করোনায় ইতালির চেয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃত্যু কম কেন?
বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত কোভিড-১৯ মহামারীর অবনতির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার উন্নতির ওপর জোরারোপ করছে। যদি পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করা যায়; তবে বহু বিশেষজ্ঞ আরও বেশি পরীক্ষার ওপর জোর দেবেন। সিএনএনে এক মতামতধর্মী লেখায় এ কথা বলেছেন নিউইয়র্ক সিটির মেমোরিয়াল স্লোয়ান কেটারিংয়ের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ কেন্ট সেপকোউইটজ।
পরীক্ষার সঙ্গে করোনার সংক্রমণ রোধের একটি সম্পর্ক যে আছে সেটা স্পষ্ট। ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার সংক্রমণের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় পরীক্ষার হার (৮ মার্চ পর্যন্ত প্রতি ১০ লাখে ৩৬৯২ জন) অনেক বেশি এবং সংক্রমিত হওয়াদের মধ্যে মৃত্যুর হার অনেক কম (শতকরা ০.৬ শতাংশ বা ৬৬ জন)
বিপরীতে ইতালি প্রতি ১০ লাখে ৮২৬ জনের ওপর পরীক্ষা চালিয়েছে এবং আক্রান্ত শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার ১০ গুণ বেশি, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অসুস্থ মানুষজন ডাক্তারের কাছে এবং হাসপাতালে যাচ্ছেন, তারা টেস্টের কথা বলছে কিন্তু কোনও টেস্ট না থাকায় বা তারা টেস্টিং ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ না করায় তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে-তাই অনেকে বলছে যে পরীক্ষার অভাবই আমাদের মৃত্যুর কারণ হবে।
তবে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরবর্তী সংক্রমণ ঠেকিয়ে জীবন বাঁচানো সম্ভব। যখন কোনো রোগের ওষুধ থাকে তখন আগে চিকিৎসা করা গেলে রোগীকে বাঁচানো যাবে; এমন কিছু থিওরি কাজ করে। যেমন সেপসিস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিলে বাঁচা সম্ভব, তবে দেরি করলেই মৃত্যু।
করোনাভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফুসফুসের দ্রুতগতিতে অকার্যকর হয়ে যায় ও মৃত্যু হয়। কিন্তু কেন ইতালির তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃত্যু অনেক কম? অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণেই কী এমন হয়েছে?
আপাতত, এটি আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্যের কারণে। শিগগির ক্রমবর্ধমান হারে হাসপাতাল এবং ডাক্তার ও নার্সদের কারণেও এই মৃত্যুর হারে পার্থক্য হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খারাপ খবর হচ্ছে তারা করোনাভাইরাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।
অনেকেই বিশ্বের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় ইতালির নাগরিকদের বয়সের বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতালির ২৮.৬ শতাংশ জনসংখ্যার ৬০ বছর বা তার বেশি। যা জাপানের পর দ্বিতীয়, দেশটির জনসংখ্যা ৩৩ শতাংশেরই বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি। সেই তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৮.৫ শতাংশ জনসংখ্যার বয়স ৬০ বছর, বিশ্বে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর দিক থেকে তাদের অবস্থান ৫৩তম।
আর এ কারণেই করোনায় এসব দেশের মৃত্যুর হারে মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে। ইতালিতে মৃত্যু হওয়াদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগেরই বয়স ৭০ বছরের ওপরে।
বিপরীতে দক্ষিণ কোরিয়ায় তুলনামূলকভাবে কম বয়সী ব্যক্তিরা আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি ছিল। আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগের বয়স ২০ বছরের কোঠায়।
আবার লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যও আছে। বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেক নারী ও অর্ধেক পুরুষ। তাদের লিঙ্গ ভেদে বাঁচার হার ভিন্ন। চীনের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে করোনা আক্রান্ত পুরুষদের মৃত্যুর হার ৪.৭ শতাংশ, যেখানে নারীদের মধ্যে এই মৃত্যুর হা ২.৮ শতাংশ। এক্ষেত্রেও দক্ষিণ কোরিয়া অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, যেখানে আক্রান্তদের ৬২ ভাগই নারী।
আবার করোনায় মৃত্যুর সঙ্গে ধূমপানেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ধূমপায়ীদের হার যথাক্রমে ২৪ শতাংশ ও ২৭ শতাংশ। কিন্তু ধূমপায়ীদের লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যও ব্যাপক, ইতালিতে ধূমপায়ীদের ২৮ শতাংশ পুরুষ ও ২০ শতাংশ নারী; আর দক্ষিণ কোরিয়ায় ধূমপায়ীদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ পুরুষ ও ৫ শতাংশের কম নারী।
অন্যভাবে বললে, দক্ষিণ কোরিয়ার অপেক্ষাকৃত তরুণ অধূমপায়ী নারীদের মাঝে করোনার সংক্রমণ ঘটেছে। যেখানে ইতালিতে বয়স্ক এবং খুবই বয়স্ক, যাদের অনেকেই আবার ধূমপায়ী, তাদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটেছে।
দুই দেশের মধ্যে বয়সগত এসব পার্থক্যই বলে দেয় কেন দেশটিতে মৃত্যুর হারে এতটা পার্থক্য রয়েছে। আর কেনবাই যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াইলে একটি নার্সিং হোমে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
তবে কী ঘটছে তা পুরোপুরি বুঝতে বয়স ও লিঙ্গ সম্পর্কে আমাদের প্রতিদিনের আপডেট প্রয়োজন। কিন্তু যুক্তরষ্ট্রে কার্যকর একটি টেস্টিং প্রোগ্রামের অভাবে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ শনাক্ত ব্যর্থ হয়েছে এবং আরও সংক্রমণ ঘটবে।
তবে এটা উপলব্ধি খুব জরুরি যে সংক্রমণ নিয়ে বেঁচে থাকা পুরোপুরি আলাদা একটি বিষয়। এজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ, ট্রেনিং ও দক্ষতা।
এর আওতায় বিশেষ বিছানা, বয়স্কদের ওষুধ সম্পর্কে ফার্মাসিস্টদের ধারণা এবং নার্সদের দুর্বল ব্যক্তিদের সম্পর্কে অবগত হতে হবে। কেবল আরও পরীক্ষা করা এবং আরও কঠোর পরীক্ষা করে ইতোমধ্যে সংক্রমিত হওয়া হাজার হাজার মার্কিনির জীবন বাঁচানো সম্ভব না।
তবে ভালো প্রস্তুতি মৃত্যু ঠেকাতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালিতে মহামারির মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বয়স্কদের কিভাবে সর্বোত্তমভাবে সুরক্ষা দেয়া, প্রয়োজনে চিকিৎসা করা যায় তা নির্ধারণ করার জন্য জেরিয়াট্রিশিয়ান, সোশ্যাল সায়েন্টিস্টস, আইসিইউ বিশেষজ্ঞ এবং অন্যদের একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল একত্রিত করার সময় এসেছে।
এ/পি
মন্তব্য করুন