• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

কালের সাক্ষী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

মিথুন চৌধুরী

  ০৩ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৪৩

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যাতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। যাকে আগে বলা হতো রেসকোর্স ময়দান। এছাড়া রমনা জিমখানা হিসাবে ডাকা হতো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামানুসারে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে 'সোহরাওয়ার্দী উদ্যান' রাখা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদের এক বিবরণ থেকে জানা যায়, চার্লস ডজ রমনায় রেসকোর্স বা ঘোড়দৌড়ের মাঠ নির্মাণ করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার খ্যাতনামা আলেম মুফতি দীন মহম্মদ এক মাহফিল থেকে ঘৌড়দৌড়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এ কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৪৯ সালে ঘৌড়দৌড় বন্ধ করে দেয়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণে রয়েছে পুরানো হাইকোর্ট ভবন, তিন জাতীয় নেতা শেরে-বাংলা এ. কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী-এর সমাধি (তিন নেতার মাজার); পশ্চিমে বাংলা একাডেমী, আনবিক শক্তি কমিশন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, চারুকলা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ, পাবলিক লাইব্রেরি এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর; উত্তরে বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা ক্লাব ও ঢাকার টেনিস কমপ্লেক্স এবং পূর্বে সুপ্রীম কোর্ট ভবন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও রমনা পার্ক।

১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবাদার ইসলাম খান ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠা করলে রমনার ইতিহাস শুরু হয়। তবে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর রমনা ধীরে ধীরে তার পুরোনো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ১৮২৫ সালে ব্রিটিশ কালেক্টর ডয়েস এখানকার জঙ্গল পরিষ্কার করে রমনাকে পরিচ্ছন্ন রূপ দিয়ে নাম দেন রমনা গ্রিন। ওই সময়ে রেসকোর্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের বেড়া দিয়ে তিনি জায়গাটি ঘিরে দেন। এরপর নবাবদের আনুকূল্যে সেখানে ঘৌড়দৌড় খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নবাবেরা আরো সুন্দর বাগান করে নাম দেন ‘শাহবাগ’ বা রাজকীয় বাগান।

১৮৫১ সালে রেসকোর্সের উত্তর কোণে ব্রিটিশ আমলারা ঢাকা ক্লাব স্থাপন করেন। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের শাসনামলে গভর্নরের সরকারি বাসভবন স্থাপনের জন্য রমনাকে নির্বাচন করা হয়। বৃহত্তর রমনা এলাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এখানকার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে রমনা রেসকোর্স ময়দানে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রমনা রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশের আয়োজন করে। একইবছর ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। যা থেকে শুরু হয় দেশ স্বাধীন করার আন্দোলন। ঠিক একই স্থানে ১৬ ডিসেম্বর এখানেই হানাদার পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ এখানে আরেক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য দেন।

শিখা চিরন্তন রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত একটি স্মরণ স্থাপনা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান এই স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের এই স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৬ সালে শিখা চিরন্তন স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উপলক্ষে ১৯৯৭ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিখা চিরন্তন প্রজ্বলন এবং দেশব্যাপী শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন।

মাটির নিচে স্বাধীনতা জাদুঘর। শিখা অনির্বাণ থেকে সোজা হেঁটে স্বাধীনতা স্তম্ভটির দিকে এগিয়ে গেলেই হাতের বামে জাদুঘরের প্রবেশ পথ। প্রবেশ পথের সামনে রয়েছে স্তম্ভ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ জনতার দেয়াল নামে ২৭৩ ফুট দীর্ঘ একটি দেয়ালচিত্র। এটি ইতিহাসভিত্তিক টেরাকোটার পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যুরাল। সিঁড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে একটু ঘুরে নিচে নামলেই চোখে পড়ে বিশাল একটি গ্যালারি। গ্যালারিতে ছোট ছোট কাচের দেয়ালে সেঁটে দেওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের নানা ধাপের বিভিন্ন চিত্র।

এখানে মোট ১৪৪টি কাচের দেওয়ালে হাজারেরও বেশি ছবি প্রদর্শন করা আছে। প্রথমেই চোখে পড়ে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তনের চিত্র। গ্রীষ্মকালে এই জাদুঘর সকাল ১০.৩০টা থেকে বিকাল ৫.৩০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর শীতকালে ৯.৩০ থেকে ৪.৩০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বৃহস্পতিবার এবং সরকারী ছুটির দিন বন্ধ। এছাড়া শুক্রবারে দুপুর ২.৩০ থেকে সন্ধ্যা ৭.৩০টা পর্যন্ত খোলা থাকে স্বাধীনতা জাদুঘর। বাংলাদেশ ও সার্কভুক্ত নাগরিকরা ২০ টাকা, শিশুদের জন্য ২ টাকা ও বিদেশি পর্যটকদের ১শ' টাকা দিয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করতে হয়। তবে প্রতিবন্ধীদের প্রবেশ মূল্য দিতে হবে না।

স্বাধীনতা স্তম্ভ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভটি।এটি মূলত একটি গ্লাস টাওয়ার। টাওয়ারটির কাঠামো ইস্পাত দিয়ে তৈরি। এর উপরিভাগে রয়েছে স্বচ্ছ কাচ। এতে সূর্যের আলোর প্রতিসরণ ও প্রতিফলন হয়। রাতে বৈদ্যুতিক আলোর মাধ্যমে স্তম্ভটি আলোকিত করা হয়। টাওয়ারটি উচ্চতায় ১৫০ ফুট ও প্রস্থ ১৬ ফুট। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তার প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন। এখানেই ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতা করেছিলেন।

এসব নানা ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যেই সরকার 'স্বাধীনতা সংশ্রয়' নির্মাণের পরিকল্পনা করে। স্বাধীনতা স্তম্ভ এই সংশ্রয়েরই অন্যতম আঙ্গিক।স্বাধীনতা স্তম্ভের নকশা করেছেন আরবানা নামীয় স্থাপত্য সংস্থার দুই স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম। স্তম্ভের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে এবং ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে এটি সম্পূর্ণ হয়।

মুক্তমঞ্চ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। যেখানে অনুষ্ঠিত হয় শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা। ১৯৯৮ সালে কাজ শুরুর প্রায় ১৩ বছর পর ২০১১ সালের ৭ মার্চ এটি খুলে দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধ স্তম্ভ। যাতে ঢাকা জেলায় নিহত শহীদদের স্মরণে স্তম্ভটি তৈরি করা হয়। যাতে খোদায় করে লেখা রয়েছে বীর শহীদদের নাম।

রমনা কালী মন্দির। এটি ছিল দশনামী গোত্রের হিন্দুদের কালী মন্দির। জানা যায়, নেপাল থেকে আগত দেবী কালীর একজন ভক্ত এই মন্দির নির্মাণ করেন। ঢাকা শহরের অন্যতম পুরানো এবং বনেদি এই কালী মন্দিরটি পরে ভাওয়ালের রানী বিলাসমণি দেবী সংস্কার ও উন্নয়ন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা কালী মন্দির সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। পরে তা ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনতার পর পুন:নির্মাণ করা হয়।

এমসি/আরকে/এসজে

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh