‘শিল্প হলো গুরুমুখী বিদ্যা, সনদের প্রয়োজন নেই’
শিল্পী আশরাফ হোসেন। যিনি তুলির ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলছেন সভ্যতা, সংস্কৃতি, দেশপ্রেম, মাতৃত্ব ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ মনুষত্বকে। দশকের পর দশক তার সাধনা ও চেষ্টা চলছে। তার চিত্রকর্ম দেশের মানুষের যেমন চিত্তকে করছে তৃপ্ত, তেমনি করছে বিদেশিদেরও। সেই ৯০ এর দশক থেকেই তার চিত্রকর্মের প্রতি বিদেশিদের ঝোঁক। বিদেশিরা তার চিত্রকর্ম দিয়ে ঘর, হোটেল বা অফিসের শোভা বর্ধনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। একইভাবে দেশের শিল্পমনা মানুষও আশরাফ হোসেনের চিত্রকর্মের মাঝে নিজেদের প্রশান্তি খুঁজে পায়।
শিল্পী আশরাফ হোসেন প্রায় চার দশক ধরে একাগ্রচিত্তে ছবি এঁকে গেলেও কখনই নিজের প্রচার ও পরিচিতি প্রকাশের চেষ্টা করেননি। সব সময়ই তিনি থেকেছেন প্রচারবিমুখ।
সমাজের গতানুগতিক ধরার বাইরের একজন তিনি। ছোটবেলা থেকেই শিল্পের প্রতি অনুরাগ থাকায় এক সময় প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষা নিলেও তা শেষ না করেই চলে আসেন। তিনি মনে করেন, যেকোন শিল্প চর্চাই হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা, এখানে সনদ পত্রের প্রয়োজন নেই।
তিনি মনে করেন, কর্মই বড় পরিচয়। যদি আমার কর্ম কাউকে আকর্ষণ করে, তার মনকে প্রভাবিত করে তাহলেই সৃষ্টির স্বার্থকতা। আপাদমস্তক একজন শিল্পী হতেই তার যত আয়োজন।
শুধু ছবি আঁকাই নয়, ভাস্কর্য শিল্পেও আশরাফ হোসেনে খ্যাতি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য নিয়েই তিনি কাজ করেন। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কয়েকটি ভাস্কর্যের কাজ তিনি শেষ করেছেন।
আশরাফ হোসেন বলেন, শিল্পী বিষয়টি অনেক বড়। যদিও অনেকে মনে করেন, তুলির আঁচড় দিয়ে কিছু ছবি আঁকলেই শিল্পী হওয়া যায়। বিষয়টি আসলে সেরকম নয়। শিল্পী হতে হলে তাকে রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মতত্ব, চিত্রকলা সহ সব বিষয়েই জানতে হবে। একজন মানুষ যখন মনে প্রাণে পুরোপুরি শিল্পের ভেতর ঢুকে নিজেকে খুঁজে পায়, তখনই তিনি শিল্পী হতে পারবেন।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের চারুকলাগুলোতে এখন বেশ তাড়াহুড়ো করে কাজ করার প্রবণতা বাড়ছে। কম সময়ে বেশি কাজ করতে চায় সবাই। উদ্দেশ্য একটাই দ্রুত ছবি বিক্রি করে আয় করা। কিন্তু সময়ের মানদণ্ডে ছবি আঁকা যায় না। যদি অর্থ ও সময়ের মানদণ্ডে ছবি আঁকা হয় তাহলে সেখানে শিল্প থাকে না।
তিনি চারুকলার সমালোচনা করে বলেন, ছবি আঁকার কয়েকটি প্রহর আছে। এই প্রহর বুঝেই ছবি আঁকতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ছাত্র ছাত্রীরা একটি ফটোগ্রাফ তুলে নিয়ে তা
দেখে আঁকার চেষ্টা করছে, এমনটা হলে ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে প্রহর জ্ঞান হবে না। প্রভাতের কিরণ , আর দুপুরের কিরণ এক নয়। এভাবে আঁকলে বাজারে ছবি বিক্রি হতে পারে, কিন্তু মৌলিক শিল্পী হওয়া সম্ভব হবে না। বিশেষ করে ল্যন্ডস্কেপের কাজ করলে সেখানে প্রহর জ্ঞান খুবই জরুরী, একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, ফটোগ্রাফ দেখে কখনোই শিল্পের বিষয়টি অনুমান করা যাবে না।
আশরাফ হোসেন মনে করেন, বর্তমানে পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য শিল্পীসত্ত্বাকেও অর্ধের মানদণ্ডে মূল্যায়ন করা হয়। অর্থের প্রয়োজন আছে, কিন্তু অর্থের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নানা বৈধ উপায়ও আছে। কিন্তু সেটি শিল্পকর্ম দিয়ে নয়।
তিনি বলেন, আজকাল অনেক চারুকলা শিক্ষার্থী বলেন, পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস দেব বা ব্যবসা করবো। তাহলে প্রশ্ন আসে যে, কেন তুমি এখানে? আবার অনেকে বলেন, ছবিটবি আমার আঁকা সম্ভব না। ছবিকে টবি বলা যাবে না। এতে আমাদের গাঁয়ে লাগে। আমরা ছবিতে হৃদয় দিলে লালন করি।
আশরাফ হোসেন আরও বলেন, গ্যালারি প্রদর্শনীর মাধ্যমে ছবির ব্যবসা করা নতুন আরেকটি পুঁজিবাদী প্রেতাত্বা হাজির হয়েছে, গ্যালারির ছবি বিক্রির টাকা শিল্পীর পকেটে যায় না। সেটি চলে যাচ্ছে গ্যালারির মালিকের পকেটে। তাতে শিল্পীকে আরও অসহায় করে দিচ্ছে। যদি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি শিল্পীর কাছ থেকে ছবি কেনে তাহলে এই মধ্যস্বত্ব ভোগীদের রোধ করা সম্ভব।
এমকে
মন্তব্য করুন