আর সেদ্ধ ছোলা পিয়াজ মরিচ কুচিসহ। আর হ্যাঁ, এই নরমাল ওয়াটার রিপ্লেস করে কোল্ড ওয়াটার দেবেন।
মোস্তফা: স্যার, আর কিছু? এনি ড্রিংকস?
সৈকত: ড্রিংকস পরে দেন, আমার একজন গেস্ট আসবে।
মোস্তফা: ওকে স্যার।
যাওয়ার সময় মোস্তফা নরম্যাল ওয়াটারের বোতলটা নিয়ে গেল। সৈকত তার চলে যাওয়াটা খেয়াল করলো। আকাশ এখনো আসেনি, সুমী’কে একটা ফোন দেয়া যায়। টেবিলের উপরে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে সে সুমীকে ডায়াল করলো। রিং হতে লাগলো।
সুমি: হ্যালো, সৈকত বলো
সৈকত: তুমি কী করছো?
সুমি: কী আর করবো, মেয়েকে নিয়ে আছি, ওর এখন গান শোনার সময়।
সৈকত: এই রে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, তবে আজ তুমি যে নতুন একটা আইটেম রান্না করেছো, সেটা কিন্তু ভুলিনি।
সুমি: তোমাকে ভুলতে কে বলেছে?
সৈকত: আমি না খেয়েই বলে দিতে পারি, ভীষণ মজাদার হয়েছে।
সুমি: মানে কী? তুমি এখন কোথায় চাঁন্দু?
সৈকত: আমার খুব খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, তোমার নতুন আইটেমটা আমার আরাম করে খাওয়া হবে না।
সুমি: আরে বাবা, তুমি পরিষ্কার করে বলো, তুমি এখন কোথায়? আর কেনই বা খাওয়া হবে না?
সৈকত: দেখো আজ একটা বিশেষ কারণে আমাকে আকাশের সাথে বসতে হচ্ছে, সিরিয়াস কোনো ব্যাপার মনে হয়।
সুমি: নীরা ভাবী কী এখনো আসেনি?
সৈকত: না এখনো আসেনি।
সুমি: ঠিক আছে, এটা তো সিরিয়াস একটা বিষয়। তুমি আকাশ ভাইকে একটু বুঝিও।
সৈকত: সে না হয় বুঝাবো, তবে আমরা যে একটু বারে বসছিলাম !!!
সুমি: এখন বুঝেছি, এই কারণে এতো পুতুপুতু, যাইহোক তুমি কিন্তু বেশি ড্রিংক করবে না। ভুলে যেও না, তোমার হাই ব্লাড প্রেসার।
সৈকত: মানলাম, কিন্তু তোমার ঐ নতুন রান্না করা আইটেমের স্বাদটা তো আমি মিস করতে চাই না।
সুমি: ঠিক আছে, আমি তোমার জন্য আলাদা করে ফ্রিজে রেখে দেবো না হয়। তবে তুমি কিন্তু বেশি দেরি করবে না। আর আকাশ ভাই'কে আমার সালাম জানিও। রাখছি। বাই
সৈকত: বাই, সুমি।
সৈকত এখন ফুরফুরা মেজাজে টিপসি ড্রাগনে আসা মানুষদের কার্যকলাপ অবলোকন করতে লাগলো। এটা করতে সৈকতের বেশ মজা লাগে। এর ভিতরে মোস্তফা এসে তাকে ঠাণ্ডা পানি, শশা আর ছোলা দিয়ে গেল। সৈকত এক স্লাইস শশা খেতে খেতে ভাবতে লাগলো, এই বারে কত লোক কত রকম উদ্দেশ্যে নিয়েইনা আসে।
কেউ আসে সিম্পলী নেশা করার জন্য, এদের সাধারণত কোনো সঙ্গীর প্রয়োজন হয় না।
কেউ আসে ফরেইন ডেলিগেটসদেরকে আপ্যায়ন করার জন্য। অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করতে। এদেরকে নিয়ে যে আসে, তাকে সব সময়ই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় ডেলিগেটসদের উপর, যাতে করে তাদের আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি না হয়। যতটুকু ড্রিংক সে করে সেটা নিতান্তই সৌজন্যতার খাতিরে।
একসাথে দুই বা ততধিক মানুষ আসে কোনো কিছুর সাকসেস সেলিব্রেট করার জন্য।
ইদানিং অবশ্য বারে মেয়েদের আনাগোনা কিছুটা বেড়েছে। কিছু আছে হাই সোসাইটির মেয়ে, যারা বিভিন্ন হতাশায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আবার কিছু আছে যারা ক্লায়েন্টদের সাথে আসে, মডারেটলি ড্রিংক করে গন্তব্যে চলে যায়।
জীবনের বিভিন্ন ক্রাইসিস নিয়ে আলাপ করার জন্য তাদের মতোও কেউ কেউ আসে।
কী রে? তুই এতো কী ভাবছিস? -আকাশ সৈকতকে বলে।
আচমকা আকাশের রাশভারী আওয়াজে কিছুটা হকচকিয়ে যায় সে।
-আরে তুই এসে গেছিস, আকাশ?
আকাশ সৈকতের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলে
-সেটা তো দেখতেই পাচ্ছিস। তা তুই এরকম আনমনা হয়ে কী ভাবতে ছিলি? বলতো।
সৈকত: বাদ দে দোস্ত, তেমন কিছু না?
আকাশ: খুব বেশিক্ষণ কী তোকে বসে থাকা লাগলো? সরি দোস্ত, আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।
সৈকত: তা ঠিক। তুই হলো গিয়ে হোস্ট, অথচ আমি তোর আগে এসে বসে আছি। তবে বেশিক্ষণ হয়নি। তুই চাপ নিসনে।
আকাশ: আচ্ছা চাপ নিলাম না। এখন বল, কেমন আছিস তোরা? সুমি আর আমার ছোট্ট মামনি কেমন আছে?
সৈকত: হ্যাঁ, আমরা ভালো আছি। একটু আগেই সুমি'র সাথে কথা হলো। ও তোকে সালাম জানিয়েছে।
আকাশ: ও, এর মধ্যে তোর সুমি'র সাথে কথা বলাও শেষ। আচ্ছা এখন ড্রিংকসের অর্ডারটা দেই। কী খাবি?
সৈকত: আমি রেড ওয়াইন, তুই?
আকাশ: আচ্ছা, তবে রেড ওয়াইনই চলুক। সাথে কী খাওয়া যায়? চিকেন চিলি ড্রাই চলবে?
সৈকত: চলুক তবে।
আকাশ ওয়েটারের উদ্দেশ্যে হাত উঁচু করে। মোস্তফা সেটা খেয়াল করে, টেবিলের কাছে চলে এসে বলে
-গুড ইভনিং, স্যার। আমি মোস্তফা।
আকাশ: মোস্তফা কেমন আছেন আপনি?
মোস্তফা: ভালো আছি স্যার। কী সার্ভ করতে পারি স্যার?
আকাশ: আমাদেরকে একটা চিলড রেড ওয়াইন দিবেন আর সাথে দিবেন একটা চিকেন চিলি ড্রাই আর আপনাদের এখানকার স্পেশাল সালাদ। আর হ্যাঁ, আগে ড্রিংকসটা দিয়ে যান প্লিজ।
মোস্তফা: ওকে স্যার। আমি এখ্খনি ড্রিংকস দিয়ে যাচ্ছি।
-বলে মোস্তফা চলে যায়
সৈকত: আচ্ছা, এবার বল। তুই কেমন আছিস? নীরার খবর কী?
আকাশ: আমি ভালো নেই রে, নীরা কেমন আছে তাও জানি না। হয়তো ভালো আছে, হয়তো নেই।
সৈকত: এইভাবেই কী চলে যাবে দিন?
আকাশ: কী আর করা !
সৈকত: দেখ আকাশ, তোর সাথে আমার শৈশব থেকে বন্ধুত্ব। আমরা একই সাথে একই স্কুল এবং কলেজ জীবন কাটিয়েছি। এর পরের শিক্ষাজীবন দু'জনের দু'জায়গায় কেটেছে কয়েক বছর। তারপর আমরা দুজন আবার ঢাকায়। আমাদের মধ্যে সম্পর্কে কখনও ছেদ পড়েনি। আমরা দু'জন পারিবারিকভাবেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছি। আমি বা তুই, আমরা কেউই কারো স্ত্রীকে ভাবী বলি না। নাম ধরেই ডাকি। আমাদের মধ্যে যেমন সম্পর্ক, ঠিক তেমন সুমি'র সাথেও নীরা'র সম্পর্ক।
আকাশ: এতো বড় ভূমিকা দিলি যে, বয়ান দিবি নাকি?
এর মধ্যে মোস্তফা ড্রিংকস নিয়ে হাজির, জিজ্ঞাসা করল
-স্যার কর্ক ওপেন করে দিই?
সৈকত: হ্যাঁ, করে দেন।
মোস্তফা কর্ক ওপেন করে দুইটা গ্লাসে ঢেলে দিয়ে বলল
-স্যার, এনজয় ইয়োরসেলভস। আমি বাকী খাবারগুলো রেডি হলে সার্ভ করে যাব।
আকাশ: থ্যাংকস মোস্তফা
মোস্তফা মাথা বো করে সম্মান জানিয়ে চলে গেল।
আকাশ ও সৈকত দুজনে ড্রিংকসের গ্লাস উঁচিয়ে ধরে একটা টোকা দিয়ে সমস্বরে 'চিয়ার্স' বলে দুজনে একসাথে চুমুক দিলো।
সৈকত: প্রয়োজন হলে বয়ান দেবো, তাই খাওয়ার আগেই ভূমিকাটা দিয়ে দিলাম।
-বলেই হা হা করে হাসতে হাসতে বলল-
এখন তুই বল, আমরা এতো জরুরিভাবে বসলাম কেন?
আকাশ: না, তেমন কিছু না। এমনিই।
সৈকত: এমনি তো না ই, তোর মতো কর্পোরেট জগতের ব্যস্ততম একজন মানুষ, এমনি এমনি বন্ধুর সাথে জরুরি নোটিসে ড্রিংক করবি? এতো সময় কোথায় তোর?
আকাশ: তুই কিন্তু আক্রমনাত্মক ব্যাটিং শুরু করেছিস।
সৈকত: তোকে আজ আমি আক্রমনাত্মক কিছু কথাবার্তা বলবো। ভূমিকাটা আমি সেইজন্য আগেই দিয়ে রেখেছি।
আকাশ: বন্ধু, আজ আমার মনট ভালো নেই, সেজন্যই তোর সাথে একটু কথা বলে মন ভালো করতে এসেছি।
সৈকত: সাময়িকভাবে মন ভালো করে লাভ কী? আমি চাই, সব সময় তুই খুশী থাক। তুই কি সেটা চাস না?
আকাশ: সেটা তো সবাই চায়, তবে চাইলেই কী আর হয়?
সৈকত: নিশ্চয়ই হয়? মন থেকে চাইলে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করলে খুশী থাকা যায়।
আকাশ: লেকচার দেয়া শুরু করলি তো?
সৈকত গ্লাসের ওয়াইন শেষ করে, আকাশকেও শেষ করতে ইঙ্গিত দিল। সৈকত নিজের গ্লাসে বোতল থেকে রেড ওয়াইন ঢেলে আকাশের গ্লাসটাও ভরে দিল। এর ভিতর মোস্তফা এসে চিকেন চিলি ড্রাই আর স্পেশাল সালাদ দিয়ে গেল। দুজনেই একটু করে খাবার আর ওয়াইন খেতে লাগলো।
রহমান সাহেব খুব নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করেন। রাত নটায় তিনি ডিনার করেন সবাইকে একসাথে নিয়ে। ন’টা বাজতে বেশি দেরি নেই। ড্রইংরুমে, তিনি এবং জাহানারা টিভিতে খবর দেখছিলেন। খবর শেষ হয়ে গেছে। নীরা এসে তাদের কাছে এসে বসল। রহমান সাহেব বললেন
-জানিস নীরা, এখন সকালে আর রাতে খাবার খেতে বসলে অনেক ভালো লাগে। তুই আছিস, বাসাটা আগের মতো ভরা ভরা লাগে। খেতেও ভালো লাগে।
জাহানারা: তাই তো বলি, তুমি দেখছি ইদানিং বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছো এটাই তাহলে আসল ব্যাপার?
নীরা আর রহমান সাহেব হাসতে লাগলেন। ওদের হাসি দেখে জাহানারাও হাসতে লাগলেন। তিনজনের হাসির শব্দ শুনে সারাহ তার রুম থেকে ছুটে এলো ড্রয়িং রুমে-
আমি কী কিছু মিস করলাম?
নীরা: হ্যাঁরে বুদ্ধু, তুই অনেক কিছু মিস করে ফেলেছিস। -বলে হাসতে হাসতে সারাহ'র নাক টিপে ধরে।
হাসতে হাসতে রহমান সাহেব জাহানারা'কে ডাইনিং টেবিলে খাবার গোছাতে বলেন। নীরা জাহানারাকে বলে
-চলো মা, আমি তোমার সাথে যাই। সারাহ তুই আব্বু'র কাছ থেকে জেনে নে, কেন আমরা হাসছিলাম।
বলে হাসতে হাসতে মা মেয়ে ড্রইংরুম থেকে বের হয়ে যায়।
টিপস ড্রাগনে এখন প্রচুর লোক সমাগম। এই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি কাস্টমার থাকে। সৈকত ওয়াইনে চুমুক দিয়ে আকাশ’কে প্রশ্ন করে
-আচ্ছা আকাশ, তুই কী নীরা’কে ভালোবাসিস?
আকাশ: তুই কী সুমী’কে ভালোবাসিস?
-বলে ওয়াইনে চুমুক দেয়।
সৈকত: দেখ আকাশ, প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করা আমার অপছন্দের বিষয়গুলোর মধ্যে একটা। অন্য সময় হলে, আমি বেশ রাগ হতাম এবং বলতাম না। তবে আজ আমি তোর জন্য বলবো।
আকাশ মিট মিট করে হাসতে থাকে।
সৈকত: মজা নিচ্ছিস তো? তবুও বলবো। দেখ, আমি সুমি’কে এবং বাচ্চাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। আমি ওদের সুখের জন্যই বেঁচে থাকতে চাই। তাই বলে ভাবিস না যে, আমি কোনো সুখ পাই না। ওদের সুখই তো আমার সুখ। এখন তুই বল।
আকাশ এক চামচ সালাদ মুখে দিয়ে খেতে খেতে বলে
-আমিও ভালোবাসি।
সৈকত: আমি বিশ্বাস করি না।
আকাশ: কেন?
সৈকত: না। তুই ভালোবাসিস না, তুই দায়িত্ব পালন করিস।
আকাশ খুব অবাক হয় বলে
-এ কেমন কথা?
সৈকত: এটাই সত্য কথা। তুই তোর কাজকে ভালোবাসিস। আর সেইজন্যই তো তুই খুব অল্প সময়ে, অনেক উপরে উঠে গেছিস। ভাবিস না, আমি তোকে ঈর্ষা করছি। আমি চাকরি করি না। আমি ব্যবসা করি। হ্যাঁ, চাইলে আমার ব্যবসাটাকে আমি আরও অনেক উপরে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু সেটা করতে গেলে আমাকে ব্যবসাতে অনেকটা সময় দিতে হবে। আমি সেটা চাই না। পরিবার আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি, পরিবারকে ভালো রাখার জন্য এবং নিজে ভালো থাকার জন্যই তো আমার ব্যবসা। জীবন একটাই। জীবনটাকে আমি পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে উপভোগ করতে চাই। শুধু ব্যবসার জন্য জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।
আকাশ চুপ করে শুনতে থাকে, এক চুমুকেই ওয়াইনের গ্লাসটা শেষ করে ফেলে। সৈকত সেটা খেয়াল করে বলল
-কিরে আমার কথাগুলো ভালো লাগলো না বুঝি?
আকাশ: বলছি, তুই তোর গ্লাস শেষ কর। করে গ্লাসে আবার ওয়াইন ঢাল।
সৈকত গ্লাস শেষ করে দুজনের গ্লাসে ওয়াইন ঢাললো।
আকাশ: দেখ সৈকত, আমিও নীরা’কে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। তবে কেন জানি সেটা ওপেন করতে পারি না। একটা আড়ষ্টতা কাজ করে।
সৈকত: না, তোর ভালোবাসার কমতি আছে।
আকাশ: মোটেই না।
সৈকত: প্রমাণ দে।
আকাশ: কী প্রমাণ চাস?
সৈকত: তুই এখন নীরা'কে ফোন দিবি।
আকাশ: দেবো না হয়, কিন্তু সেটা এখন কেন?
সৈকত: আকাশ, প্রথম কাজ-আড়ষ্টতা ভাঙা। তোর মনে হতে পারে, তুই ফোন দিলে হয়তো তুই হেরে যাবি। তবে কী জানিস? মাঝে মাঝে হেরেও জেতা যায়। তুই এক্ষুনি ফোন দিবি।
আকাশ একটা চুমুকে সবটা শেষ করে সৈকতকে বলে
-তুই গ্লাসটা শেষ করে আর একটা রেড ওয়াইন অর্ডার কর। আমি ততক্ষণে বাইরে গিয়ে একটি সিগারেট টেনে আসি আর নীরার সাথে কথাও বলে আসি। খুশী?
সৈকত: অবশ্যই খুশী, তুই যা।
রহমান সাহেব খেতে বসেছেন। ছিমছাম করে সাজানো ডাইনিং রুম। একপাশে রহমান সাহেব, জাহানারা আর অন্যপাশে নীরা আর সারাহ। রহমান সাহেব ভাত মাখতে মাখতে বললেন
-তোর মনে আছে নীরা মা? তোর বিয়ের আগে আমরা প্রতি রাতে খেতে খেতে সমসাময়িক কোনো একটা বিষয়ে সবাই মিলে আলোচনা করতাম।
নীরা: জী আব্বু। মনে আছে, কত কিছুই তো ওখান থেকে আমরা শিখেছি। আচ্ছা সেটা কি এখন করো না?
রহমান সাহেব: কেমন করে করবো? আমার এই দুষ্টু ছোট মেয়েটা থাকলে কী কোনো আলোচনা কন্টিনিউ করা যায়? কোত্থেকে কোত্থেকে আজব আজব বিষয় নিয়ে হাজির করে, আমরা মূল বিষয়বস্তু থেকেই দূরে সরে যায়।
সারাহ: ও, এখন সব বুঝি আমার দোষ হয়ে গেল? আপু না থাকলে তোমার আলোচনা জমে না সেটা বলো।
নীরা: সারাহ, তুই না সেই একই রকম রয়ে গেলি।
জাহানারা: তোমরা খাবে? নাকি, আলাপই করতে থাকবে?
সারাহ এই সময় ফোনের রিং বাজার শব্দ পেল। সে নীরার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপু, তোর ফোনে রিং হচ্ছে।
নীরা: এই সময়ে আবার কে ফোন দিলো? আব্বু আমি আসছি।
বলে সে তার ঘরে গিয়ে দেখে আকাশের ফোন। ধরবে কী ধরবে না করতে করতে শেষ মুহূর্তে ফোনটা রিসিভ করলো।
-হ্যালো
আকাশ: নীরা, তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।
নীরা: আমি জানতাম, তুমি আজ ফোন দিবে। তবে এতো রাতে, সেটা বুঝতে পারিনি।
নীরার এই সবজান্তা ভাবটা আকাশের ভালো লাগে না, কিন্তু আজ মেজাজটা গরম করা ঠিক হবে না, তাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে বলল
-তুমি কেমন আছো নীরা?
নীরা: খুব ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
আকাশ: আছি একরকম। তুমি কি ফ্রি আছো? আমার কিছু কথা তোমাকে বলার ছিল।
নীরা: আমরা সবাই মিলে এখন খেতে বসেছি। যদি সেরকম জরুরি কিছু হয়, আগামীকাল না হয় ফোন দিও। আর এমনিতেই তুমি আজ ঠিক নেই।
আকাশ নিজেকে সংযত করল, মেয়েটা এতো বেশি বোঝে?
আকাশ: ঠিক আছে, আমি আগামীকাল তোমাকে ফোন দেব। বাই
নীরা: বাই
ফোনটা রেখে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একটু স্বাভাবিক হয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে চুপচাপ খেতে লাগলো। সারাহ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো
-কে ফোন দিয়েছিল রে আপু?
নীরা: তোর দুলাভাই
সারাহ: এতোদিন পর দুলাভাইয়ের তোর কথা মনে পড়লো!
নীরা মাথা নীচু করে খেতে লাগলো। জাহানারা, রহমান সাহেবের দিকে তাকালেন। দেখলেন উনি মিটিমিটি হাসছেন।
মোস্তফা আর একটা চিলড রেড ওয়াইন সৈকতের টেবিলে দিয়ে গেছে। সৈকত খুব সাবধানে দুইটা গ্লাসে খুব মনোযোগ দিয়ে ঢাললো এবং চামচ দিয়ে চিকেন চিলি ড্রাই মুখে দিলো। বাইরে থেকে আকাশ এসে তার চেয়ারে বসলো। গ্লাসে চুমুক দিয়ে চুপচাপ বসে থাকলো। সৈকত সব খেয়াল করল। সেও কিছুক্ষণ চুপ থেকে আকাশকে একটু সময় দিয়ে, তারপর বলল
-কথা হলো?
আকাশ: হ্যাঁ, হয়েছে।
সৈকত: এনিথিং রং?
আকাশ: মেয়েটা না বেশি বোঝে।
সৈকত: কেন একথা বলছিস?
আকাশ: আজ সে কথা বলবে না, আমি নাকি আজ ঠিক নেই।
সৈকতের কপালে চিন্তার ভাঁজ
-আর কিছু বলল না?
আকাশ: বলেছে।
সৈকত: কী?
আকাশ: যদি প্রয়োজন মনে করি, তাহলে আমি যেন কাল তাকে ফোন করি।
সৈকত: হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে। কাল ফোন করবি। আর তুই, দুই তিন দিনের মধ্যে নিজে গিয়ে নীরাকে নিয়ে আসবি। এই প্রস্তাবটা তুই ওকে দিবি।
আকাশ: যদি রাজী না হয়।
সৈকত: তুই তোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে, নির্দিষ্ট দিনে সোজা ওদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হবি। দেখবি সব রাগ অভিমান পানি হয়ে যাবে। প্রয়োজনে ওখানে এক দুই দিন থাকবি।
আকাশ: তুই যে রকম সহজভাবে কথাগুলো বলে গেলি, বিষয়টা কি অতটাই সহজ?
সৈকত: আমি সব কিছু সহজভাবে দেখি, সেকারণেই আমার কাছে সহজ মনে হচ্ছে। এর ভিতর জটিলতা থাকলে, তুই বল, জটিলতা কোথায়?
আকাশ চুপ করে থাকে, গ্লাসে চুমুক দেয়। এক চামচ সালাদ আর এক চামচ চিকেন চিলি ড্রাই মুখে দিয়ে চিবাতে থাকে। সৈকতও খাবার খেতে থাকে। দুজনই কিছুক্ষণ চুপচাপ। সৈকত গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে
-আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, ততটুকুই বলি তাহলে। জটিলতা তোর মনে। তুই এই জটিলতা থেকে বের হ।
আকাশ: আমার ভিতরে জটিলতা আছে কি না আছে, সে প্রসঙ্গ থাক। তবে এখন পরিস্থিতিটা কিন্তু জটিল।
সৈকত: আজ আমি তোকে এই পর্যন্ত যা বলেছি এবং পরবর্তীতেও যা বলবো, তুই প্লিজ মাইন্ড করবি না। হয়তো কথাগুলো শুনতে একটু হার্ড লাগবে। তবে তোর কাছের বন্ধু হিসেবে কথাগুলো বলা আমার দায়িত্বের ভিতরই পড়ে।
আকাশ: দেখ সৈকত, আমি তোকে কাছের মানুষ, কাছের বন্ধু মনে করি বলেই কিন্তু এই ক্রুসিয়াল মোমেন্টে তোর সাথেই বসেছি। তুই আমার আজীবনের শুভাকাঙ্ক্ষী। তোর বলার অধিকার আছে। তুই বল।
সৈকত: তাহলে তুইই বল, এই জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন? কেন তুই তিন মাস দুজন আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি? আরে এটা কি তোর অফিস, যে তুই যে কাউকে শাস্তিস্বরূপ বা হিংসার বশবর্তী হয়ে তিন মাসের ওএসডি করে রাখলি? দাম্পত্য জীবনের সমস্যা, সমস্যার ভিতরে থেকে সমাধান করতে হয় রে বন্ধু। দাম্পত্য জীবনটা একেবারেই আলাদা এবং তুই খেয়াল করলে বুঝতে পারবি প্রত্যেকের দাম্পত্য জীবন, একজনের থেকে আরেকজনের সম্পূর্ণ আলাদা। আর আলাদা হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সুখী হওয়া। না চাইলে কেউ সুখী হতে পারে? ঐ যে একটা গান আছে না
"এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনা"
প্রেমটা থাকতেই হবে, হয়তো বা বয়সের কারণে প্রেমের স্বরূপ চেঞ্জ হবে।
আকাশ: আসলে অভিজ্ঞতা ছিল নাতো, তাই।
-বলে হাসতে থাকে। কারণ পরিস্থিতিটা একটু গম্ভীর হয়ে গেছে।
সৈকত: তুই যেভাবে বলছিস, তাতে মনে হচ্ছে আমার এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।
-বলে সৈকতও হাসতে থাকে।
দু'জনে গ্লাসে আবার রেড ওয়াইন ঢেলে নিয়ে চুমুক দেয়।
আকাশ: না তোর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু তুই খুব ভালো মেইনটেইন করতে পারিস।
সৈকত: নীরাকে আগে নিয়ে আয়, যদি প্রয়োজন মনে করিস তোকে কিছু টিপস দেবো না হয়। একদম ফ্রি। এখন বল তো, তুই হঠাৎ করে ঐ কথাটা নীরাকে কেন বলেছিলি?
আকাশ: দেখ, কোনো কিছুই তো হঠাৎ করেই আর হয় না। গত কয়েক মাস ধরেই আমাদের মধ্যে নানা ইস্যু নিয়ে টানা পোড়েন চলছিল। হয়তো বা সে যেমনভাবে আমাকে পেতে চেয়েছিল, আমি সেইভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারিনি আবার হয়তো আমি যেভাবে তাকে চাইছিলাম, সে আমার কাছে তেমনভাবে ধরা দেয়নি। আমি যেমন অফিসের কাজের বিভিন্ন ঝামেলায় থাকতাম, সেও হয়তো একা একা বাসায় থেকে বোর হয়ে থাকতো। যখন আমাকে পেতো তখন তার সকল কথামালা নিয়ে বসতো যেগুলো নিয়ে সে সারাদিন ভেবেছে। এদিকে সবদিন তো আর আমার মেজাজ একরকম থাকেনি ঠিক যেমন তার মনটাও হয়তো একরকম থাকেনি। তো সবকিছুতে তার সাথে কথা কাটকাটি চলতেই থাকতো। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, যে হয়তো আমরা আর কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না। তাই ভেবেছিলাম একটা বিরতি নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে তোকে আমি আমার এখনকার রিয়েলাইজেশনটা বলছি বলেই হয়তো, তার বিষয়টাও অনেকটা পজিটিভলিই তোকে বলতে পারছি। কিন্তু তখন কিন্তু আমি তার বিষয়ে পজিটিভ ছিলাম না একদমই। যেমন এখন তার অনেক অনেক পজিটিভ দিক আমার মাথার ভিতর ঘোরাফেরা করে। আমি কি তোকে বোঝাতে পারলাম?
এতক্ষণ মন দিয়ে সৈকত আকাশের কথা শুনে গেছে, এক চুমুক ওয়াইনও মুখে তোলেনি। এবার সে তার গ্লাসের ওয়াইন একবারে শেষ করে একটু ছোলা মুখে দিলো। আকাশও তার গ্লাসের ওয়াইন শেষ করে এবার একটা সিগারেট জ্বালিয়ে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল
-কেন জানি না, তোকে সব কিছু বলতে পেরে আজ নিজেকে একটু হালকা লাগছে।
সৈকত: তোর সবটা শুনলাম বটে, তবে সবকিছু তো আর তোর মতো করে বোঝা সম্ভব নয়। তবে বেশ কিছুটা বুঝলাম। তোর কিছু পরবর্তনও খেয়াল করলাম। আরও কিছু পরিবর্তন তোর ভিতর আনতে হবে। সবটা এখন বলবো না। নীরা'কে আগে নিয়ে আয়, তখন বলবো।
আকাশ: আরও পরিবর্তন?
সৈকত: হ্যাঁ, আরও পরিবর্তন। নিজেকে ভেঙে ফেল। নীরার সাথে প্রথম দেখাতে তুই তোর ভুল স্বীকার করে সরি বলবি। পারবি তো?
আকাশ সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে আলো আঁধারের শূন্যে মিলিয়ে দিয়ে বলল
-পারবো।
সৈকত: গুড, এই তো লক্ষ্মী ছেলের মতো কথা।
আকাশ মুচকি হেসে সৈকতের দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা
এগিয়ে দিয়ে বলে
-নে এবার একটা সিগারেট ধরা।
সৈকত: আকাশ, মাসখানিক ধরে আমি আর সিগারেট খাচ্ছি না।
আকাশ: সুমি নিষেধ করেছে বুঝি?
সৈকত: নিষেধ তো অনেক দিন ধরেই করে আসছে। তবে এইবার এটাও বিসর্জন দিলাম। এমনিতে আমার হাই ব্লাড প্রেসার আছে। মদটাও আমি আর খেতে চাই না জানিস। এইজন্যই আজ রেড ওয়াইন মানে হালকা জিনিস খাচ্ছি। সুমীর সাথে আমি তো সব কিছুই শেয়ার করি। আজ যে তোর সাথে বসেছি এবং খাবো, সেটাও তাকে বলেছি। ও শুধু বলেছে, একটু কম খেতে আর তোকে যেন আমি নীরা’কে নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করি।
আকাশ: সত্যি, তোদের মতো বন্ধু পেতে ভাগ্য লাগে। চল তাহলে উঠি।
সৈকত: হ্যাঁ, চল।
আকাশ মোস্তফা’কে বিল, টিপস আর ধন্যবাদ জানিয়ে সৈকতকে নিয়ে নিচে নামল।
রাত এখন এগারোটা। টিপসি ড্রাগনের নিচে পার্ক করা গাড়ির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। দুই বন্ধু নিচে এসে ফাঁকা একটা জায়গাতে এসে দাঁড়িয়েছে। সৈকতের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে কাছেই দাঁড়িয়েছে। সৈকত ড্রাইভারকে হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝিয়ে দিল একটু অপেক্ষা করতে। আকাশ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোঁটে ধরে লাইটার দিয়ে সেটায় আগুন ধরিয়ে একটা টান দিলো। সৈকত আকাশের কাঁধে হাত রেখে বলল
-ভাবিস না বন্ধু, সব ঠিক হয়ে যাবে। নীরার সাথে কথা হবার পরে আমাকে ফোন করিস। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
আকাশ: অবশ্যই বন্ধু, জানাবো। আমাকে আজ সময় দেবার জন্য তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকিস তোরা।
সৈকতের সাথে কর মর্দন করে আকাশ তাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। গাড়ি রওনা দিলে হাত নাড়িয়ে বন্ধুকে বিদায় জানালো। আকাশ সিগারেটটা শেষ করে সেটা নিভিয়ে ডাসবিনে ফেললো। আনিস গাড়ি নিয়ে দরজা খুলে স্যারকে গাড়িতে উঠার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করলো। আকাশ গাড়িতে উঠে বসল। আনিস গাড়ি স্টার্ট দিলো।
রাস্তায় এখন গাড়ির চাপ কম। সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে গাড়ি। আকাশের চোখ সামনের দিকে। এই সময়ে রাস্তায় ট্র্যাফিক সিগন্যাল লাইট খুব ভালোভাবে দেখা যায়। গ্রিন লাইট, রেড লাইট সব পরিষ্কার। অথচ বেশিরভাগ ড্রাইভার রাতের বেলায়ই সিগন্যাল মানতে চায় না। এ কারণেই রাতে ভালোই এক্সিডেন্ট হচ্ছে। এফ এম রেডিও চলছে। আকাশ আনিসকে সিগন্যাল লাইট দেখে সাবধানে গাড়ি চালাতে বললো। সামনে কিছুদূর যেতেই রেড সিগন্যাল পড়ল। আনিস ফাঁকা রাস্তায় একাই শুধু সিগন্যাল মেনে দাঁড়িয়ে রইল। এফ এম রেডিও'র আর জে বলছে "আপনার শুনছেন এপার বাংলা, ওপার বাংলার পুরোনো ব্যান্ডের গানের অনুষ্ঠান নস্টালজিক ব্যান্ড। সাথে আছি আমি আর জে সোনিয়া। এখন শুনবেন কলকাতার মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের একটা জনপ্রিয় গান। লেটস এনজয় দ্য সং। রেড থেকে গ্রিন সিগন্যাল। গাড়ি ছুটে চলেছে। গান শুরু হয়েছে-
"কাঁপে কাঁপে
আমার হিয়া কাঁপে
এ কি যে কাণ্ড
এ কি যে কাণ্ড
এ কি কাণ্ড সব পণ্ড এ ব্রহ্মাণ্ড
শূন্য লাগে
তুমি ছাড়া শূন্য লাগে ॥
কি যে ছাই চিন্তা
কি যে ছাই চিন্তা
কি ছাই চিন্তা ওহে কান্তা পোড়ে প্রাণটা
দুঃখ জাগে
তুমি ছাড়া শূন্য লাগে ॥
কপালটা মন্দ
কপালটা মন্দ
কপাল মন্দ লাগে ধন্দ কাটে ছন্দ
বিরহ রাগে
তুমি ছাড়া শূন্য লাগে ॥"
গাড়ি আকাশের এপার্টমেন্ট বিল্ডংয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আনিস এসে দরজা খুলে দিলো। আকাশ গাড়ি থেকে নেমে লিফট লবির দিকে হাঁটা শুরু করলো। আনিস পিছন থেকে বলল
-স্যার, কাল কখন আসবো?
আনিস পিছন দিকে ফিরে বলল
-সকাল সাড়ে দশটায় আসবেন।
আনিস সালাম জানিয়ে গাড়ির কাছে ফিরে গেল। আকাশ লিফটের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। লিফট নিচে নামছে। অল্প কিছুক্ষণ পরে কেয়ারটেকার বলল "স্যার, লিফট এসে গেছে, উঠুন।" আকাশ লিফটে উঠে টেন এ প্রেস করলো। তার সাথে উঠার আর কেউ নেই। তাই লিফট একটানে দশে পৌঁছে গেল। আকাশ লিফট থেকে বের হয়ে তাদের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ফ্ল্যাটের নাম ‘নীরাকাশ’, নামটা নীরারই দেয়া। এই সময়টাতে আকাশের খুব খারাপ লাগে। নিজেকেই চাবি দিয়ে দরজা খুলতে হয়, কেউ আর এখন তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে না।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুল প্রসাদ সেন, ব্যান্ড: মহীনের ঘোড়াগুলি, ব্যান্ড: চিরকুট]
মন্তব্য করুন