করোনায় দৈনন্দিন জীবন ও খাদ্যাভ্যাস
নোভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার প্রথম এবং প্রধান উপায় হচ্ছে ব্যক্তিগত সচেতনতা গড়ে তোলা। করোনা মোকাবেলায় সবচেয়ে জরুরী ভূমিকা রাখে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি, তিনি তত বেশি লড়তে পারবেন এই করোনার বিরুদ্ধে। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সচল করতে নিয়মিত প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবারগুলোর পাশাপাশি উদ্বেগ কমিয়ে নিয়ম করে অন্তত পক্ষে ৪০ মিনিট পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যায়াম ও ঘুম ঠিক রাখতে হবে। এতে শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
করোনা প্রতিরোধে খেতে হবে এমন কিছু খাবার যা ভাইরাসের কোষগুলোকে ধ্বংস করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে তরান্বিত করবে।
১) আমিষ জাতীয় খাবার-
খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন উচ্চ মানের আমিষ জাতীয় খাবার রাখুন। যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ।
২) শাকসবজি-
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখুন রঙিন শাক ও সবজি।যেমন- পুঁইশাক, লাল শাক, গাজর, বীট, টমেটো, ক্যাপসিকাম, সজনেপাতা। ব্রকলিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ও সি রয়েছে,পাশাপাশি রয়েছে পটাশিয়াম ও ফলিক এসিড।
৩) ফলমূল-
মৌসুমী ফল অবশ্যই খাবেন।যেমন-আম, জাম, পেঁপে, আনারস, আনার, আঙ্গুর। টক জাতীয় ফলগুলোতে ভিটামিন সি এর প্রাচুর্য বেশি থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অনেকাংশেই বাড়িয়ে তোলে।লেবু, আমড়া, কমলালেবু, জাম্বুরা, চেরী, স্ট্রবেরী, মালটা, আমলকী এ খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে। তাই নিয়ম করে আপনার খাবারের তালিকায় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার রাখুন।
- পাশাপাশি অন্যান্য ভিটামিন যেমন- পালংশাক, মিষ্টিকুমড়া, জাম্বুরা, গাজর ভিটামিন এ দ্বারা সমৃদ্ধ।
- কাঠবাদাম, চিনাবাদাম , পেস্তাবাদাম, জলপাই সব বীচি জাতীয় খাবারগুলো ভিটামিন ই সমৃদ্ধ।
- ভিটামিন B-12 এ সময় শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। উদ্ভিজ্জ খাদ্যে এর উৎস নেই বললেই চলে।এটি মাছ, ডিম,দুধ, কলিজা ও লাল মাংসে পাওয়া যায়।
- জিংক জাতীয় খাবার এ সময় শরীরে বিশেষভাবে প্রয়োজন। জিংক আমরা পেতে পারি সামুদ্রিক মাছ,বাদাম, ছোলা, মটরশুঁটি থেকে।
৪) দুগ্ধজাত খাবার-
এগুলো প্রবায়োটিক হিসেবে পরিচিত। যেমন- দই, ঘোল, ছানা,মাঠা ইত্যাদি।আপনাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এ জাতীয় খাবার গুলো রাখুন।রাতে শোবার কিছু আগে টক দই(১/২কাপ) ১ চামচ কালিজিরার সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।এতে আপনার পেটের চর্বি বা মেদ অনেকাংশেই কমে যাবে।
৫) গ্রিন টি-
প্রতিদিন নাস্তার পর ও বিকেলে নিয়ম করে গ্রিন টি খান। পাশাপাশি চিনি ছাড়া অল্প মধু মিশিয়ে লেবু বা আদা চা দিনে ৩-৪ বার খেতে পারেন।
৬) কাঁচা রসুন-
এটি খুবই উপকারী। এটি রোগ প্রতিরোধ বাড়ায়। খালি খেতে না পারলে গরম পানিতে রসুন দিয়ে খেতে পারেন।তবে রান্না করা রসুনে কাঁচা রসুনের গুন মেলে না।আমাদের দেশীয় রসুন হার্টের জন্যও খুব উপকারী।
৭) এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার-
শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে বুস্টআপ করতে এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে প্রতিদিন। যা শরীরের ফ্রি রেডিকেলস্ এর সাথে লড়াই করে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। যেমন- বিভিন্ন ধরনের বাদাম, কাঠ বাদাম, চিনাবাদাম, পেস্তা বাদাম।সেই সাথে লাল চাল,লেবু, আজার রস,পালং শাক, করলা ইত্যাদি।এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভরপুর খাবার বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে ধীর করে তারুণ্যকে বজায় রাখে, হৃদরোগ প্রতিহত করে, পাশাপাশি চোখের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে।
৮)গরম পানি-
পর্যাপ্ত পরিমাণে হাল্কা উষ্ম গরম পানি সারাদিন অল্প অল্প করে পান করুন।পাশাপাশি দিনে ৪-৬ বার নাকে ও মুখে গরম পানির ভাপ নিন।
৯) ভিটামিন ডি-
করোনা প্রতিরোধে ভিটামিন ডি একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।দিনে অন্ততপক্ষে ১৫-২০ মিনিট ( সকাল ১০ টা থেকে বেলা ৩ টা) সূর্যের তাপ নিন।ভিটামিন ডি দেহের অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়ামকে শোষণ করে।এটি আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাসকে দ্রবীভূত করে।সামুদ্রিক মাছ, গরুর কলিজা,মাশরুম, ডিমের কুসুম, কমলার রস,তাজ,গরুর দুধ ও শতাংশ মিল্কেও ভিটামিন ডি থাকে।
কী কী খাবেন না:-
- অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার, চিনি ও রাতে লবণ খাবেন না।
- সফট ড্রিকস্,জাঙ্ক ফুড, প্রসেস ফুড পরিহার করুন।
- অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার, ভাজাপোড়া- মশলাযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
- বাসি খাবার খাবেন না।
- ঠাণ্ডা খাবার থেকে বুকে ঠাণ্ডা জমে যাবার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।তাই ঠাণ্ডা পানি, কোল্ড ড্রিংস্,আইসক্রিম এ জাতীয় খাবার থেকে দুরে থাকুন।
- ধূমপান থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন। ধূমপান ত্যাগ না করলে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
- জর্দা মিশিয়ে পান খাবেন না।
- মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন।
প্রতিটা মানুষেরই উচ্চতা, ওজনও কাজের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে শরীরের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যালোরির প্রয়োজন রয়েছে। বি এম আই হিসাবের মাধ্যমে দৈনিক কতটুকু ক্যালরির প্রয়োজন এবং নির্দিষ্ট কোন খাবার থেকে ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে, সুনির্দিষ্ট একটি চার্টের মাধ্যমে তা মেনে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরে অন্যান্য রোগের বাসা বাধার ঝুঁকি প্রীত ৭০% পর্যন্ত কমে যায়।
আর যাদের বিভিন্ন রকম কো মরবিডিটিজ আছে, ঝুঁকিতে আছেন, যেমন-ডায়াবেটিস,হাই প্রেশার, এ্যাজমা, ওবেসিটি, স্ট্রোক, হরমোনাল ইমব্যালেন্স, রেনাল ডিজিজ-তাদের খাদ্যতালিকায় কিছুটা ভিন্নতা থাকবে, প্রোপার মেডিটেশনের পাশাপাশি অনেক খাবারই বেছে খেতে হবে। সেক্ষেত্রে নিয়মমতো অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার,পাশাপাশি ক্লিনিক্যাল ডায়েটেশিয়ানের শরণাপন্ন হয়ে মেডিকেশন,লাইফ স্টাইল এবং ডায়েট চার্ট তৈরির মাধ্যমে প্রতিদিনের জীবনযাপনের নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
ডা: মৌসুমী আফরিন ইভা
কনসালট্যান্ট-পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার (মালিবাগ)
ডায়াবেটলজিষ্ট,ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান
এন্ড ক্লিনিক্যাল ডায়েটেশিয়ান।
জিএ
মন্তব্য করুন