• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
logo

তীর্থযাত্রীরা যেভাবে পুরো ভারতে ছড়িয়ে দিলো করোনা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, আরটিভি নিউজ

  ১১ মে ২০২১, ০৯:৪৩
কুম্ভমেলার তীর্থযাত্রীরা যেভাবে পুরো ভারতে ছড়িয়েছে করোনা
সংগৃহীত ছবি

মহামারি করোনার প্রথম ঢেউকে প্রতিবেশী ভারত মোকাবিলা করেছিল শক্ত হাতেই। বিশাল জনসংখ্যার দেশ হওয়া সত্ত্বেও সরকারি পদক্ষেপে সেবার মৃত্যু আর সংক্রমণের সংখ্যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

এরপর এলো মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ। গতমাসে দেশটি যখন সেই দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে লড়াই করছে, তারই মধ্যে হিমালয় অঞ্চলের শহর হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ হিন্দু সমবেত হয়। যদিও সবাই বলেছিলেন, এই কুম্ভমেলা এক ‘সুপার-স্প্রেডার ইভেন্ট’ অর্থাৎ ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস ছড়ানোর এক জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে পরিণত হবে।

এরপরের ঘটনা তো সবারই জানা। আনুমানিক ৯১ লাখ বাস্তবে আরও বেশি মানুষ গিয়েছিলেন এবারের মেলায়। কুম্ভমেলা থেকে ফিরে আসা লোকজনকে পরীক্ষা করে কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ে। আর তাদের থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ভারতজুড়ে।

এদেরই একজন পুরোহিত মাহান্ত দাস। তিনি কুম্ভমেলায় যোগ দেন ১৫ মার্চ। তখন ভারতের অনেক স্থানেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার চারদিন পর, এপ্রিলের ৪ তারিখে ৮০ বছর বয়সী এই হিন্দু পুরোহিত করোনায় আক্রান্ত হন। এরপর তাকে একটি তাবুতে ফিরে গিয়ে কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়।

কিন্তু একাকি আলাদা থাকার পরিবর্তে মাহান্ত শংকর দাস তার ব্যাগ গুছিয়ে একটি ট্রেন ধরলেন এবং প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বারাণসী পৌঁছালেন। সেখানে স্টেশনে তার ছেলে নগেন্দ্র পাঠক তাকে নিতে আসলেন এবং তারা আরও কিছু লোকের সঙ্গে একটি ট্যাক্সি শেয়ারে ভাড়া করে ২০ কিলোমিটার দূরের জেলা মির্জাপুরে তাদের গ্রামে পৌঁছালেন।

সেই পুরোহিত মাহান্ত দাস বেঁচে গেছেন ঠিকই। তবে তার মাধ্যমেই সংক্রমিত হয় তারই ছেলেসহ গ্রামের অনেকেই। যদিও ওই পুরোহিতের দাবি, তার কাছ থেকে কেউ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়নি। তার ছেলে নগেন্দ্র পাঠক জানান, তিনিও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে গ্রামে জ্বর এবং কাশির উপসর্গ নিয়ে ১৩ জন মারা গেছে।

এই গ্রামে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মাহান্ত দাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকতে পারে, আবার এটা নাও হতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেছেন। যাত্রীর ভিড়ে ঠাসা একটি ট্রেনে ভ্রমণ করে, শেয়ারের ট্যাক্সিতে চড়ে তিনি হয়তো পথে পথে অনেক জায়গায় ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর এই পুরোহিতের মতো হাজারো মানুষ ছড়িয়ে পরেন পুরো ভারতজুড়ে।

রোগতত্ত্ববিদ ডা. ললিতকান্ত বলছেন, মাস্ক না পরে কাণ্ডজ্ঞানহীন তীর্থযাত্রীদের বড় বড় দল যখন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গঙ্গার বন্দনা করছে, তখন আসলে তারা দ্রুত ভাইরাস ছড়ানোর এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে। আমরা জানি যে গির্জায় কিংবা মন্দিরে যখন সমবেত মানুষ এক সঙ্গে কোরাসে গান গায়, সেটি তখন একটি ‘সুপার-স্প্রেডার ইভেন্টে’ পরিণত হয়।

হরিদ্বারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেলা চলাকালেই কয়েক হাজার তীর্থযাত্রী কোভিড-পজিটিভ বলে ধরা পড়েছিল, যাদের মধ্যে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় নেতাও ছিলেন। উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব, নেপালের সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ এবং সাবেক রাণী কমল শাহ এই কুম্ভমেলা থেকে ফিরে আসার পর পরীক্ষা করে তারাও কোভিডে আক্রান্ত বলে জানা গেছে।

বলিউডের সঙ্গীত পরিচালক শ্রাবণ রাঠোরও এই কুম্ভমেলা থেকে ফেরার কদিন পর মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালে মারা যান। মেলায় যোগ দিতে যাওয়া আরেকটি দলের নয় জন হিন্দু ঋষি মারা যান।

কুম্ভমেলা থেকে ফেরা তীর্থযাত্রীরা অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কার মধ্যে কয়েকটি রাজ্য তাদের জন্য ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের বিধান চালু করে। যারা কুম্ভমেলায় যাওয়ার খবর চেপে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেয়।

সমালোচকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে এই কুম্ভমেলা বাতিল করতে চাননি, তার কারণ এটি করলে তিনি সম্ভবত ধর্মীয় নেতাদের দিক থেকে তোপের মুখে পড়তেন। কেননা হিন্দু পুরোহিত, ঋষি এবং গুরুরা কট্টর বিজেপির বড় সমর্থক। তারা নির্বাচনের সময় হিন্দু ভোট জোগাড় করে দিতে বড় ভূমিকা রাখে।

কুম্ভমেলার জন্য ১২ এপ্রিল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক দিন। সেদিন গঙ্গা নদীতে স্নান করেছেন তিরিশ লাখের বেশি মানুষ। হিন্দুদের বিশ্বাস, এই গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে তারা তথাকথিত মোক্ষলাভ করবে।

আর সেদিনই ভারতে ১ লাখ ৬৮ হাজার মানুষের কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ে। সংক্রমণের সংখ্যার দিক থেকে সেদিন ভারত ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে।

এরপরও থামেনি কুম্ভমেলা। পরে মেলার মধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক শীর্ষ ধর্মীয় নেতা মারা গেলে কিছুটা ভাটা পড়ে করোনা ছড়ানোর ওই উৎসবে।

উত্তরাখণ্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ত্রিভেন্দ্র সিং রাওয়াত শুরু থেকেই কুম্ভমেলাকে সীমিত আকারে প্রতীকীভাবে আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিলেন। কারণ বিশেষজ্ঞরা তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, এই মহামারি ‘খুব সহসা থামবে না।’ কিন্তু এই উৎসব শুরুর মাত্র ক’দিন আগে তাকে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তার জায়গায় বসানো হয় তিরাত সিং রাওয়াতকে, যিনি হাস্যকর মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘মা গঙ্গার আশীর্বাদ থাকলে কোন করোনা হবে না।

নতুন মুখ্যমন্ত্রী বললেন, কুম্ভমেলায় আসতে ‘কাউকে বাধা দেয়া হবে না’, মেলায় যোগ দিতে কোন কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট লাগবে না এবং নিরাপত্তার নিয়মগুলো মেনে চললেই যথেষ্ট। কিন্তু যখন লাখ লাখ মানুষ আসতে শুরু করলো, তখন কর্মকর্তারা এসব নিয়ম মানতে আর মানুষকে বাধ্য করতে পারলেন না। আর এভাবেই কুম্ভমেলা হয়ে ওঠে করোনাভাইরাস ছড়ানোর উৎসব। সূত্র : বিবিসি

টিএস/পি

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh