• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে তাইওয়ান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, আরটিভি অনলাইন

  ০৬ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৩৫
Taiwan's coronavirus response is among the best globally
সিএনএন থেকে নেয়া

চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে যখন নভেল করোনাভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল ২৫ জানুয়ারি বিশ্বের অনেক দেশই এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারেনি। চীনের মূল ভূখণ্ডের দুটি সরকার তাদের সীমানায় চারজন করোনা রোগী শনাক্ত করে।

অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ান। তাদের জনসংখ্যা প্রায় সমান সমান অর্থাৎ দুই কোটি ৪০ লাখ, দুটি দ্বীপ, যার কারণে সীমান্তের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাদের এবং চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ানের শক্তিশালী বাণিজ্য ও পরিবহন যোগাযোগ রয়েছে। ২৫ জানুয়ারি থেকে আড়াই মাস পর অস্ট্রেলিয়ায় এখন প্রায় পাঁচ হাজার করোনা রোগী রয়েছে। তাইওয়ানে ৪০০-র কম রোগী রয়েছে।

এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে অস্ট্রেলিয়ার অনেক বেশি করোনা রোগী আছে, ২০টি দেশে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বেশি করোনা রোগী আছে এবং সাতটি দেশে এটি ১০ গুণ বেশি; বরং তাইওয়ান এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে যা বিশ্বের অন্য দেশগুলো পারেনি।

ঠেকে শিখেছে তাইওয়ান

২০০৩ সালে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (সার্স) মহামারি ছড়িয়ে পড়লে দক্ষিণাঞ্চলীয় চীন ও হংকংয়ের সঙ্গে তাইওয়ানও ব্যাপক ধাক্কা খায়। চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দ্বীপটির দেড় লাখের বেশি মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে হয়েছিল এবং ১৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

বর্তমান সংকট সার্সকে মলিন করে দিয়েছে, এশিয়াজুড়ে আতঙ্কের এক ঢেউ তুলেছে এবং ভবিষ্যৎ মহামারির সময় মানুষজন কীভাবে তা মোকাবিলা করবে তা সংশয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর কোনও কোনও অঞ্চলের মানুষজন দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে এবং এই বিপদকে বিশ্বের অন্য দেশ বা অঞ্চলের তুলনায় বেশি গুরুত্ব হিসেবে নিয়েছে, সেটা সরকারি ও সামাজিক পর্যায়ে; তাই তো জানুয়ারি থেকেই অনেক অঞ্চলে মাস্ক পরা এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে।

তাইওয়ানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বিশ্বমানের। জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (জামা) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যখন উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় তখন তাইওয়ানের ন্যাশনাল হেলথ কমান্ড সেন্টার (এনএইচসিসি) সার্স থেকে শিক্ষা নিয়ে সম্ভাব্য এই হুমকি মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।

স্ট্যানফোর্ড মেডিসিনে শিশু বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ও তাইওয়ানিজ একজন ডাক্তার এবং ওই রিপোর্টের সহ-লেখক জেসন ওয়াং বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তাইওয়ান গত পাঁচ সপ্তাহে অন্তত ১২৪টি অ্যাকশন আইটেম তৈরি করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করেছে। ওই নীতির মধ্যে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কারণ তারা বুঝতে পেরেছে কেবল এটি যথেষ্ট নয়।

তাইওয়ান যখন এগুলো বাস্তবায়ন করছিল তখন অন্য দেশগুলো কী সিদ্ধান্ত নেবে তা নিয়ে বিতর্ক করছিল। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় গত জানুয়ারি এক গবেষণায় দেখতে পায়, নৈকট্য, সম্পর্ক ও পরিবহন যোগাযাগের কারণে চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছিল তাইওয়ান।

এই প্রাথমিক সিদ্ধান্তমূলক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে ছিল চীনের অনেক অঞ্চল থেকে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা, দ্বীপটির বন্দরগুলোতে প্রমোদতরী নোঙর বন্ধ করা এবং যে কেউ হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়ম ভঙ্গ করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত ছিল।

এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ নিশ্চিত করতে মাস্ক উৎপাদন বৃদ্ধি, হঠাৎ করে নিউমোনিয়ায় আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এমন ব্যক্তিসহ দ্বীপজুড়ে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা এবং এই ভাইরাস নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর জন্য নতুন শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছিল।

ওয়াং ও তার সহযোগী লেখকরা লিখেন, বিশ্বজুড়ে কভিড -19 এর ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে তাইওয়ান যে কর্ম পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করেছে এবং এসব কর্মকাণ্ডের কার্যকারিতা বড় ধরনের মহামারি ঠেকিয়েছে, যা হয়তো অন্য দেশগুলোর জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।

তাইওয়ান সরকার ২০০৩ সালে সার্স থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল এবং পরবর্তীতে এমন সংকটের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি জনস্বাস্থ্য রেসপন্স মেকানিজম প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা এই সংকটটি দ্রুত উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং মহামারির প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাগুলোকে সক্রিয় করে তোলে।

বিশেষ করে, তাইওয়ানের দ্রুত ও স্বচ্ছ রেসপন্স একইসঙ্গে মেডিকেল কর্মকর্তারা করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিন ব্রিফ করেছে, যা এই মহামারি প্রতিরোধে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের জন্য উদাহরণ হতে পারে। যদিও বিভিন্ন দেশ বলেছিল এতো দ্রুত এই ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা চীনের মতো একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু চীন ও অন্যান্য আরও দেশের মতো তাইওয়ান এতো কড়াকড়ি লকডাউন এড়াতে সক্ষম হয়েছে।

তাইওয়ান এখন এতো শক্ত অবস্থানে রয়েছে যে কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশীয় সরবরাহ নিশ্চিত করার পর বুধবার সেখানকার সরকার জানিয়েছে- তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন ও আরও নয়টি ইউরোপীয় দেশসহ যাদের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তাদের এক কোটি মাস্ক দান করবে।

মহামারির রাজনীতি

তাইওয়ানের তুলনামূলক এ্ই সাফল্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সংকট গভীর হওয়ার কারণে চাপা পড়ে গেছে এবং কোনও কিছু শেখার মতো পরিস্থিতি এখন আর নেই।

কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর হাতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন তারা তাইওয়ানকে অনুসরণ করেনি। এর অন্যতম একটি কারণ হতে পারে, অন্যান্য সরকারের মতো তাইওয়ান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সদস্য নয়।

চীন তাইওয়ানকে তাদের নিজের অংশ বলে দাবি করে। আর এ কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন তাইওয়ানের অংশ নেয়ার পথ বন্ধ করে দেয় বেইজিং।

২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পর্যবেক্ষকের মর্যাদা ছিল তাইওয়ানের। কিন্তু গণতন্ত্রপন্থি ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি তাইওয়ানে জয়ী হওয়ার পর বেইজিংয়ের সঙ্গে তাইপে’র সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

ডব্লিউএইচও বলছে, সদস্য দেশগুলোর বৈঠকে তাইওয়ান না থাকলেও স্বাস্থ্য তথ্য ও নির্দেশনা ভাগাভাগি নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি, কারণ বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এই সংস্থার মাধ্যমে তাদের আন্তর্জাতিক সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখছে। কিন্তু তাইওয়ানের কর্মকর্তাসহ অনেক পর্যবেক্ষকই বলছেন, সার্স মহামারি এবং বর্তমান সংকটের সময় এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

অস্ট্রেলিয়ার লোউয়ি ইন্সটিটিউটের চীন, তাইওয়ান অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ নাতাশা কাসাম বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর দিকে ডব্লিউএইচও’র সঙ্গে সরাসরি ও সময়মতো তথ্য আদান-প্রদান হয়নি, ‘তাইওয়ানের করোনা সংক্রমণ নিয়ে ভুল তথ্য’ পেয়েছে সংস্থাটি, কারণ তারা এসব তথ্যের জন্য বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

তিনি বলেন, ডব্লিউএইচও’র উপাত্ত ও সহায়তায় কমতি ছিল বলে অভিযোগ করেছে তাইওয়ান কর্তৃপক্ষ।

এ কারণেই হয়তো তাইওয়ান একা চলেছে এবং ডব্লিউএইচও ব্যাপক অর্থে বৈশ্বিক মতামতের ওপর নির্ভর করে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ানের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে ডব্লিউএইচও-তে তারা না থাকায় বৈশ্বিক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

গত সপ্তাহে তাইপে’তে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সকে জন্স হপকিন্স থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন মহামারি বিশেষজ্ঞ ভাইস প্রেসিডেন্ট চেন চিয়েন-জেন বলেন, আমরা সাহায্য করতে চাই- আমাদের সেরা ডাক্তার, সেরা গবেষক, সেরা নার্সদের পাঠাতে চাই এবং যেসব দেশের প্রয়োজন তাদের সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে চাই। আমরা ভালো বৈশ্বিক নাগরিক হতে চাই এবং অবদান রাখতে চাই কিন্তু এখন আমরা সেটা করতে পারছি না।

হংকংয়ের পাবলিক ব্রডকাস্টার আরটিএইচকে গত সপ্তাহে ডব্লিউএইচও’র সহকারী মহাপরিচালক ব্রুস আইলওয়ার্ডকে এক সাক্ষাৎকারে তাইওয়ানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে যান।

পরে এক বিবৃতিতে ডব্লিউএইচও জানায়, ডব্লিউএইচও’তে তাইওয়ানের সদস্যপদ প্রশ্নটি সংস্থাটির সদস্য দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল, কোনও কর্মীর ওপর নয়।

শুক্রবার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং বলেছেন, সব পক্ষকেই স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে- ডব্লিউএইচও সদস্যদের সার্বভৌম রাষ্ট্র হতে হবে।

তাইওয়ান সরকারের কথা বিরোধিতা করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ডব্লিউএইচও’র ইভেন্টগুলোতে তাইওয়ানের অংশগ্রহণ এবং এই মহামারিসহ জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থার বিষয়ে তথ্য প্রাপ্তিতে কোনও সমস্যা হয়নি। আমরা আশা করি (যুক্তরাষ্ট্র এবং তাইওয়ান) মহামারিটির অজুহাতে রাজনৈতিক ম্যানিপুলেশনে জড়িত থাকার তাদের প্রচেষ্টা বন্ধ করবে।

ডব্লিউএইচও’র একজন মুখপাত্র সিএনএনকে বলেছেন, কিছু লোক সংস্থাটির সদস্যপদ পাওয়ার ম্যান্ডেট ও টেকনিক্যাল গ্লোবাল পাবলিক হেলফ ম্যান্ডেট নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক ইমেইলে জানায়, প্রতিবছর, ডব্লিউএইচও এবং তাইওয়ানিজ কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষজ্ঞরা সু-প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য এবং বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেন। বর্তমান কভিড-19 মহামারির মধ্যেও নিয়মিত কথাবার্তা হচ্ছে। সেখানে বলা হয়, জনসংখ্যার তুলনায় তাইওয়ানের কেসলোড কম। আমরা ঘনিষ্ঠভাবে সবকিছু লক্ষ্য রাখছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাইওয়ানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষসহ সব অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা গ্রহণ করছে।

এ/সি

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
করোনায় আরও একজনের মৃত্যু
আরও ৩৫ জনের করোনা শনাক্ত
করোনায় প্রাণ গেলো আরও ১ জনের, শনাক্ত ৪৯
আরও ৪৬ জনের শারীরে করোনা
X
Fresh