• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

উপনিবেশবাদ যেভাবে পাকিস্তানের ধর্ম সহনশীল চরিত্র বদলে দিয়েছে

  ১৯ এপ্রিল ২০২১, ২২:৪৬
How colonialism eroded Pakistan’s history of religious fluidity
সংগৃহীত

পাকিস্তানের লাহোরের কাছে রাম থামান গ্রামের একটি বাড়িতে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। একটি খাটের পাশে চক্রাকারে নাচছে ৭ থেকে ৮ জন তরুণ যুবক। তাদের হাতে থাকা লাঠি দিয়ে মাঝে মাঝে একে অপরের হাতে থাকা লাঠিকে আঘাত করছে। এই নাচে একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিসহ আরও অনেকেই যোগ দেন, যাদের অধিকাংশই পুরুষ।

পার্শ্ববর্তী বাড়িগুলোর ছাদ থেকে নারীরা এই নাচ দেখছে। সময় যত গড়াচ্ছে দর্শকের সংখ্যা ততই বাড়ছে। ওই খাটের ওপর একটি চাদর বিছানো রয়েছে, যেখানে নাচতে থাকা যুবককে জন্য উপহার হিসেবে দর্শকদের দেয়া টাকা-পয়সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

রাম থামান দরগায় এই উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। ১৬ শতাব্দীর একজন হিন্দু সাধু ছিলেন রাম থামান। তার নামেই এই গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে। প্রতি বছর বৈশাখী উৎসবে ওই দরগায় এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। হিন্দু এবং শিখ পৌরাণিকে এই বৈশাখীর শেকড় লুকিয়ে রয়েছে। প্রতি বছর এপ্রিল মাসে এই উৎসব পালিত হয়।

তিনদিন ধরে পুরো গ্রাম উৎসবে মেতে ওঠে। এই গ্রামটি একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের চত্বরের ভেতর অবস্থিত। তবে এই উৎসবের সময় গ্রামটি যেন একটি ব্যস্ত শহরে পরিণত হয়। পুরো দেশে থেকে শত শত পুণ্যার্থী এই গ্রামে আসে। তারা সেখানে অস্থায়ী তাঁবু গাড়ে। পুরো গ্রামের অলিগলিতে এই উৎসব ছড়িয়ে পড়ে।

ওই সাধুকে প্রণামী দিতে তরুণ নাচিয়েদের দলটি চাদরটি আশ্রমে নিয়ে যায়। ২০ বছরের কোঠায় বয়স গুলাম আলি বলেন, আমরা কাসুর থেকে এই চাদর নিয়ে এসেছি। এটা আমরা সাধুকে প্রণামী হিসেবে দিতে চেয়েছি। আমরা এটা ১৫ বছর ধরে করছি। আমরা বিভিন্ন আশ্রমে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাই, চাদর উপহার দেই, আমার গ্রুপ নিয়ে নাচ-গান করি এবং মানুষজন যে টাকা দেয় তা সংগ্রহ করি।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জায়গায়ও হিন্দু মন্দিরে হাজারো উৎসবে এ ধরনের চিত্র দেখা যায়। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্যান্য জায়গার একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আর তা হচ্ছে রাম থামানে আসা ভক্তদের অধিকাংশই হিন্দু নয় বরং মুসলিম।

পাকিস্তানে এমন শত শত দরগা রয়েছে, যেগুলোর বহু বছরের পুরনো ইতিহাস রয়েছে। এসব দরগার অধিকাংশই সুফি, তবে কিছু কিছু রাম থামানের মতো হিন্দু মন্দিরও রয়েছে। কিছু কিছু দরগায় হাজার হাজার মানুষ আসে। আবার কিছু কিছু দরগায় উৎসবের সময় লাখ লাখ মানুষের জমায়েত হয়।

দিল্লি বাই হার্ট অ্যান্ড আইডেন্টিটি, ফেইথ এবং কনফ্লিক্টসহ একাধিক বইয়ের লেখক, সাংবাদিক ও পলিসি অ্যানালিস্ট রাজা রুমি বলেন, সুফি দরগায় যাত্রা ধর্মীয় অভিজ্ঞতা লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

তিনি বলেন, একটি সুফি দরগায় গেলে ভক্তরা ধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক বা প্রথাগত ধারা বাইরের গিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। সুফি দরগা যাত্রা ভক্তদের জন্য বহু ধাপের একটি যাত্রার মতো। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন প্রার্থনার শারীরিক যাত্রা বিষয়টি ফুটে ওঠে। তেমনি সামাজিক যোগাযোগও তৈরি হয় এবং দরগায় যায় এমন মানুষদের সঙ্গে একটি সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

রাম থামানে বৈশাখী উৎসব অন্য যেকোনো সুফি উৎসবেরই মতোই। তবে সুফি উৎসবগুলো দরগায় হয়ে থাকে। আর এটা সমাধিতে হচ্ছে। এই জায়গায় পাশে একটি হিন্দু মন্দির রয়েছে, যেখানে দেবী কালীকে রাখা হয়েছে। এই দুই ভবনের পাশেই বড় একটি পবিত্র পুল রয়েছে। আর পুরো গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট অনেক মন্দির।

পাকিস্তানে সুফি দরগার বাইরে যেসব হিন্দু দরগা আছে রাম থামান সেগুলোর একটি। এছাড়াও সিন্ধু প্রদেশে যেখানে পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি হিন্দু থাকে, সেখানে উদেরো লাল এবং সাধু বেলার দরগা রয়েছে।

লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসের একজন ইতিহাসবিদ আলি উসমান কাসমি বলেন, এই দরগা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমরা বিশ্বকে হিন্দু বা মুসলিমের হিসেবে দেখি না। তিনি বলেন, এটা আমাদের সমস্যা। এটা আমাদের জন্য প্রশ্ন যে, আমরা কিভাবে এই ঐতিহ্যকে কোনও একটা ক্যাটাগরিতে ফেলছি? এটা আধুনিকতার সমস্যা, সম্ভবত যারা এই দরগায় আসেন, তাদের জন্য নয়। দৃশ্যত তাদের দৃষ্টিতে বিশ্বে কোনও দ্বিমত নেই।

অনেকের কাছেই রাম থামানে তীর্থযাত্রা সুফি দরগা বড় বৃত্তে ঢোকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। কাসমি বলেন, উপনিবেশ পূর্ব সময়ে মানুষজনের পরিচয় খুব একটা স্পষ্ট না। মানুষজন একইসঙ্গে বিভিন্ন পরিচয় বহন করতো। তাই একজন হিন্দু মুসলিম দরগায় যেতো তেমনি একজন মুসলিমও হিন্দু দরগায় যেতো। এখন আমরা হিন্দু-মুসলিমের যে বিভাজনটা দেখতে পাই, সেটা তখনও গড়ে ওঠেনি।ট কিন্তু উপনিবেশবাদ, আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব কিছু পরিবর্তন হতে থাকে।

আধুনিকতা এই সীমারেখাহীন সমাজ পছন্দ করে না। পরিচয়টা সুস্পষ্ট হতে হবে। এটা নির্ধারণযোগ্য হতে হবে। উপনিবেশিক রাষ্ট্রের অফিসাররা মানুষজনকে নির্দিষ্ট একটা পরিচয়ের বাক্সে বন্দি করে ফেলেছিলেন।

তিনি বলেন, দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র উপনিবেশ পরবর্তী রাষ্ট্রে গভীর নিরাপত্তাহীনতার উত্তরাধিকার হয়েছিল। আধুনিকতার যুক্তি ব্যবহার করে পাকিস্তান রাষ্ট্র আধুনিক, সংস্কারবাদী, মুক্তমনা এবং প্রোগ্রেসিভ ইসলামে পথ খুঁজতে থাকে। তারা দরগা সংস্কৃতিকে খাটো করে দেখতে থাকে, কারণ এটা কুসংস্কার, আধুনিকতার পরিপন্থী হিসেবে মনে করতে থাকে রাষ্ট্র। তাই ওয়াকফ বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্র এসব সুফি দরগাগুলোকে ‘পরিচ্ছন্ন’ করার চেষ্টা করে।

কাসমি বলেন, ওয়াকফ বিভাগ কবি এবং দার্শনিক আল্লামা ইকবালের ছেলে জাভেদ ইকবালের লেখা দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিল। জাভেদ ইকবাল নিজেও একজন দার্শনিক ছিলেন এবং লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি বলেন, জাভেদ ইকবাল নিজের লেখায় সুফি দরগার বিভিন্ন রীতির কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি এগুলোকে ‘হিন্দু প্রভাবিত’ উল্লেখ করে সুফি ইসলাম কুলষিত হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন। এখন পাকিস্তানের সব সুফি দরগার নিয়ন্ত্রণে থাকা ওয়াকফ বিভাগ সেই যুক্তি মেনেই পরিচালিত হয়। নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুন্নি ইসলাম, দেওবন্দি এবং বারেলভির মতো কিছু ঐতিহ্য বিকাশে কাজ করে তারা।

ইসলামের স্বাভাবিককরণের এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সুফি দরগায় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছে ওয়াকফ বিভাগ। সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের ধর্ম সহনশীল চরিত্র বদলে দিয়েছে উপনিবেশবাদ।

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
আফ্রিদির সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে যা বললেন বাবর
নিউজিল্যান্ড-পাকিস্তান ম্যাচসহ টিভিতে আজকের যত খেলা
এশিয়া কাপ আয়োজন করতে পারবে না ভারত-পাকিস্তান!
পাকিস্তানে রোজার মাসে ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনায় ১৯ মৃত্যু
X
Fresh