• ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
logo

তারাবিহ নামাজ ৮ নাকি ২০ রাকাআত

হফেজ মাওলানা নাসিরুদ্দিন

  ০১ জুন ২০১৭, ১০:২৭

তারাবিহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো বিশ্রাম নেয়া, শান্তি উপভোগ করা। আর তারাবিহ শব্দের পারিভাষিক অর্থ হলো রমজান মাসে এশার নামাজের পর যে সুন্নত নামাজ আদায় করা হয় তাকে বোঝায়।

বিশ রাকাআত তারাবিহ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস :

‘হজরত হাসান (রা.) বলেন, হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) মানুষকে একত্রিত করলেন হজরত উবাই ইবনে কাআব (রা.)’র পেছনে; তখন উবাই ইবনে কাআব (রা.) তাদের ইমামতি করে বিশ রাকাআত নামাজ পড়ালেন।

[আবু দাউদ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা : ৬৫, হাদিস-১৪২৯]

‘হজরত সায়িব ইবনে ইযাযীদ (রা.) বলেন, হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)’র খিলাফতের সময় সবাই রমজানে বিশ রাকাআত (তারাবিহ) নামাজ পড়তেন। সেখানে তারা শ’ শ’ কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করতেন।

হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.)’র ফিলাফতের সময় মানুষ দাঁড়ানোর কষ্টে লাঠিতে ভর দিতেন;(তবু তারাবিহ নামাজ বিশ রাকাআতের কম পড়তেন না)

[সুনানু বাইহাকী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা : ৬৯৯, হাদিস-৪২৮৯]

হজরত উবাই ইবনে কাআব (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) উবাই ইবনে কাযিকে নির্দেশ করে বললেন, রমজানের রাতে(তারাবিহ) নামাজ পড়েন(ইমামতি করেন); অতঃপর বললেন, মানুষ দিনে রোজা রাখে আর কোরআন সুন্দরভাবে পাঠ করতে পারে, আপনি যদি রাতে (তারাবিহ নামাজে) তাদের প্রতি কোরআন পাঠ করতেন(ইমামতি করতেন); এটি এমন বিষয় যা(পূর্বে) ছিল না। অতঃপর উমর (রা.) বললেন, উবাই ইবনে কাআব (রা.) তাদের সঙ্গে(ইমামতি করে তারাবিহ নামাজ) বিশ রাকাআত নামাজ পড়লেন।

[ইত্তিহাদিল খায়রাতিল মাহরাত বিমাওয়ারিদিল আসানীদিল আশারাহ-ইমাম বুসীরী রহ., খণ্ড-২, পৃষ্ঠা : ৩৮৪, হাদিস-১/১৭২৬]

হজরত আব্দুল আযীয ইবনে রুফাই (রহ.) বলেন, হজরত উবাই ইবনে কাআব (রা.) রমজানে মদিনা শরীফে সবার সঙ্গে বিশ রাকাআত(তারাবিহ) নামাজ পড়তেন; আর বিতর পড়তেন তিন রাকাআত।

[মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ (রহ.), খণ্ড-২, পৃষ্ঠা : ১৬৩]

হজরত হারিস (রা.) বলেন, তিনি রমজানে বিশ রাকাআত(তারাবিহ) নামাজে ইমামতি করতেন; আর তিন রাকাআত বিতর নামাজ পড়তেন।

[মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ (রহ.), খণ্ড-২, পৃষ্ঠা : ৭৬৮৫]

তারাবিহ’র ৮ ও তাহাজ্জদ’র ১২ রাকাআতের বিতর্কের সমাধান:

কেউ কেউ ভুলক্রমে ৮ রাকাআত নামাজকে তারাবিহ বলে মনে করেছেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসটি হলো-

‘হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান ও তার বাইরে (সব সময়) ১১ রাকাআতের বেশি পড়েননি।[বুখারী শরীফ]

এ বিষয়ে আরেকটি হাদিস-

‘হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান ও তার বাইরে (সব সময়) ১১ রাকাআতের বেশি পড়েননি। প্রথমে তিনি চার রাকাআত পড়তেন; সে নামাজের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না; পুনরায় তিনি চার রাকাআত পড়তেন, সে নামাজের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে জানতে চেয়ো না; তারপর তিনি তিন রাকাআত(বিতর নামাজ) আদায় করতেন।’

[বুখারী শরীফ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা : ৫৩, হাদিস-১১৪৭]

এ হাদিস দুটি মূলত তাহাজ্জদ নামাজ সম্পর্কে, তারাবিহ নামাজ সম্পর্কে নয়; এ হাদিস দু’টিতে বিতরসহ মোট ১৩ রাকাআত ও ১১ রাকাআত নামাজের বর্ণনা রয়েছে। তার মধ্যে বিতর বাদে ৮, ১০ ও ১২ রাকাআত তাহাজ্জদ নামাজের বর্ণনা পাওয়া যায়, রমজান ও রমজান ব্যতীত বছরের অন্যান্য সময়েও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে নামাজ পড়তেন বলে বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এটা যে তারাবিহ নামাজ নয়, তা বর্ণনার ভাষা থেকেই সুস্পষ্ট বোঝা যায়। কারণ, ৮ রাকাআত যদি তারাবিহ হতো তাহলে রমজান ছাড়াও পড়তেন বলা ঠিক হতো না।

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন,-

এ হাদিসের বিপরীতে খোলাফায়ে রাশেদিনের আমল ও উম্মতে মুসলিমাহর সর্বসম্মত আমল দেখে এ হাদিসকে যারা তারাবিহ নামাজের সম্পর্কে ধারণা করেছেন তারাও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।

[মজমুআহ ফাতাওয়া-ইবনে তাইমিয়াহ, খণ্ড-২৩, পৃষ্ঠা : ১১২]

তারবিহ নামাজ ওয়াজিব না হয়ে সুন্নত হবার প্রেক্ষাপট:

হজরত আয়িশা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার রমজানে মধ্য রাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরা থেকে বের হয়ে মসজিদে গেলেন এবং তারাবিহ নামাজ পড়লেন(কিছু সাহাবী ও তার সঙ্গে শামিল হলেন)। দিনের বেলায় সাহাবীদের মাঝে পরস্পর এ বিষয়ে আলোচনা হলো। দ্বিতীয় রাতেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরা থেকে বের হয়ে মসজিদে গেলেন এবং তারাবিহ নামাজ পড়লেন বহু সাহাবী তার সঙ্গে তারাবিহ নামাজের জামাআতে শরীক হলেন।

পরদিন এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও প্রচার হয়। তৃতীয় রাতেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম জামাআতের সঙ্গে তারাবিহ নামাজ আদায় করলেন; এ রাতে লোক সংখ্যা অনেক বেশি হয়। দিনের বেলায় বিষয়টি সবার মাঝে জানাজানি হয়ে যায়। অতঃপর যখন চতুর্থ রাত এলো, মুসল্লী সাহাবীদের সমাগমে মসজিদ কানায় কানায় ভরে গেলো; কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরা থেকে বের হলেন না। ফজরের নামাজ শেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাষণ দিলেন এবং বললেন তোমরা সবাই যে গেলো রাতে তারাবিহ নামাজ আমার সঙ্গে জামাআতে পড়ার জন্য মসজিদে এসেছিলে তা আমি জানতাম। তবে আমার ভয় হচ্ছিল যে যদি এভাবে পড়ার কারণে তা তোমাদের ওপর ফরজ করে দেয়া হয়। তখন তোমরা তা আদায় করতে পারবে না। কষ্ট হবে।

[বুখারী শরীফ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৬৯ ও মুসলিম শরীফ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৫৯]

তারাবিহ’র বিধান:

ইমাম আযম আবু হানিফা, শাফেয়ী ও আহমদ (রহ.) বলেন, তারাবিহ’র নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। একবার ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) কে মূল তারাবিহ’র এবং হজরত উমর (রা.) যে হজরত উবাই ইবনে কাআব (রা.) এর পেছনে সবাইকে জামাআতবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেছিলেন, এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তরে ইমাম সাহেব বললেন, তারাবিহ’র নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। হজরত উমর (রা.) যা করেছেন তা তার মনগড়া নয় বা নিজে একাকী করেননি; বরং বহু সংখ্যক সাহাবীদেরকে নিয়ে তাদের উপস্থিতিতেই করেছিলেন। এ হিসেবে একে ‘ইজমায়ে উম্মত’ ও বলা যায়।

বিশ রাকাআত তারাবিহ সম্পর্কে ফকীহদের মতামত:

ইমাম মোল্ল্যা আলী কারী (রহ.) বলেন, তারাবিহ নামাজ বিশ রাকাআত। এ বিষয়ে সবাই সাহাবীরা ইজমা(ঐকমত) হয়েছেন।

[মিরকাত-শরহে মিশকাত, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১৯৪]

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, নিশ্চয় উবাই ইবনে কাআব (রা.) রমজানে রাত জাগরণে বিশ রাকাআত(তারাবিহ) নামাজে মানুষের ইমামতি করতেন। তাই বহু উলামায়ে কিরাম মনে করেন, এটাই সুন্নত; কেননা আনসার ও মুহাজিরদের(সব সাহাবী) মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, আর কেউ(কোনো সাহাবী) অস্বীকার করেননি।

আমার বুঝে আসে না কিভাবে তারা বিশ রাকাআত তারাবিহ নামাজকে অস্বীকার করে, অথচ হজরত উমর (রা.) এর জামানায় কত সাহাবা ছিল তারা কোনো ধরনের মতানৈক্য করলেন না। আর আমরা কি তাঁদের(সাহাবাদের) থেকে বড় আলেম বা জ্ঞানী হয়ে গেছি? যদি নিজেকে নিজে বড় আলেম বড় জ্ঞানী মনে করি তাহলে এটা মূর্খতা ছাড়া আরি কি হবে?

আমি আমার এই আলোচনায় মাত্র কিছু হাদিস উল্লেখ করেছি। তার মানে এ সম্পর্কে সামান্য ক’টি হাদিসই আছে আর হাদিস নাই। এমনটি নয়। বরং আরো হাদিস আছে তা উল্লেখ করলাম না। কারণ, যেগুলো উল্লেখ করেছি তাই যথেষ্ট।

আসুন আমরা সবাই পবিত্র মাহে রমজানে বেশি বেশি আমল করি। নিজের জন্য দোয়া করি। কবরবাসীর জন্য দোয়া করি। সারা দেশসহ গোটা মুসলিম জাতির জন্য দোয়া করি।

আল্লাহতাআলা আমাদেরকে কবুল করুন।(আমিন)

কে/এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh