• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

পদ্মা সেতু, আমাদের অতীত স্মৃতি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

মো. ফরিদ আহমেদ

  ২৪ জুন ২০২২, ২৩:১৬

১৯৮৬ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা থেকে ঢাকা যেতে হবে। সরাসরি ঢাকা যাওয়ার একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল লঞ্চ। লঞ্চ ঘাটে যাওয়ার জন্য জোয়ার-ভাটার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সন্ধ্যা ৭ টায় আমরা কয়েকজন মঠবাড়ীয়া থেকে নৌকাযোগে তুশখালীতে লঞ্চের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। রাত ৩ টায় লঞ্চ তুশখালি ঘাটে আসবে। পরবর্তী সারাদিন সারারাত চলার পরে আমরা ঢাকা সদরঘাটে পৌঁছব। এভাবে মঠবাড়িয়া থেকে ঢাকা সরাসরি ১৬০ কি. মি. যেতে ৪০ ঘণ্টা সময় লাগতো। সে হিসেবে একজন মানুষের যদি রাজধানী ঢাকায় সপ্তাহে একবার যাতায়াত করতে হতো তবে তাকে অর্ধেক সপ্তাহ রাস্তায় কাটাতে হতো।

আমরা অনেকেই শখ করে বা জরুরী কাজে সড়ক পথে রাজধানী ঢাকাতে যেতাম। ঐ সড়কের অবস্থা এমন ছিল যে, ঝাঁকুনির কারনে অনেক সময় সুস্থ মানুষ অসুস্থ হতো এবং অসুস্থ মানুষও সুস্থ হয়ে যেত। আমার এক ভাইয়ের কানের ভিতরে পেন্সিলের সরু খণ্ড ভেঙ্গে ঢুকে যায়। জরুরী ভিত্তিতে তাকে নিয়ে সড়ক পথে নাক-কানের অভিজ্ঞ ডাক্তারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রাস্তার ঝাঁকুনির অবস্থা এমন ছিল যে কিছুদূর যাওয়ার পরে তাঁর কান থেকে পেন্সিলের টুকরো নিজে নিজেই বেড় হয়ে আসে। তাকে আর ডাক্তারের কাছে নেওয়ার প্রয়োজন হয় নি। তবুও যদি কারো ঢাকা যেতে হতো তবে তাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় ১৪ টি ফেরি পার হয়ে পদ্মা ফেরি ঘাটে পৌঁছাতে হত। এরপর পদ্মা ফেরির জন্য ২০ থেকে ৩০ ঘণ্টা অপেক্ষা করে রাজধানী ঢাকাতে পৌঁছানো অনেকটা কলম্বাসের আমেরিকা জয়ের মত ছিল।

২০০৯ সালের কথা। আমি টরন্টো থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ঠিক একই সময়, আমার মা আমাকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মঠবাড়িয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সমস্ত বিশ্ব প্রদক্ষিণের তিন ভাগের একভাগ দূরত্ব পারি দিয়ে আমি ঢাকায় অবতরণ করি। কিন্তু সেই একই সময়ে আমার মা আমার অতিক্রান্ত দূরত্বের এক শতাংশ দূরত্ব পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারেন নি। মায়ের এই দুর্দশার কারণ ছিল পদ্মা তীরে ফেরির জন্য দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা। বাংলাদেশের চার ভাগের একভাগ মানুষ যুগ যুগ ধরে এভাবেই ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিত। একটি কথা আছে যে, "ধৈর্য এবং দৃঢ়তা সবকিছুকে জয় করে। তাইতো, বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায় যে সম্ভাবনাময় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ধৈর্যশীল এই তিন কোটি মানুষকে গতি দিতে পারলে ২০২৬ সালের মধ্যে তারা বাংলাদেশের অবস্থান জিডিপিতে বিশ্বে তিন নাম্বারে নিয়ে যাবে যা কিনা বর্তমান জাপানের অবস্থান। এর ফলে বাংলাদেশের দরিদ্র সীমার অবস্থান এক ভাগেরও নিচে নেমে আসবে।

গঙ্গা এবং যমুনা, যে দুটি নদী, চীন, নেপাল, ভুটান এবং ভারতের অনেক নদীর মিলিত প্রবাহ বহন করে, যা পদ্মায় এসে পতিত হয়। ফলে, বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা অন্যতম। এই নদী দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১ লক্ষ ১৫ হাজার টন পলি এবং প্রায় ১১ কোটি ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হয়। এই নদী ভূমিকম্পের খুবই ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। এর গভীরতা ৪০ মিটার। বর্ষাকালে স্রোতে বয়ে নিয়ে যায় আরো ৬৫ মিটার মাটি। বিভিন্ন সময়ের উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, পদ্মা নদীর প্রস্থ খুবই পরিবর্তনশীল। এই পদ্মা নদীর উপর সেতু আমাদের জন্য এ ছিল এক অকল্পনীয় বিষয়।

রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকতে পারবে এমন ১০ হাজার টন ক্ষমতার চার লেনের পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৬,১৫০ মি. এবং প্রস্ত ১৮:১৮ মি.। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নদী শাসন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে খরস্রোতা পদ্মা সেতুর পিলারের নিচে তিন মিটার ব্যাসার্ধের সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে যা বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিশ্বে এখনও পর্যন্ত কোন সেতুর জন্য এত গভীরে এত মোটা পাইলিং বসানো হয়নি। রাজধানী ঢাকাকে যদি আমরা বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড ভাবি আর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল একটি অঙ্গ, তবে মানুষকে বাঁচাতে যেমন হৃৎপিণ্ডের সাথে নিরবিচ্ছিন্ন রক্ত চলাচল দরকার তেমনি পদ্মা সেতু আমাদের সব অঞ্চলের সাথে সমতার সাথে বাঁচিয়ে রাখবে। একাডেমিক জগতে পদ্মা সেতু প্রকৌশল শিক্ষার একটি অনন্য সৃষ্টি হিসাবে পৃথিবীর বুকে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বাংলাদেশে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন একটি গর্বের বিষয়। একটি গর্বিত জাতির মর্যাদা টাকার বিনিময়ে হয় না। জাতি হিসেবে গর্বিত হতে পারা অনেক বড় বিষয়। একটি কথা আছে যে, "ক্ষুধা মানুষকে নিচে নিয়ে আসে, কিন্তু গর্ব তাদের উঠতে সাহায্য করতে পারে"। পদ্মা সেতু আমাদের জীবনকে উপভোগের জন্য দীর্ঘায়িত করবে। এর মাধ্যমে আমরা যে সমতা, সময়, সম্মান, শিক্ষা এবং জীবন পাবো, তার কাছে টাকা অতীব নগণ্য। বিভিন্ন রকমের গুজব আমাদের মর্মাহত করে এই ভেবে যে, বিশাল অর্জনেও আমরা কেন এক হতে পারি না! 'একতাই বল" এই মর্ম বাণী অন্তরে ধারণ করে আমরা আশা করতে চাই যে, বাংলাদেশের জন্মের দ্বিতীয় মাইলফলক এই পদ্মা সেতু আমাদেরকে একীভূত করুক।

বাংলাদেশের এই দ্বিতীয় মাইলফলকের রূপকার, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, আপনাকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে অভিবাদন জানাই। আপনি যুগ যুগ ধরে আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।

লেখক- অধ্যাপক এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ, বরিশাল।

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
ছুটির ৫ দিনে পদ্মা সেতুতে যত টাকার টোল আদায়
গ্লোবাল এন্টারপ্রেনারশিপ বুটক্যাম্পে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র গেলেন আস্থা গ্রুপের সিইও
পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় নিহত ১
পদ্মা সেতুতে একদিনে টোল আদায়ে রেকর্ড
X
Fresh