• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
logo

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি

কোটালীপাড়ার তারাকান্দর বধ্যভূমিতে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক

প্রশান্ত অধিকারী

  ০২ জুন ২০২১, ০৭:৪২
কোটালীপাড়ার তারাকান্দর বধ্যভূমিতে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক
কোটালীপাড়ার তারাকান্দর বধ্যভূমি, ছবি : সংগৃহীত

গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম তারাকান্দর। গ্রামতো নয়, কোটালীপাড়ার বৃহত্তর বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে কোটালীপাড়ার একাধিক গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ হলেও এ গ্রামের মতো এতো মানুষের আত্মাহুতি দিতে হয়নি কোথাও। এখানে পাক-হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে শতাধিক যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর (সুবর্ণজয়ন্তী) পার হতে চললেও এ গ্রামে শহীদদের স্মরণে এখনও নির্মিত হয়নি কোনও স্মৃতিফলক কিংবা স্মৃতিস্তম্ভ।

১৯৭১ সালের মে মাস। বাংলা ১৯ জ্যৈষ্ঠ, মঙ্গলবার। দেশজুড়ে চলছে যুদ্ধের দামামা। কান্দি ইউনিয়নের মানুষও বসে নেই। তাই পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেয় যুদ্ধের। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা তারাকান্দর বালা বাড়ি প্রতিরোধ শিবির গড়ে তোলে। স্থানীয় লোকের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থান থেকে আশ্রয় নিতে আশা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ওই বাড়িতে তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নেয়। এ খবর যায় পার্শ্ববর্তী গোপালপুর-পূর্ণবতী-কুরপালা-কাকডাঙা গ্রামের রাজাকার আলবদরদের কাছে। তারা জানে যে শুধু তারা এসে এ প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে পারবে না। তাই পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তিনদিন বসে পরিকল্পনা করে তারাকান্দর আক্রমণের।

১৯ জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার সকালবেলা কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গানবোটে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১ জন পাকসেনা গোপালপুর গ্রামে আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল পাকিদের স্থানীয় দোসর রাজাকার আহমদ চেয়ারম্যান, আফতাব উদ্দিন [আপ্তু মিয়া], বারেক মাস্টার, সোবহানসহ আরো অনেকে। তাদের ইশারায় পাক বাহিনী প্রস্তুতি নেয় তারাকান্দার আক্রমণের। এক পর্যায়ে ভারী মেশিনগানের গুলি ও মর্টার শেল ছুঁড়তে থাকে তারাকান্দরের দিকে। মাত্র এক কিলোমিটার ব্যবধানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সহস্রজনতা ভারী অস্ত্রশস্ত্রের গুলি ও শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে আর টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। প্রাণভয়ে অস্ত্রশস্ত্র রেখে পেছন দিকে যে যেভাবে পারে পালাতে থাকে।

এই সুযোগে স্থানীয় রাজাকার, আলবদররা পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে তারাকান্দর গ্রামে। সহস্রাধিক মানুষ যে যেভাবে পারে আশ্রয় নেয় ডোবায়, ঝোঁপঝাড়ে, পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে। সেখানে পালিয়েও বাঁচতে পারেনি তারা। পাক বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তাদেরকে নির্মমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পাকিদের দোসররা। প্রতিরোধকারী যোদ্ধাদের ফেলে আসা রাম দা, কুড়া, কালি দিয়ে শতাধিক আবালবৃদ্ধবণিতাকে হত্যা করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। সকাল ১১টায় শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারকীয় হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন শতাধিক নারীপুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। কেউ কেউ মনে করেন সে সংখ্যাটা দুইশোর অধিক হবে। পাক-হানাদারদের সেই নির্মম নৃশংসতার নীরব স্বাক্ষী পুরো তারাকান্দর গ্রাম, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ।

সেই ঘটনার স্বাক্ষী ও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ বৈদ্য দীর্ঘদিন রোগভোগের পর তিন বছর আগে মারা গেছেন। সেই যুদ্ধের একজন অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন জগদীশ বৈদ্য। তখন ছিলেন ৩০ বছরের টগবগে তরুণ। শত্রুর ভারী অস্ত্রের আঘাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন একটা কচুরিপানাভর্তি ডোবার মধ্যে। তার এক হাতে রাম দা অন্য হাতে কালি। মনে মনে প্রতিজ্ঞায় অবিচল। মরার আগে একটা শত্রু হলেও খতম করবেন। কিন্তু তা পারেননি। তার আগেই শত্রুরা তাকে দেখে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। কিন্তু গুলি যায় মাথার উপর দিয়ে। একইসঙ্গে কালি দিয়ে উপুর্যপুরী কুপিয়ে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তারা চলে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কালির ৩৪টি কোপ খেয়েও বেঁচে যাছন জগদীশ বৈদ্য। ভয়াল সেই দিনের কথা কাউকে জানাতে চাননি কখনো। কারণ পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পাশ্ববর্তী এলাকার রাজাকার, আলবদররা তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে শুরু করে। জীবনের নিরাপত্তার জন্য পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে যশোরের বসুন্দিয়া আশ্রয় নেন। দীর্ঘদিন মানবেতর জীবনযাপন করার পর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। স্ত্রী ও ছয় মেয়ে নিয়ে তার সংসার ছিল। চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুই মেয়ে স্থানীয় চাল-ডালের মিলে কাজ করেন। এই মেয়েদের ওপর নির্ভর করেই শেষ জীবনে রোগে শোকে নানা কষ্টে বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর আগের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তা পাননি। মুক্তিযোদ্ধার সম্মান ও স্বীকৃতি না পেয়েই তিনি পরপাড়ে পাড়ি দিয়েছেন।

তারাকান্দর গ্রামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সত্তোরোর্ধ্ব নটোবর রায় তাদের বাড়ির সামনের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে পাকিস্তানি আর্মি রাজকাকারদের তাড়া খেয়ে একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল ৯ জন। তাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। তাদের মধ্যে ডহরপাড়া গ্রামের নরেন দাঁড়িয়া [সমদ্দার], তার স্ত্রী, মা এবং চিন্তা দাঁডিয়া ও তার ছেলে ছিল। এছাড়া ছিল দরশন রায়, তার স্ত্রী ও মেয়ে এবং মনোমোহন রায়ের ছেলে হরলাল রায়।’

সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনো মনে পড়লে যেন আঁৎকে ওঠেন তিনি। তারাকান্দর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাকান্দর খালের পশ্চিম পাড়ে বিষ্ণু রায়ের স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়। এভাবে তারাকান্দর বৈদ্য বাড়ি, রায় বাড়ি, বিশ্বাস বাড়ির দক্ষিণ পাশে মাঠে ও পুকুর পাড়ে সারি সারি লাশ দেখা যায়। যে সব শহীদদের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয় তাদের মধ্যে রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এব তার দুই মেয়ে, পঁচু মণ্ডলের স্ত্রী, কুটিশ্বর মণ্ডল, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রী। এছাড়াও নাম না জানা এলাকা ও এলাকার বাইরের বহু লোককে সেদিন এই তারাকান্দর বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি নারী নির্যাতন, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। এভাবে নারকীয় হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করতে করতে পশ্চিম তারাকান্দর থেকে পূর্ব তারাকান্দর হয়ে নলভিটা পর্যন্ত যায় পাকবাহিনী।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর। জগদীশ বৈদ্যর মতো সেই দিনের সেইসব শহীদদের কথা কেউ মনে রাখেনি। এই দিনে তাদের স্মরণ করা তো দূরের কথা তারাকান্দর এই গণহত্যার কথা মানুষ জানেও না। এমনকি তাদের নাম ঠাঁই পায়নি ইতিহাসেও। গোপালগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বই প্রকাশিত হলেও সেখানে তারকান্দর গণহত্যার ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি শহীদদের তালিকা প্রণয়ন ও তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ করার ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়নি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় মানুষের দাবি এসব শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে শহীদদের তালিকা খুঁজে বের করে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।

এলাকাবাসীর সঙ্গে একই সুরে সুর মিলিয়ে সেই ভয়াল ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী, কান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা অনিলচন্দ্র রায় বলেন, সেদিনের ভয়াবহ দৃশ্য ভোলার নয়। এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা। আমাদের দাবি এখানে শহীদদের ত্যাগের সম্মান ও স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক।

একাত্তরের শিশু ও কান্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মনীন্দ্রনাথ রায় মনি বলেন, আমি তখন ছোট ছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে এসে যে বীভৎসতা চোখে দেখেছি তা অবর্ণনীয়। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানাই।

বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। সেই সরকারের প্রধান ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই এলাকার সংসদ সদস্য। অথচ আজ পর্যন্ত কোটালীপাড়ার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণে কারও তেমন কোন ভূমিকা চোখে পড়েনি। তাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, ‘বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প’র মাধ্যমে তারাকান্দর বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক।

এই এলাকার মানুষ কোন কিছু হলে তাকিয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আপনার প্রিয় কান্দি ইউনিয়নবাসীর সামান্য দাবি, ১৯৭১ সালে তারাকান্দরের শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করুন।

লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
proadhikary@yahoo.com

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
রাজধানীতে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
বাংলাদেশিদের মসজিদ নির্মাণে মালয়েশিয়ানের ৭ কোটি টাকার অনুদান
কাজে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আইডিয়ালে আলোচনা সভা
X
Fresh