শুদ্ধ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকদের ভূমিকা
‘সমাজ ও সমাজের লোকের মধ্যে প্রাণগত, মনোগত মিলনের ও আদানপ্রদানের উপায়স্বরূপে মানুষের শ্রেষ্ঠ যে সৃষ্টি সে হচ্ছে তার ভাষা। এই ভাষার নিরন্তর ক্রিয়ায় সমস্ত জাতকে এক করে তুলেছে; নইলে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে মানবধর্ম থেকে বঞ্চিত হতো।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাতেই ভাষার গুরুত্ব ও কার্যকারিতা স্পষ্ট। ভাষাহীন মানুষ বিচ্ছিন্ন; ভাষাহীন আওয়াজ প্রত্যক্ষ ভাব প্রকাশে সমর্থ হলেও সুক্ষ্ম বোধ বা নিত্যকার দিনালাপ ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়।
বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের মুখের ভাষাও বাংলা। ১৩শ’ বছরেরও বেশি প্রাচীন এক মহান ভাষার উত্তরাধিকারী আমরা। শুধু উত্তরাধিকারীই নয়, বরং পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য সংগ্রাম করে তাজা প্রাণ পরম মমতায় আর উদ্ধত বিপ্লবে বিলিয়ে দিয়ে সেই পথ বেয়ে ভাষার অধিকার আদায় তো করেছিই তার পাশাপাশি জাতিগত ও ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা অর্জনের মহাকাব্যও রচনা করেছিলেন আমাদের পূর্ব প্রজন্ম।
ভাষার অধিকার এবং শুদ্ধ বাংলা চর্চার গুরুত্ব :
সাগর সমান রক্তের স্রোত পেরিয়ে বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সত্তর বছরপূর্তি হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার ও শফিউর রহমানসহ নাম না জানা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের ভাষার অর্জন শুধু গৌরবের নয়, অবিস্মরণীয়ও বটে। এই আত্মত্যাগ আর দাবির ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গৃহীত হয় এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার মধ্য দিয়েই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ তরান্বিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হয় বাংলাকে।
ভাষা হিসেবে বাংলা প্রাচীন মাগধী থেকে আরও বিস্তৃত, মিশ্রিত ও গভীর হয়ে দূর কালের সাথে বর্তমান কালের আর বহুদেশের অজানা চিত্তের সঙ্গে বাংলাদেশের নবজাগ্রত চিত্তের মিলনের দৌত্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। নানা রূপ, রস আর ছন্দে বাংলা ভাষা পেয়েছে সমৃদ্ধি, আপন শক্তিতে বিকশিত হয়েছে। বিকাশের এই ধারায় বাংলা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে বিজাতি ভাষার আগ্রাসনে। ভাষার বিকৃতি নানা সময়ে আমাদের গর্বের বাংলাকে দীপ্তিহীন করতে চেয়েছে এবং এখনো যার সমাপ্তিরেখা টানা যায়নি; অথচ এর সম্ভাব্য ও প্রমাণিত পরিণতি সুদূরপ্রসারী।
এ প্রসঙ্গেই প্রখ্যাত উপস্থাপক হানিফ সংকেত বলেছেন, ‘আমাদের সত্তায়, মননে যেভাবে পরজীবী হওয়ার চাষ চলছে, তাতে যেকোনো সময়ই সর্বনাশ ঘটতে পারে। নিজের ভাষা ভুলিয়ে, হিন্দি-ইংরেজি গুলিয়ে শিশুদের যে অপভাষা গেলানো হচ্ছে তার পরিণতি খুব ভালো নয়।’
সত্যিই তাই! মানভাষা- রবীন্দ্রনাথ যাকে প্রাকৃত ভাষা বলেছেন সেই শুদ্ধ বাংলার চর্চায় আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি। ফলে, না পারছি মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চা করতে, আর না পারছি বিদেশি ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিশ্চিত করতে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চা অন্য ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিশ্চিত করে। আর অন্য ভাষার শুদ্ধ চর্চা থেকে সীমাহীনভাবে উপকৃত হয় মাতৃভাষা। শুদ্ধ ভাষা চর্চা, শুদ্ধ চেতনাকে জাগিয়ে তোলে এবং শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার ভেতর দিয়েই একটি জাতি যেমন এগিয়ে যেতে পারে, তেমনি আরেকটি জাতিকেও এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করে।’ এসব বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে, শত সংগ্রাম আর ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিমেয়ে অর্জিত বাংলা আজ গভীর সংকটের মুখে। বাংলা-ইংলিশের সংমিশ্রণে বাংলিশ কিংবা প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে বিকৃত রূপের বাংলা চর্চার থাবায় বাংলা ভাষার প্রকৃত স্বাদ যেন বিস্বাদে পরিণত হচ্ছে।
আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার অবশ্যই দোষণীয় কিছু নয়, বরং ভাষার বৈচিত্র রক্ষায় এবং মাটির টানে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটি সুশৃঙ্খল ভাষারীতি মেনে চলা, বিশ্ব দরবারে পরিপাটি বাংলা ভাষার পরিচিতি দানে, বিশেষ করে আনুষ্ঠানিক ও গুরুত্বপূর্ণ সভায় সার্থক ও সমার্থক যোগাযোগের প্রয়োজনেই আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবমুক্ত, গুরুচণ্ডালি দোষবিযুক্ত, বিকৃতিহীন এবং বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণ ব্যতিত একটি ভাষারীতি থাকা দরকার, যা শুদ্ধ বা মান ভাষার ব্যবহারেই অধিক পরিণতি পেতে পারে। যার প্রয়োজনীয়তা হাসান আজিজুল হকের মতো বিভিন্ন কথাসাহিত্যিকরা নানা সময়ে বলে এসেছেন।
শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকের ভূমিকা :
গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। গণমাধ্যম তথা পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন কিংবা বেতার শুধু খবর জানা বা প্রকাশের মাধ্যমই নয় বরং শিক্ষা এবং বিনোদনেরও মাধ্যম। আর তাই গণমাধ্যমে বিশেষত টেলিভিশন ও বেতার মাধ্যমে প্রমিত বা শুদ্ধ বাংলা চর্চার মাধ্যমে একটি শুদ্ধ বা মান বাংলা ভাষার প্রসারের সুযোগ অতুলনীয়। দেশের কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিত অধিকাংশ টেলিভিশন ও বেতারেই শুদ্ধ বাংলার চর্চা লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে, সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তো এর বিকল্প নেই। আবার যাদের মাধ্যমে শুদ্ধ বাংলায় সংবাদ প্রচার করা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুকরণীয় এবং আকর্ষণীয়ভাবে শুদ্ধ বাংলার চর্চা করে থাকেন সংবাদ উপস্থাপকগণ।
বিকৃতিহীন ও প্রমিত বাংলা ভাষা চর্চায় সংবাদ উপস্থাকগণ সবসময়ই আতসী কাঁচের নিচে থাকেন। উপস্থাপকমাত্রই শুধু তার নিয়োগকর্তা নয়, বরং হাজারো দর্শক-শ্রোতার সার্বক্ষণিক তীক্ষ্ম ও সূক্ষ্ম নজরদারি ও জবাবদিহির মধ্য দিয়ে সংবাদ উপস্থাপনা করে থাকেন। কোনো তথ্যগত ভুল কিংবা বিকৃত যেমন তার কাছ থেকে অগ্রহণযোগ্য হয়, তেমনি একটিমাত্র ভুল বা বিকৃত উচ্চারণও সংবাদ উপস্থাপকদের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত নয়। প্রতিনিয়ত সঠিক শব্দের সঠিক উচ্চারণ এবং সঠিকভাবে প্রক্ষেপন সংবাদ উপস্থাপকদের একটি পেশাগত দায়বদ্ধতা। ‘আওভান’ কিংবা ‘কোরে’ অথবা ‘ফসলে’র মত বহুল ভুল উচ্চারণ হওয়ার সম্ভাবনাময় শব্দগুলোকে অবলীলায় বাকযন্ত্র ও প্রশ্বাসের সঠিক প্রক্ষেপণের মধ্য দিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণ করে থাকেন সংবাদ উপস্থাপকগণ। যে শব্দের উচ্চারণ যত জটিল, উপস্থাপকদের জন্য সেই শব্দের সঠিক চর্চা ও প্রক্ষেপণ ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর একারণেই শুদ্ধ বাংলা চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকদের ভূমিকা অপরিসীম। এই পেশাগত দায় নিয়েই বছরের পর বছর সংবাদ উপস্থাপকগণ বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও শুদ্ধতম প্রসারে একনিষ্ঠ সাধক।
প্রশ্ন আসতে পারে, সংবাদ উপস্থাপকগণ কি ভাষার বিকৃতি করেন না তাহলে? একদমই অস্বীকারের উপায় নেই, যে তা কদাচ হয় না বটে! তবে তা কোনোভাবেই তাদের মানস্থাপক নয়। বরং সংবাদ উপস্থাপকদের অনেকক্ষেত্রেই যেভাবে মূল্যায়ন করা হয় কিংবা যেভাবে ‘লিখিত সংবাদ’ অটোকিউতে হুবহু পাঠ করার চর্চাগত একটি বাধ্যবাধকতা নির্দিষ্ট করা হয়, তা যেমন তাদের শব্দগত বা ভাষাগত বৈচিত্র প্রকাশের প্রতিবন্ধক, আবার অনেকক্ষেত্রেই তুলনামূলক অপ্রস্তুত অবস্থায়ও অনেককে উপস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসবের মধ্য দিয়ে সংবাদ উপস্থাপকদের একটি ক্ষুদ্রাংশের শুদ্ধ ভাষার চর্চায় নেতিবাচকতা কদাচ দেখা গেলেও, ইতিবাচক প্রভাবের বিপরীতে তা নগন্য ও অগণ্যও বটে!
বিভিন্ন নাটক সিনেমা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমবাহিত ভাষা বিকৃতির যখন নতুন প্রজন্মের বৃহৎ একটি অংশ স্মার্টনেস প্রকাশের প্রত্যয় থেকে ভিন্ন ভাষার মিশ্রণে জোশ, পিনিক, অসাম, মাগার, বিন্দাস, প্যারা, মাইরালা, খ্রাপ, সেইরাম, ভাল্লাগছে, আজিব, তার ছিঁড়া ইত্যাদি নানারকম অদ্ভুতুড়ে শব্দ বাংলা হিসেবেই ব্যবহার করছে, তখন এ ভাষায় হয়তো ভাব প্রকাশ হচ্ছে, কিন্তু ভাষার যে মাধুর্য কিংবা সুকুমারবৃত্তি তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে বাংলা ভাষায় বিকৃত শব্দসমষ্টির সমাহারের সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে। ঠিক এখানেই আবার সংবাদ উপস্থাপকরা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিশ্চিতে অতন্দ্র প্রহরী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তৃণমূল পর্যন্ত শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা ইথারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। শহুরে আবাসিক থেকে শুরু করে তৃণমূলের প্রান্তিক মানুষ পর্যন্ত মান ভাষা পৌঁছে দেওয়া এবং মান ভাষার শিক্ষা লাভে সংবাদ উপস্থাপকরা অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। নানান প্রান্তের, নানা অঞ্চলের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার মানুষ সংবাদ উপস্থাপকের উপস্থাপনা, উচ্চারণ ও শব্দের প্রক্ষেপণের মধ্য দিয়েই মান বা শুদ্ধ বাংলা শিখে থাকে। স্থানীয় যেকোনো মানুষ সংবাদ উপস্থাপকের উপস্থাপিত শব্দ বা উচ্চারণের অনুকরণ করে মান ভাষা শিখতে পারেন। আবার যার হয়তো মান বা শুদ্ধ বাংলা ভাষা শেখার কখনো কোন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি, তিনিও টেলিভিশন কিংবা রেডিও মাধ্যমে সম্প্রচারিত সংবাদের উপস্থাপকের মাধ্যমে খুব সহজেই শুদ্ধ বা মান ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
শুদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকের ভূমিকা :
শুধু কি শুদ্ধ ভাষার চর্চাতেই বাংলার প্রতি সংবাদ উপস্থাপকদের অবদান শেষ হয়ে যায়? উত্তর হবে, না। বরং চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতির প্রসার এবং শুদ্ধতম বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশেও সংবাদ উপস্থাপকগণ সর্বাগ্রে আছেন। বাংলা ও বাঙালির কিংবা আমাদের জাতিগত পরিচিতিমূলক বিভিন্ন উৎসব বা জাতীয় ও সাংস্কৃতিক দিবসে দেশীয় তথা বাঙালি পরিচিতির ধারক প্রথাগত সাজ, পোশাক কিংবা প্রসাধনী ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকরা সবসময়ই মানস্থাপক। যখন নানা বহিঃস্থ প্রভাব বাঙালির আকর বিস্মৃত করতে চায়, তখন সংবাদ উপস্থাপকদের মধ্য দিয়েই তা টিকে থাকে, প্রচার ও প্রসার লাভ করে। ফরাসী ভাষাতাত্ত্বিক ক্লদ লেভি স্ট্রস (১৯৭৮) সংস্কৃতি ও মানুষের ইন্দ্রিয়গত চিন্তার সম্পর্ক স্থাপনে ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সংবাদ উপস্থাপকগণ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে বাঙালির ইন্দ্রিয়গত চিন্তায় যে ইতিবাচক প্রভাব রাখছেন, দীর্ঘমেয়াদে শুদ্ধতার মাননির্ধারক হিসেবেই কাজ করে। তাই শুদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকদের অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে।
সংবাদ উপস্থাপক : বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
সংবাদ উপস্থাপক শব্দবন্ধনী আভিধানিকভাবে কোন একটি ঘটনা বা বিষয়ের বিবৃতকারী বা উপস্থাপনকারী বোঝালেও আদতে ইংরেজিতে ‘নিউজরিডার’, ‘নিউজকাস্টার’, ‘নিউজ অ্যাংকর’-এর মতো ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশব্দ রয়েছে। পশ্চিমাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাদের কর্মরত সাংবাদিকের মর্যাদা দেওয়া হয়; যারা শুধু সংবাদ পাঠই করেন না, বরং ঘটনার ধারাবর্ণনা, সাক্ষাতকার গ্রহণসহ আনুষাঙ্গিক অন্যান্য তথ্যসংগ্রহ করে সংবাদ তার দর্শক-শ্রোতার জন্য গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করেন। আর এই উপস্থাপনার ভঙ্গিই মূলত তার প্রতিষ্ঠানের শুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতার নিক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। উপস্থাপক যদি পরিশীলিত, শুদ্ধতম, গ্রহণযোগ্য এবং মানসম্মতভাবে সংবাদ প্রকাশ, পাঠ কিংবা প্রক্ষেপনে অসমর্থ হন, তা তার প্রতিষ্ঠানের জন্যও নেতিবাচক মানদন্ডের কারণ হয়। এপ্রেক্ষিতেই নিউইয়র্কের প্রাক্তন সংবাদ পরিচালক আল প্রিমো বলেন, “যদি একটি সংবাদ অনুষ্ঠান তৈরির জন্য সবগুলো ‘ফ্যাক্টর’ মিলিয়ে দশ নম্বর নির্ধারণ করা হয়, তাহলে সংবাদ উপস্থাপক সেখানে আট পাবে আর বাকি সব ‘ফ্যাক্টর’ একসাথে দুই পেতে পারে। তাহলে কেন সংবাদ উপস্থাপককে অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করা হবে না?”
বাংলাদেশে সংবাদ উপস্থাপকদের গঠনমূলক ও ইতিবাচক ভূমিকার বিপরীতে তাদের পেশাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়ন এখনো অত্যন্ত সীমিত। পশ্চিমা দেশসহ পাশ^বর্তী বিভিন্ন দেশে সংবাদ উপস্থাপকগণ গণমাধ্যমকর্মী এমনকি সাংবাদিক হিসেবেও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং টেলিভিশন কিংবা রেডিও মাধ্যমের অন্যতম প্রাণ হিসেবে বিবেচিত হন। অথচ বাংলাদেশে সংবাদ উপস্থাপকগণ এখনও শুধুমাত্র সংবাদ পাঠকারী হিসেবেই বিবেচ্য হন এবং কর্মক্ষেত্রে তার মূল্যায়নও অধিকাংশ স্থানেই অলংকারিক। সুযোগ সুবিধা বিবেচনায়ও দক্ষতা, কর্মপরিধি ও গুরুত্ব বিবেচনায় অন্যন্য কর্মীদের চেয়ে অনেকক্ষেত্রেই পশ্চাদবর্তী। অথচ সংবাদ উপস্থাপকগণ পূর্ণকালীন কিংবা খণ্ডকালীন যে ধরণের কর্মীই হন না কেন- প্রতিষ্ঠানের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য, পেশাদারিত্ব ও নিয়মানুবর্তিতার সাথে যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ণকালীন কিংবা খণ্ডকালীন বিবেচনায় তার কাজের পরিধিতে যেমন কোনো ছাড় থাকে না, তেমনি অবহেলারও ন্যূনতম সুযোগ থাকে না। সুতরাং প্রতিষ্ঠানের কিংবা সংবাদকক্ষের আধেয় প্রচারের সর্বশেষ মাধ্যম হিসেবে যে গুরুদায়িত্ব একজন সংবাদ উপস্থাপক পালন করে থাকেন, তার মাধ্যমেই তার মূল্যায়ন হওয়া অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মী আইনে গণমাধ্যমকর্মীর সংজ্ঞায় অবশ্যই সংবাদ উপস্থাপকদের অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
সবশেষে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ‘আমাদের দেহের মধ্যে নানাপ্রকার শরীরযন্ত্রে মিলে বিচিত্র কর্মপ্রণালির যোগে শক্তি পাচ্ছে প্রাণ সমগ্রভাবে। আমরা তাদের বহন করে চলেছি কিছু চিন্তা না করে। তাদের কোনো জায়গায় বিকার ঘটলে তবেই তার দুঃখবোধে দেহব্যবস্থা সম্বন্ধে বিশেষ করে চেতনা জেগে ওঠে। আমাদের ভাষাকেও আমরা তেমনি দিনরাত্রি বহন করে নিয়ে চলেছি। আমাদের প্রাণশক্তি যেমন প্রতিনিয়ত বর্ণে গন্ধে রূপে রসে বোধের জাল বিস্তার করে চলেছে, আমাদের ভাষাও তেমনি সৃষ্টি করছে কত ছবি, কত রস- তার ছন্দে, তার শব্দে। কত রকমের তার জাদুশক্তি।
আসুন, শুদ্ধ বাংলার চর্চা করি, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি। ভাষার বিকৃতি রোধে সক্রিয় হই এখনই।
মন্তব্য করুন