• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

ঋণে আস্থার সংকট, বিদেশি ছবি জরুরি বলছেন সংশ্লিষ্টরা

আহমেদ তেপান্তর

  ০৪ জুলাই ২০২১, ১৫:৫৮

সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় মাধ্যম বলে পরিচিত সিনেমা শিল্প ভালোমানের ছবির অভাবে দর্শকশূণ্যতায়। গত এক দশকে ১৩শ’ সিনেমা হল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে, এরমধ্যে ১৩৫টি হল অস্থিত্ব নিয়ে টিকে আছে কেবল পারিবারিক ঐতিহ্যের বদান্যতায়। সর্বশেষ অন্তত ২০টি হল স্থায়ীভাবে বন্ধ হবার আশংকা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে পুরোপুরি প্রস্তুত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অন্তত ১০টি মাল্টিপ্লেক্স মানসম্মত ছবির অভাবে চালু হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ঋণ তহবিলে দেখা দিয়েছে পারস্পারিক আস্থার সংকট। সবদিক বিবেচনায় দ্রুত সহজ শর্তে ঋণ তহবিলের ছাড়, অন্তত ১২টি বিদেশি বাণিজ্যিক ক্যাটাগরির ছবি আমদানি এবং যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা সহজকরণের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, সিনেমা হলের সংকট কাটাতে গত বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক হাজার কোটি টাকা স্বল্পসুদে ঋণের বন্দোবস্ত করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। বিষয়টি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের নেতৃত্বে তোরজোড়ও শুরু হয়। তিনি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে প্রদর্শক সমিতির সঙ্গে একাধিক বৈঠকও করেন। এর পাশাপাশি তথ্যমন্ত্রী সিনেমা আমদানির ব্যাপারে প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পী সমিতির সঙ্গে বসে যৌথ উদ্যোগের ওপর তাগিদ দেন। এ অবস্থায় প্রদর্শক সমিতি প্রযোজক ও পরিচালকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে সিনেমা আমদানির বিষয় নীতিগতভাবে একমত হন। তবে গত ছয় মাসেও আমদানি নীতির সুফল পায়নি হল মালিকরা।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ঋণ এবং আমদানি ছবির ব্যাপারে হল মালিকদের হতাশা নিয়ে সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, সব সময় বলে আসছি কেবল টাকা দিয়ে হল নতুন করে বানালেও হবে না। বাড়ি বানাবেন তখন এটা ভাড়ার বন্দোবস্তও করতে হবে নইলে সে বাড়ির মূল্য নেই। অর্থ্যাৎ ভালোমানের কিছু বাণিজ্যিক ছবিও আমদানি করতে হবে, নইলে হল চলবে কিভাবে? মাসের পর মাস ভর্তুকি দিয়ে হল চালাতে হচ্ছে। এই করোনাকালেও বিদ্যুৎ বিল মওকুফ নেই। এখন দুটো চ্যালেঞ্জ এক সঙ্গে দেখা দিয়েছে প্রথমত- দর্শক ধরে রাখা, দ্বিতীয়ত- হল বাঁচানো। এ অবস্থায় ঋণ ছাড়ে উদার না হলে হল মালিকরা আগ্রহী হচ্ছে না পাশাপাশি ভালো মানের ছবি ছাড়াও হলে দর্শক আনা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় জরুরিভিত্তিতে ভারতীয় ছবি দর্শক এবং হল বাঁচানোর উপায় হতে পারে।

তিনি বলেন, আমরা সবসময়ই কৃতজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর আন্তরিকতায়। তাদের আশ্বাসে অনেক বন্ধ সিনেমা হল মালিকরাও নতুন করে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু দুঃখজনক হল- ঘোষিত ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলো এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তাই সরকারকে অনুরোধ করব ব্যাংক এবং সিনেমা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে ডেকে তাদের কষ্টের কথাগুলো শুনতে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সিনেমা শিল্পে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার (অধুনালুপ্ত লায়ন সিনেমা হল) মির্জা আব্দুল খালেক এবং বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সের কর্ণধার রোকুনজ্জামান ইউনূস রুবেলের সঙ্গে। তারা বলেন, বহু টাকা খরচ করে প্রায় দুই বছর হলো অত্যাধুনিক মাল্টিপ্লেক্স করেছি, দেশি মানসম্পন্ন এবং বিদেশি উচ্চ মানসম্পন্ন ছবি প্রদর্শনের জন্য। আশাবাদী ছিলাম মাঝে ভারতীয় কিছু সংখ্যক ছবি আসছে শুনে কিন্তু অগ্রগতি দেখছি না; এভাবে সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স বাঁচবে না। অলিগলির পথ ধরে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের ধ্বংস করে দেবে। নিশ্চয়ই আমরা সেটা চাই না। তাই সুষ্ঠু নীতিমালার মধ্য দিয়ে বিদেশি ছবি উন্মুক্ত করে প্রতিযোগিতায় আসতে হবে। পাশাপাশি ঋণের তহবিলে ব্যাপারে জুড়ে দেওয়া শর্তগুলো আরও সহনীয় করা ছাড়া কেউ ঋণ নিতে আগ্রহী হবে না বলেও তারা মন্তব্য করেন।

তাদের এমন মন্তেব্যে একমত পোষণ করে মুন্সীগঞ্জের ‘পান্না’ হলের কর্ণধার আজগর জানিয়েছেন, যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা সহজ থাকলেও কিছু বাংলাদেশ-ভারত ছবি হতো এখন কঠিন নিয়মের বেড়াজালে সেটাও প্রায় বন্ধ। ভাবছি হল ভেঙে মার্কেট তৈরি করব।

‘যারা মেধাবী তারাই টিকবে’

নির্মাতা অপূর্ব রানা (কবিরুল রানা), মুস্তাফিজুর রহমান মানিক, শাহ আলম মন্ডল, শফিক হাসান, শামীমুল ইসলাম শামীম। তারা বলছেন- সময় হয়েছে বিশ্বায়নকে স্বীকার করে চলচ্চিত্র এগিয়ে নেওয়ার। দর্শক চাইলেই যে কোনো প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বিদেশি ভালোমানের ছবি দেখতে পারছে, তাকে কিন্তু আমি ঠেকাতে পারছি না। তাই ভারতীয় কেন সবদেশি ছবি আমদানি হোক। আমাদের ছবিগুলো বাইরে যাক। বিদেশি ছবি আসলে আমাদের মধ্যেও এক ধরনের প্রতিযোগিতা মানসিকতা গড়ে উঠবে। এদের মধ্যে যারা মেধাবী তারাই টিকবে। এতে করে আমাদের ভীত আরও মজবুত হবে বলে মনে করি। বিদেশি সিনেমা আমদানি প্রশ্নে তরুণ প্রজন্মের ভাবনাকে সাহসী এবং ইতিবাচক উল্লখ করেছেন তারকা পরিচালক এফ আই মানিক।

কী বলছেন প্রবীন পরিচালক আজিজুর রহমান

ঢাকাই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে প্রবীন এবং ব্যবসাসফল ছবির পরিচালক হিসেবে পরিচিত আজিজুর রহমান (জনতা এক্সপ্রেস, ছুটির ঘণ্টা) বিরক্তি নিয়ে বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই সিনেমা আদান-প্রদান হচ্ছে। ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে আমদানি হচ্ছে। বাংলাদেশেই কেবল ব্যতিক্রম। এরমধ্যে শুনতে পাচ্ছি ন্যূনতম বাজেটে যাচ্ছেতাই ছবি নির্মিত হচ্ছে, প্রশ্ন হচ্ছে হলে গিয়ে কী দর্শক এই ছবি দেখবে? তাই সরকারের হল বাঁচানোর যে প্রচেষ্টা সেটার পাশাপাশি বিদেশি ছবি আমদানি এবং যৌথ প্রযোজনার ছবির ব্যাপারে উদারনীতির বিকল্প দেখছি না।

সিনেমা আমদানিতে পরিচালক সমিতি ইতিবাচক

পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান বলেন- মৌখিকভাবে ছবি আমদানির ব্যাপারে আমাদের আগের কমিটির ইতিবাচক ছিল। একইভাবে আমরাও চাই এই মুহুর্তে সিনেমা হল বাঁচাতে কিছু ভালো মানের বিদেশি ছবি আসুক। এজন্য আমরা প্রধান চারটি সংগঠনের সঙ্গে আবারও বসব; আশা করছি শিগগিরই যৌথভাবে ইতিবাচক একটা সংবাদ সবাইকে জানাতে পারব।

দুই শিল্পীর পরস্পরবিরোধী কথা

‘বিদেশি ছবি আসলে সবশেষ এ কথা যারা বলেন তারা দুর্বল। আত্মবিশ্বাসের অভাবেই তারা বিদেশি সিনেমার বিরোধিতা করছেন। আমি বলি সিমো হল বাঁচাতে এ মুহুর্তে বিদেশি ছবি অক্সিজেনের মতো কাজ করবে। পাশাপাশি আমাদের এ প্রজন্মের মেধাকে শানিত করবে’- এমন মন্তব্য চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ডের সদস্য শক্তিমান অভিনেত্রী অরুনা বিশ্বাসের। অপরদিকে শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর বলেন- তিনি শিল্পী। তার কাজ অভিনয় করা। কোন ছবি আসবে, কোন ছবি যাবে এ ভাবনা তার নয়। তারপরও যদি সকল সমিতি শিল্পী সমিতিকে ডাকে তাহলে অবশ্যই যাবে, সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্পী সমিতির অবস্থান ব্যাখ্যা করব।

‘ভালো ছবির অভাবে দর্শকরুচি নষ্ট হচ্ছে’

‘বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব চলচ্চিত্র স্বীকার না করে আমরা পলায়নপর নীতি গ্রহণ করে বসে আছি। এটা হাস্যকর। আমাদের ভালো টেকনিশিয়ানসের অভাব, শিল্পী নেই বললেই চলে। তাহলে কার ছবি দেখতে আমি টিকিট কেটে হলে ঢুকবো? এ অবস্থা উত্তরণে সিনেমা আমদানি করে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করা যায়। এতে সরকার বরং রাজস্ব পাবে, কর্মস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত বা পাকিস্তান কিন্তু সে পথে অনেক আগেই। কেন আমরা সে পথে যাই না বার কার স্বার্থ রক্ষায় সময় নষ্ট করছি তা বোধগম্য নয়। এতে করে দর্শকরুচি নষ্ট হচ্ছে, এটা কী আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ভেবে দেখেছেন?’- এমন মন্তব্য করেছেন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় চেয়ারম্যান তামান্না হক নিপা এবং ইংরেজি দৈনিক অবজারভারের কলামিস্ট ইমরান রহমানের।

ঋণের কঠিন শর্তে পিছিয়ে গেছেন অভিনেতা আলমগীর

বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি বরেণ্য অভিনেতা আলমগীর সিনেপ্লেক্স তৈরির ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ঋণ তহবিলের কঠিনশর্তের কারণে পিছিয়ে গেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ এক জানিয়েছেন।

ঋণ তহবিল নিয়ে কী বলছে ব্যাংক

‘আস্থাহীনতা’ প্রশ্নে তফসিলি ব্যাংকের বরাত দিয়ে প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস জানিয়েছেন “মালিকরা ঋণ নিতে গেলে তাদের প্রথম বক্তব্য ‘আপনাদের হল কী আগের মতো চলে। ঋণ শোধ করবেন কিভাবে?’” সত্যি বলতে ব্যাংকের এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারতাম যদি ভারতীয় ছবিগুলো সরকার ছাড় দিত। হল চললে ব্যাংকও আস্থাশীল হতো।

প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, ‘সরকার সবসময় সিনেমার প্রতি ইতিবাচক আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। আশা করছি ঋণ তহবিল ঘিরে প্রশ্ন এবং বিদেশি ছবি আমদানি দুটো বিষয় সমান গুরুত্ব দিয়ে তারা দেখবে। আমরা আর বাঁচতে পারছি না, এ সত্যটা মেনে দ্রুত কিছু করুন।’

ঋণ তহবিল এবং ছবি আমদানি এ নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন- সময় ফুরিয়ে যায়নি সিনেমা সংশ্লিষ্টগণ যৌথ মিটিং করে একটা কংক্রিট সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে বৈঠক করলে তিনি এ ব্যাপারে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন।

এম

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh