• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

টিভি অনুষ্ঠানের মানোন্নয়নে দুটি সম্ভাব্য পদক্ষেপ

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

  ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ২১:২৫

টেলিভিশন অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও তৈরি করাকে আমরা অনেকে সহজ কাজ হিসেবে নিয়েছি। বাস্তবে এটা এত সহজ কাজ নয়। আমরা আমাদের মেধা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি মেটাবার জন্যে টিভি অনুষ্ঠান তৈরিকে সহজ করে নিয়েছি। সেইজন্যে আজ আমাদের অনুষ্ঠানের এই দশা হয়েছে। কতো কষ্ট করে, কতো অর্থ ব্যয় করে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠান তৈরি করেন। কিন্তু লোকমুখে শোনা যায়, বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই নাকি দর্শকরা দেখেন না। বেশিরভাগ দর্শকই নাকি ভারতীয় নানা টিভি চ্যানেল দেখেন। এসব শোনা কথার উপর তেমন আস্থা রাখতে পারি না। কারণ দর্শক মতামত বিষয়ে আমাদের দেশে কোনো বার্ষিক জরিপ কাজ পরিচালিত হয় না। মিডিয়া বিষয়ে যেসব সরকারী প্রতিষ্ঠান কাজ করে (তাদের ফান্ড রয়েছে) তারাও এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ও মিডিয়া বিষয়ক নিয়মিত গবেষণা (দর্শক / পাঠক মতামত জরিপ) করার জন্যে তাদের অধিনস্থ প্রতিষ্ঠানকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। অর্থাৎ সরকারী পর্যায়ে মিডিয়া বিষয়ক মতামত জরিপ ধরনের কোনো গবেষণা হয় না বললে চলে। অথচ প্রেস ইনস্টিটিউট বা জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের এরকম বার্ষিক গবেষণা কর্মসূচি থাকা উচিত ছিল। তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা আমলারাও মিডিয়া বিষয়ক নিয়মিত গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমি এখানে ‘নিয়মিত’ শব্দটি বার বার ব্যবহার করছি। কারণ পাঁচ বছর আগের একটা গবেষণা দেখিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান বলতে পারে : ‘কেন, আমরা তো গবেষণা করি।’Ñ গবেষণা সব সময় হালনাগাদ হতে হয়। আশির দশকের বিটিভির অনুষ্ঠানের জনমত জরিপ দিয়ে ২০১৬ সালের বিটিভির অনুষ্ঠান সম্পর্কে দর্শক মতামত বোঝা যাবে না। প্রতি বছরই মতামত জরিপের বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুসরণ করে অনুষ্ঠান বিষয়ক (প্রধান দু-তিনটি অনুষ্ঠান) দর্শক মতামত জরিপ করা উচিত। টিভি চ্যানেল নিজেরা যেন এই গবেষণা না করে। কোনো পেশাদারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করাতে হবে। কেবল তাহলেই একটা নিরপেক্ষ চিত্র পাওয়া যাবে।

এই মতামত জরিপ টিভিতে প্রচারের জন্যে নয়। টিভি চ্যানেলের নীতি নির্ধারক ও অনুষ্ঠান বিভাগের কৌশল নির্ধারণের জন্যে খুব জরুরী। এই জরিপের ফল প্রকাশ না করাই ভালো হবে। এটা টিভি চ্যানেলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এধরনের মতামত জরিপ পরিচালনার জন্যে টিভি চ্যানেলের বার্ষিক বাজেট থাকা উচিত।

এ ধরনের মতামত জরিপের ফল থেকে টিভি চ্যানেল তাদের অনুষ্ঠানের একটা মূল্যায়ন করতে পারবে। এর মাধ্যমে কোন অনুষ্ঠান অব্যাহত রাখবে, কোন অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেবে তার একটা দর্শক মতামত পাওয়া যায়। ‘মতামত জরিপে’ দর্শকদের চাহিদা সম্পর্কেও জানা যায়। সম্ভব হলে দর্শক চাহিদা থেকেও বছরে একটি দুটি অনুষ্ঠান করা যায়। যে ধরনের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বেশি দর্শকের চাহিদা রয়েছে সেরকম অনুষ্ঠান বিবেচনা করা যায়।

টিভিতে একটি মাসিক অনুষ্ঠান করা যায় দর্শকের মতামত (চিঠি ও ইমেইল) নিয়ে। এই অনুষ্ঠানে ঐ মাস বা সামগ্রিক অনুষ্ঠান সম্পর্কে দর্শকের মতামত চাওয়া যেতে পারে। কিছু কিছু মতামতের জবাবও দেয়া যায়। ‘বিবিসি বাংলার’ ‘প্রীতিভাজনেষু’ অনুষ্ঠান এরকম অনুষ্ঠানের একটি দৃষ্টান্ত। দর্শকের শুধু প্রশংসা নয়, সমালোচনামূলক চিঠিও (যদি থাকে) এখানে পড়তে হবে।

দর্শক মতামতের মাধ্যমে টিভি অনুষ্ঠানের মান বাড়ানো যায়। দর্শক-পছন্দ অনুষ্ঠান প্রযোজনা করা যায়।

আজকাল যে কেউ টিভি চ্যানেলে চাকরি পেয়ে যায়। এটা পেশাদারিত্ব নয়। টিভি চ্যানেলে চাকরী পাওয়ার জন্যে সাংবাদিকতায় ডিগ্রী থাকা যথেষ্ট নয়। কারণ আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বা টিভি বিভাগে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব ও পর্যাপ্ত প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস একটা বড় সীমাবদ্ধতা। যদিও চাকরী করতে করতে অনেক কিছু শেখা যায়। যদি দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির অধীনে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়। সবাই সেই সুযোগ পায় না। একটি টিভি চ্যানেলে সত্যিকার অর্থে প্রশিক্ষিত ব্যক্তি কমই রয়েছে। তার প্রতিফলন দেখা যায় টিভি অনুষ্ঠানে। আমরা যখন বলি, ‘এদেশের দর্শকরা দেশি চ্যানেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে’, তার পেছনে অনেক কারণ থাকে। প্রধান কারণ তিনটি : আমাদের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সত্যিকার প্রতিভাবান, সৃজনশীল প্রযোজকের অভাব, মালিকপক্ষের অসহযোগিতা ও অর্থাভাব। কোনো বড় পদ রাতারাতি কাউকে সৃজনশীল বা প্রতিভাবান বানাতে পারে না। সৃজনশীলতা অনেক পরিশ্রমের ফসল। ছোটবেলা থেকেই তাকে নানা প্রস্তুতি নিতে হয়। ব্যাপক পড়াশোনা তার একটি। সৃষ্টিকর্তার দয়াও থাকতে হয়।

যাঁরা টিভিতে অনুষ্ঠান প্রযোজনার চাকরী নিতে আগ্রহী তাঁদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রী নেবার পর (বার্তা বিভাগ ছাড়া অন্যত্র সাংবাদিকতায় ডিগ্রী থাকার দরকার নেই।) অন্তত ছয় মাসের একটা ফুল টাইম ফাউন্ডেশন কোর্স করা দরকার। দুই মাস থিওরিটিক্যাল, চার মাস প্র্যাকটিক্যাল। পাকিস্তান আমলে ‘বিটিভির’ জুনিয়র প্রযোজকদের লাহোরে এক বছরের ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হতো। তারপর তাঁরা কাজে যোগ দিতে পারতেন। সেকালে ‘বিটিভির’ সাড়াজাগানো অনুষ্ঠান আকাশ থেকে আসেনি। এই প্রশিক্ষিত প্রযোজকদের হাত থেকে এসেছিল।

এই ফাউন্ডেশন কোর্সের কারিকুলাম, শিক্ষক নির্বাচন, কোর্স ফী টিভি মালিক সমিতি ও ‘টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউট’ (তথ্য মন্ত্রণালয়) কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে নির্ধারণ করতে পারে। এই ফাউন্ডেশন কোর্সে যারা ভালো ফল করবে (৬০ শতাংশ নম্বর) কেবল তারাই টিভির প্রযোজক পদে আবেদন করতে পারবে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল তাদের নিজস্ব নিয়মে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রযোজক বাছাই করবে। এই ফাউন্ডেশন কোর্স আগ্রহী তরুণ নিজের উদ্যোগে করবে। এই ফাউন্ডেশন কোর্সে যারা উত্তীর্ণ হবে কেবল তারাই টিভিতে আবেদন করতে পারবে।

নিউজ চ্যানেল ও বার্তা বিভাগের জন্যে ভিন্ন কারিকুলামে একই ধরনের আরেকটি ফাউন্ডেশন কোর্স পরিচালিত হবে।

আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের দর্শক বাংলাদেশের চ্যানেল দেখতে চায়, যদি সেরকম আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল উপহার দিতে পারে। টিভি অনুষ্ঠান, বই ও সিনেমার পাঠক / দর্শক তার পছন্দ অনুযায়ী পড়বে বা দেখবে। এখানে কোনো দেশের বা ভাষার সীমানা (ডাবিং) কেউ মানবে না। সরকার জোরজবরদস্তি করলেও কোনো লাভ হবে না।

উপস্থাপনা বা অনুষ্ঠান পরিচালনা আজকাল টিভির একটা প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেক তরুণ উপস্থাপনায় বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তবে সাদামাটা বা অনুজ্জ্বল উপস্থাপনাও কম নেই। তাদের কারণে অনেক অনুষ্ঠান দর্শকরা দেখছেন না। শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য উপস্থাপকের প্রধান গুণ হতে পারে না। তার মাথায় মালমাশলা থাকতে হবে। উপস্থাপনা নানা প্রকার। সবরকম উপস্থাপনার জন্যে অন্তত তিন মাসের একটা প্রশিক্ষণ জরুরী। দুটি পদক্ষেপ নিলে উপস্থাপনার আকর্ষণ বাড়তে পারে। ১) অনুষ্ঠান পরিকল্পক নিজেই উপস্থাপনা করলে। এতে তার কমিটমেন্টটা থাকে। ২) অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ‘অটোকিউ’ প্রথা বাদ দিতে হবে। অন্যের লেখা তোতাপাখির মতো পড়া উপস্থাপনা নয়। যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থাপনা করতে পারে না তাকে এই কাজ দেয়া উচিত নয়। এই দুটি পদক্ষেপ নিলে উপস্থাপনার আকর্ষণ অনেক বাড়বে।

টক শো পরিচালনা প্রধানত সাংবাদিকের কাজ। এটা অনেকটা সাংবাদিকধর্মী অনুষ্ঠান। সাংবাদিক ছাড়া অন্য কেউ যে টক শো ভালো পরিচালনা করবে না তা নয়। তবে সেটা ব্যতিক্রম। তবে টক শো’তে মডারেটর যদি অতিথির চেয়ে বেশি কথা বলেন, অতিথির কথা বার বার বাধাগ্রস্ত করেন, নিজের মত অতিথির উপর চাপিয়ে দেন তাকে ভালো মডারেটর বলা যায় না। চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে এসব দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। টেলিভিশন স্টুডিও কোনো স্বাধীন জায়গা নয়। এখানে সবাইকে কিছু নিয়ম নীতি মানতে হয়।

বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মালিকের উচিত পুরো পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও নিজের চ্যানেলের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যাপক আলোচনা করা। আলোচনা থেকে কিছু অ্যাকশন প্ল্যান নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।

এই নিবন্ধের মাধ্যমে আমি অনুষ্ঠানের মানোন্নয়নে শুধু দুটি পরামর্শ দিয়েছি চ্যানেল কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্যে। আরো বহু পদক্ষেপের কথা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।

------------------------------------------------------------------

লেখক ১৯৭৭ সাল থেকে টিভি অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও উপস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত।

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh