• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

যে পরিবারের নামানুসারে আল মুকরিন হয়ে ওঠে আজকের সৌদি আরব (পর্ব ১)

  ১৩ মে ২০২১, ২০:৪৯
যেভাবে সৃষ্টি হয় আজকের সৌদি আরব, যে পরিবারের নামানুসারে আল মুকরিন হয়ে ওঠে আজকের সৌদি আরব (পর্ব ১)
দীরিয়ার ধ্বংসাবশেষ। এখানেই বাস করতো তখনকার সৌদ পরিবার - সংগৃহীত

‘সুদূর মক্কা মদিনার পথে আমি রাহি মুসাফির,
বিরাজে রওজা মোবারক যথা মোর প্রিয় নবীজীর।
বাতাসে যেখানে বাজে অবিরাম - তৌহিদ বাণী খোদার কালাম,
জিয়ারতে যথা আসে ফেরেশতা শত আউলিয়া পীর।’

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখনিতে এভাবেই বর্ণনা করেছেন এই পবিত্র শহর দুটিকে। আর এই মক্কা-মদিনা তথা পবিত্র কাবা শরীফের দেশ সৌদি আরব। বছর বছর পবিত্র হজ পালনের জন্য দলে দলে মানুষ ভিড় করেন মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে। নবী করিম (সাঃ)-এর রওজা মুবারকও এই দেশেই অবস্থিত। তাই সকল মুসল্লির কাছে সৌদি আরব পবিত্র দেশ, নবীজির দেশ।

আমরা যারা মুসলিম তারা সবাই ছোট থেকেই সৌদি আরব সম্পর্কে কমবেশি অবগত। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনী, সাহাবাদের জীবনী ও হাদিস-কুরআনে অসংখ্যবার এই অঞ্চলের নাম উঠে আসায় মক্কা, মদিনা, তায়েফ প্রভৃতি অঞ্চল সম্পর্কেও আমরা পরিচিত। একইভাবে উহুদ পাহাড়, হেরা গুহা, বায়তুল্লাহ শরীফ, যমযম কূপ, মসজিদে নববী এসব জায়গাও আবেগ জাগায় মনে।

কিন্তু কিভাবে আজকের সৌদি আরব রাষ্ট্রের উৎপত্তি কিভাবে কিংবা আধুনিক সৌদির ইতিহাস সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি আমরা? আর তা বিশদভাবে আপনাদের মাঝে তুলে ধরতেই আরটিভি অনলাইনের আয়োজনে সৌদি আরবের জন্মলগ্ন ও এর রাজতন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে শুরু হচ্ছে তিন পর্বের ধারাবাহিক নিবন্ধ। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব -

পবিত্র ভূমির শহর সৌদি আরব-ই হলো বিশ্বের একমাত্র দেশ যেটির নামকরণ করা একটি পরিবারের নামানুসারে। মূলত সৌদ পরিবারের সঙ্গে মিল রেখেই নামকরণ করা হয় রাষ্ট্রটির। আর এই রাষ্ট্রের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় রয়েছে সেই সৌদ পরিবারের সদস্যরাই। বর্তমানে সৌদ পরিবার হলো বিশ্বের শীর্ষস্থানে থাকা ধনী পরিবার। পাশাপাশি অন্যতম ক্ষমতাধর পরিবারও বটে।

কিন্তু এই সৌদ পরিবার কিন্তু শুরু থেকেই এত ক্ষমতাবান কিংবা বিত্তশালী ছিল না। মরুভূমির নিতান্তই সাধারণ বেদুইন গোত্রদের মতোই ছিল এরা। সৌদ পরিবারের পূর্বপুরুষরা হয়ত ভাবতেও পারেননি তাদের নামেই একদিন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র সৌদি আরব গঠিত হবে।

আচ্ছা, এবার শুরু থেকেই বলা যাক। তাও প্রায় ৬০০ বছর পূর্বের কথা। হেজাজ আর নাজদের মরুর বুকে যখন বেদুইনদের প্রতাপ। তখনো আল মুরাইদি নামের এক লোক ভাবতেও পারেনি একদিন তারই কোনো বংশধরের হাত ধরে এ এলাকা হয়ে উঠবে একটি রাষ্ট্র। যে দেশের নাম কিনা আবার তারই পরিবারের নামে!

কীভাবে দরিদ্র মরুচারী থেকে পৃথিবীর ধনীতম রাষ্ট্রগুলোর একটি হয়ে উঠলো আজকের সৌদি আরব? এর পেছনে কতটুকু অবদান তরল সোনা নামে খ্যাত তেলের। কতটুকুই বা ইসলামের? সৌদ পরিবারের সঙ্গে শুরু হওয়া ওয়াহাবি মুভমেন্টের কী সম্পর্ক? সালাফিই বা কারা? সিংহাসন নিয়ে নাটকীয় খেলা চলতে থাকা এই দেশটির রাজপরিবারের অতীত কেমন ছিল? বর্তমানে কী চলছে? আর, ভবিষ্যতে কোনদিকে মোড় নিচ্ছে এ সিংহাসনের খেলা? ধারাবাহিকভাবে আমরা জানব প্রাচীন সে ইতিহাস।

আমাদের গল্পের শুরু যাকে নিয়ে তার পুরো নাম মানী’ ইবনে রাবিয়া আল মুরাইদি। তিনিই সৌদ পরিবারের প্রবীনতম পূর্বপুরুষ, যার সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়। তাদের নিজস্ব বংশতালিকা অনুযায়ী, ইসমাইল (আ.) এর বংশধর আদনান-এর মাধ্যমে যে বংশগুলো গড়ে ওঠে, তাদেরই একটি ছিল বনু বকর ইবনে ওয়াইল বংশ। এদের বনু হানিফা বংশের সদস্য ছিলেন মানী’ ইবনে রাবিয়া আল মুরাইদি।

মুরাইদি থাকতেন পূর্ব আরব তীরের কাতিফ নামক শহরের পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে। গ্রামটির নাম ছিল আল-দুরু। তার গোত্রের নাম ম্রুদাহ। তখন ১৪৪৬-১৪৪৭ সাল। তার এক আত্মীয় ইবনে দীর তাকে আমন্ত্রণ জানান তার কাছে গিয়ে থাকতে। ইবনে দীর ছিলেন তখন অনেকগুলো গ্রাম আর ভূসম্পত্তির (এস্টেট) মালিক বা শাসক। তার শসন করা সেই অঞ্চলটাই আজকের রিয়াদ।

যখন মানী’ সেখানে পৌঁছালেন, ইবনে দীর তাকে মুলায়বিদ ও গুসায়বা নামের দুটো প্রধান এস্টেটের দায়িত্ব দিয়ে দেন। কাতিফ থেকে তখন পরিবার পরিজনদের নিয়ে আসেন মানী’। ইবনে দীরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি এ অঞ্চলের নাম দিলেন ‘আল-দীরিয়া’। আজকের দিনে, রিয়াদ প্রদেশের জায়গা দীরিয়া, রাজধানী রিয়াদের উত্তর-পশ্চিম কোণে শহরের পাশেই এর অবস্থান।

চলুন এবার সে সময়কার হেজাজ আর নাজদ বলতে কোন অঞ্চল বোঝাত সেটা জেনে নেই। হেজাজ হলো- আজকের সৌদি আরবের পশ্চিম দিকের অঞ্চলটা। মক্কা, মদিনা, জেদ্দা কিংবা তায়েফ এ অঞ্চলেরই অন্তর্ভুক্ত। এটি পশ্চিম প্রদেশ নামেও পরিচিত। অন্যদিকে বর্তমান সৌদি আরবের মধ্যাঞ্চল হলো নাজদ। দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগণ এখানেই বাস করে। কাসিম, রিয়াদ, হাইল অঞ্চল নাজদ প্রদেশের অন্তর্গত ছিল।

সে সময় নাজদ প্রদেশের আশপাশে অন্য কোনো দেশ ছিল না। ফলে বিদেশি আগ্রাসনের মুখে পড়েনি অঞ্চলটি। ফলে মানী’ ইবনে রাবিয়া আল মুরাইদির ম্রুদাহ গোত্র নির্বঘ্নে দীরিয়া শাসন করতে লাগলো। ক্রমেই সেটি নাজদের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জনবসতি হয়ে উঠল। ওয়াদি (উপত্যকা) হানিফার তীর জুড়ে গড়ে উঠল মুরাইদির শাসিত অঞ্চল।

যদিও সে সময় মুরাইদির পরিবার তিনটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ চলে গেল রিয়াদ থেকে ৭৩.৪ কিমি উত্তর-পশ্চিমে দুরমা নামক এলাকায়। আর আলওয়াতবান নামের আরেক শাখা চলে যায় দক্ষিণ ইরাকের যুবায়ের শহরে। বাকি থাকে ওই পরিবারের আল মিগ্রিন শাখা। আল মিগ্রিনরা শাসন করে চলল দীরিয়া। পৌনে দু’শ বছর এভাবেই চলে গেল।

বনু হানিফা গোত্রের সৌদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মুকরিন ১৭২০ সাল থেকে ১৭২৫ সাল পর্যন্ত দীরিয়ার নেতা ছিলেন। তার পরিবারের নাম ছিল আল মুকরিন। ১৭২৫ সালে তিনি মারা যান। তার নাম থেকেই এ পরিবারের নাম দাঁড়ায় ‘সাউদ’ বা ‘সৌদ’ পরিবার - আল সৌদ। আর ওই পরিবারে নাম থেকেই সৃষ্টি হলো একটি রাষ্ট্র। যা আজকের সৌদি আরব। তবে বর্তমান নামের আগে আল মুকরিন বলেই পরিচিত ছিল রাষ্ট্রটি। চলবে…

টিএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh