• ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

দু’বার ভেঙে যায় সৌদি রাষ্ট্র, তৃতীয়বার সফল হন বাদশাহ আজিজ (পর্ব ২)

  ১৪ মে ২০২১, ১৯:০৩
দু’বার ভেঙে যায় সৌদি রাষ্ট্র, তৃতীয়বার সফল হন বাদশাহ আজিজ (পর্ব ২)
আধুনিক সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের রাত্রিকালিন দৃশ্য

কিভাবে আজকের সৌদি আরব রাষ্ট্রের উৎপত্তি কিভাবে কিংবা আধুনিক সৌদির ইতিহাস সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি আমরা? সেই ইতিহাস বিশদভাবে আপনাদের মাঝে তুলে ধরতেই আরটিভি অনলাইনের আয়োজনে সৌদি আরবের জন্মলগ্ন ও এর রাজতন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে শুরু হচ্ছে তিন পর্বের ধারাবাহিক। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব-

প্রথম পর্বে আমরা প্রথম সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও সৌদ পরিবারের উত্থান সম্পর্কে জেনেছি। আল মুকরিন বা প্রথম সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ বিন সৌদ বিন মুহাম্মদ বিন মুকরিন ছোট থেকেই ডানপিটে আর প্রচণ্ড সাহসী ছিলেন। এই উচ্চাভিলাষী মরুযোদ্ধা ১৭৪৪ সালে আরবের বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা মুহাম্মদ বিন ওয়াহাব (ওয়াহাবী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা) -এর সাথে মৈত্রী চুক্তি করে ‘দীরিয়া আমিরাত’ গঠন করেন। তখন ছিলো উসমানিয়া খলিফাদের শাসনামল। তারাই মক্কা মদিনা অঞ্চল শাসন করতো। তুরস্কের এই উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে শিরক-বিদাত পালনের অভিযোগে মুহাম্মদ বিন সৌদ ও ওয়াহাব ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ শুরু করেন।

তারপর মুহাম্মদ বিন সৌদ এবং মুহাম্মদ বিন ওয়াহাব দুজনে মিলে গঠন করেন স্বাধীন দীরিয়া আমিরাত নামে ছোট্ট একটি দেশ। দীরিয়া আমিরাত নামের ওই স্বতন্ত্র একটি ছোট্ট রাজ্যই হলো প্রথম সৌদি রাজ্য। সে রাজ্য গঠিত হয় ইসলামের নামে এবং শিরক ও বিদআতমুক্ত বিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। এভাবেই সূচনা হয় আজকের সৌদি আরবের।

দীরিয়া আমিরাত গঠনের পর দুই শীর্ষ নেতা তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করেন। মুহাম্মদ বিন সৌদ তার পুত্র আবদুল আজিজের সাথে মুহাম্মদ বিন ওয়াহাবের মেয়ের বিয়ে দেন। এভাবেই সৌদ পরিবার ও ওয়াহাবী মতবাদের মিলনযাত্রা শুরু হয়। ১৭৬৫ সালে মুহাম্মদ বিন সৌদ-এর মৃত্যু হলে তার ছেলে আবদুল আজিজ দীরিয়ায় ক্ষমতাসীন হয়।

১৭৬৫ সালে মুহাম্মদ বিন সউদের মৃত্যু হলে তার ছেলে আবদুল আজিজ দীরিয়ায় ক্ষমতাসীন হন। ১৮০১-১৮০২ সালে আবদুল আজিজ তুর্কি খিলাফতের কাছ থেকে ইরাক দখল করে নেন। এরপর ১৮০৩ সালে একজন শিয়া আবদুল আজিজকে দীরিয়ায় আসরের নামাজরত অবস্থায় হত্যা করে। এর আগে ১৭৯২ সালে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের ইন্তেকাল হয়।

আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর তার ছেলে সউদ বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতায় আসেন এবং তুর্কিদের পরাজিত করে ১৮০৩ সালে মক্কা ও ১৮০৪ সালে মদিনা দখল করে নেন। অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের অব্যাহত আক্রমণ প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে করে তোলে। অবশেষে অটোমান শাসক ইবরাহিম পাশার একাধিক হামলায় আরবের বিভিন্ন শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাতছাড়া হয়ে যায় শাসনক্ষমতাও।

এরপর দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন তুর্কি বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন সউদ। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রাণান্ত লড়াই করে তিনি পুনরায় আরব ভূখণ্ডে আরবীয়দের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনেন। ১৮১৮ সালে দীরিয়ায় প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের পতন হলে নিহত আবদুল্লাহর ‘তুর্কি বিন আব্দুল্লাহ’ নামে এক ছেলে মরু অঞ্চলে পালিয়ে যান এবং বনু তামিম গোত্রে আশ্রয় নেন। পরে ১৮২১ সালে তিনি আত্মগোপন থেকে প্রকাশ্যে এসে উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

তুর্কি বিন আবদুল্লাহ ১৮২৪ সালে উসমানিয়াদের নিয়োজিত মিসরীয় শাসকদের হটিয়ে আবার দীরিয়া এবং সঙ্গে রিয়াদ দখল করে নেন। রিয়াদকে রাজধানী করে ‘নজদ আমিরাত’ নামে ইতিহাসের দ্বিতীয় সৌদি রাজ্য গঠন করেন তিনি। দ্বিতীয় সৌদি রাজ্যের আয়তন আগের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। কিন্তু সেটিও বেশি দিন প্রতিষ্ঠিত ছিলও না। ১৮৩৪ সালে তুর্কি বিন আবদুল্লাহকে তার এক জ্ঞাতি ভাই মুশারি বিন আবদুর রহমান বিদ্রোহ করে হত্যা করেন। কিছুদিন মুশারি ক্ষমতায় থাকলেও পরে তাকে হত্যা করা হয় এবং তুর্কির ছেলে ফয়সাল নজদ আমিরাতের ইমাম নিযুক্ত হন।

কিন্তু ১৮৯১ সালে মুলায়দার যুদ্ধে উসমানিয়াদের অনুগত রাশিদি বাহিনীর হাতে দ্বিতীয় সৌদি আমিরাতের পতন ঘটে। ক্ষমতা চলে যায় উসমানি শাসক মুহাম্মাদ বিন রশিদের হাতে। ফলে তৎকালীন সৌদিদের শেষ উত্তরসূরি আবদুর রহমান বিন ফয়সাল তার সহচরদের নিয়ে পালিয়ে যান। বিস্মৃত উষর বালুকাময় ‘রুব আল খালি’ মরুভূমি পাড়ি দিয়ে আবদুর রহমান তার ছেলে আবদুল আজিজকে নিয়ে দক্ষিণ-পূর্বের মুররা নামক বেদুইন গোত্রে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

কিন্তু শীঘ্রই কুয়েতি আমির মুবারাক আল সাবাহের অতিথি হিসেবে তিনি কুয়েতে আশ্রিত হন। ১৯০২ সালে তার পুত্র আব্দুল আজিজ রিয়াদে সৌদি শাসন ফিরিয়ে আনার মিশনে নামেন। তিনি রিয়াদের মাস্মাক দুর্গ দখল করে সেখানের গভর্নরকে হত্যা করেন। তখন মাত্র ২০ বছর বয়সে রিয়াদের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন আব্দুল আজিজ। সৌদ পরিবারের নতুন নেতা হিসেবে তার পরিচয় তখন থেকে হয় ‘ইবনে সৌদ’। পরের তিন দশক তিনি নাজদ থেকে শুরু করে আশপাশের অঞ্চলে সৌদি সাম্রাজ্যে প্রভাব বিস্তৃত করতে শুরু করেন।

তার প্রধান শত্রুরা ছিলেন হাইলের আল রশিদ গোত্র, হেজাজের মক্কার শরিফগণ এবং আল হাসা-র অটোম্যান তুর্কিরা। আবার, প্রয়াত চাচা সৌদ ইবনে ফয়সালের বংশধরদের সাথেও তার লেগে যায়, কারণ তারাও সিংহাসন দাবি করে। আল রশিদরা পায় অটোম্যানদের সমর্থন। তাই আগে অটোম্যান খেলাফতের সমর্থনে থেকে নিজে ‘পাশা’ উপাধি নিলেও পরে তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে মিত্রতা করেন আল রশিদের বিরোধিতা করতে।

১৯১৫ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ইবনে সৌদের অধিকৃত অঞ্চলের নিরাপত্তা দেয় ডারিন চুক্তি অনুযায়ী। ১৯২১ সালে ইবনে রশিদদের পরাজিত করেন ইবনে সৌদ। তিনি তার নতুন অধিকৃত অঞ্চলের নাম দেন নাজদ সালতানাত। ১৯২৬ সালে তিনি হেজাজ জয় করেন। এর কয়েক মাস পর শেষ হয় ব্রিটিশ নিরাপত্তা। পরের পাঁচ বছর তিনি কিংডম অফ হেজাজ এবং কিংডম অফ নাজদ এই দুই রাজ্য পরিচালনা করেন। ১৯৩২ সালের মাঝে সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দেন ইবনে সৌদ। সে বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন কিংডম অফ সৌদি অ্যারাবিয়া, যা আজকের সৌদি আরব।

ছয় ফুট চার অথবা পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ছিলেন ইবনে সৌদ। বিশাল এ মানুষটির প্রায় ২২ জন স্ত্রী ছিল নানা সময়ে, ফলে তার অনেক পুত্র কন্যা হয়েছিল। পুত্রের সংখ্যাই ছিল ৪৫! তবে, এক সময়ে একাধারে চারজন করেই স্ত্রী ছিল তার। বিবাহের মাধ্যমে তিনি নানা গোত্রের সাথে সম্পর্ক করেন। এমনকি ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের আশ শাইখ পরিবারের সাথেও এভাবে সম্পর্ক হয় তার।

১৯৩৭ সালে দাম্মামের কাছে আবিষ্কৃত হয় তেলের বিশাল রিজার্ভ। আর তেলের কারণে অর্থনৈতিক মোড় ঘুরে যায় সৌদ পরিবারের। ১৯৪৫ সালে আমেরিকার সঙ্গে মিত্রতা করেন তিনি। ১৯৫৩ সালে ইবন সৌদ মারা যান। তিনি আজ সৌদি আরবের ‘প্রতিষ্ঠাতা’ নামে পরিচিত। তার সরাসরি বংশধরগণ ‘হিজ/হার রয়াল হাইনেস’ উপাধি পান। ১৯৯৯ সালে (হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে) সৌদি আরবের শতবর্ষ পালিত হয়, কারণ ১৯০২ সালে তিনি রিয়াদ অধিকার করেছিলেন।

তার মৃত্যুর পর পুত্র সৌদ বিন আব্দুল আজিজ সিংহাসনে আরোহণ করেন কোনো ঘটনা ছাড়াই। কিন্তু তার বিলাসবহুল জীবনের কারণে ক্রাউন প্রিন্স ফয়সালের সাথে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে গ্র্যান্ড মুফতির নির্দেশে তাকে সিংহাসন ছেড়ে দিতে হয় ফয়সালের কাছে। এ সময় ইবনে সৌদের কয়েক পুত্র মিসর চলে যান, তারা নিজেদের ‘ফ্রি প্রিন্স’ ডাকতেন। যেমন, তালাল ইবনে আব্দুল আজিজ। পরে অবশ্য তাদের ফিরিয়ে আনেন ফয়সাল এবং রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেন।

১৯৭৫ সালে ভাগ্নের হাতে তিনি নিহত হন। ভাগ্নের নাম ছিল ফয়সাল ইবনে মুসাইদ, তাকে সাথে সাথেই মৃত্যুদণ্ড দিয়ে মেরে ফেলা হয়। পরের রাজা হবার কথা ছিল প্রিন্স মুহাম্মাদের, কিন্তু তিনি আপন ভাই প্রিন্স খালিদকে সিংহাসন দিয়ে দেন। ১৯৮২ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান কিং খালিদ, এরপর ফাহাদ রাজা হন। কিং ফাহাদ ছিলেন শক্তিশালী ‘সুদাইরি সেভেন’ এর সবচেয়ে বড়। এই সাতজন ছিলেন ইবনে সৌদের স্ত্রী হাসসা আল সুদাইরির ছেলে। ১৯৮৬ সালে কিং ফাহাদ ‘হিজ ম্যাজেস্টি’ উপাধি বাদ দিয়ে নতুন উপাধি চালু করলেন- ‘কাস্টোডিয়ান অফ টু হলি মস্কস’বা ‘দুই পবিত্র মসজিদের অভিভাবক’ (মক্কা-মদিনার দুই মসজিদ)।

১৯৯৫ সালে কিং ফাহাদের স্ট্রোক হবার পর তিনি প্যারালাইজড হয়ে যান। তখন ভারপ্রাপ্ত রাজা হন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদ। ২০১৫ সালের আগস্টে মারা যান কিং ফাহাদ, সেদিন রাজা হন কিং আব্দুল্লাহ। তিনি সাথে সাথেই ছোট ভাই সুলতান বিন আব্দুল আজিজকে ডিফেন্স মিনিস্টার এবং ‘সেকেন্ড ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার’ করেন, অর্থাৎ পরবর্তী রাজা তিনিই হবেন।

কিন্তু, ২০০৯ সালের ২৭ মার্চ তিনি ইন্টেরিয়র মিনিস্টার প্রিন্স নায়েফকে ‘সেকেন্ড ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার’ বলে ঘোষণা দেন, এবং ২৭ অক্টোবর তাকে ক্রাউন প্রিন্স করেন। সুলতান মারা যান ২০১১ সালের অক্টোবরে নিউ ইয়র্কে। আর, প্রিন্স নায়েফ মারা যান ২০১২ সালের ১৫ জুন জেনেভাতে। ক্রাউন প্রিন্স তখন হলেন সালমান।

দীর্ঘকাল অসুখে ভোগার পর নয় বছর শাসন শেষে ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি নিউমোনিয়ায় মারা যান কিং আব্দুল্লাহ। ভাই ও ক্রাউন প্রিন্স সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদ তখন হন নতুন রাজা।

২০১৫ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি মুহাম্মাদ বিন নায়েফ আল সৌদকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি ফার্স্ট ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে কাজ করেছেন, এ ছাড়াও সৌদি আরবের ইন্টেরিয়র মিনিস্টার ছিলেন, একইসাথে তিনি আব্দুল আজিজের প্রপৌত্র। কিন্তু ২০১৭ সালের ২১ জুন তাকে সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তার ক্রাউন প্রিন্স উপাধিও কেড়ে নেন কিং সালমান। চলবে…

টিএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh