• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

‘আমি জানতাম বাবাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে’

  ২৩ নভেম্বর ২০২০, ২৩:৩৮
I knew my father would be hanged Remembering Nuremberg
আল জাজিরা থেকে নেয়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক মাস পর ১৯৪৫ সালের ২০ নভেম্বর জার্মানির নুরেমবার্গে একাধিক সামরিক বিচার শুরু হয়। এসব ট্রায়ালের প্রথমটিতে ২২ জন উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তার যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হয়। প্যালেস অব জাস্টিসে আসামিদের মধ্যে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

১৯৪৬-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত নুরেমবার্গে আরও ১২টি ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়। ওই বিচার শুরু হওয়ার ৭৫ বছর পর আমরা এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ ছাপ ফেলে যাওয়া তিনজনের গল্প শুনবো। তারা হচ্ছেন- বিচারের মুখোমুখি হওয়া একজন ছেলে, সরকারি কৌঁসুলিদের মধ্যকার একজনের ছেলে ও গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া একজনের মেয়ে।

নিকলাস ফ্র্যাঙ্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান-অধিকৃত পোল্যান্ডের গভর্নর-জেনারেল হান্স ফ্র্যাঙ্কের ছেলে। হান্স ‘পোল্যান্ডের কসাই’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লাখ লাখ ইহুদী ও পোলিশদের মৃত্যুতে তার ভূমিকার জন্য নুরেমবার্গের বিচারে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য হান্স দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।

১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণকারী নিকলাস তার বাবা যিনি উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তা ছিলেন তার সঙ্গে বেড়ে ওঠা কেমন ছিল তা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি সাত বছর বয়সে আমার বাবার সঙ্গে নুরেমবার্গের কারাগারে দেখা করেছি।

দরজার অপর প্রান্তে ছিলেন নাৎসি পার্টির একজন সিনিয়র সদস্য হার্মেন গোরিং। তিনিও নুরেমবার্গে বিচারের মুখোমুখি ছিলেন ( তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল কিন্তু মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি আত্মহত্যা করেন), তিনি তার স্ত্রী এমি এবং তাদের ছোট মেয়ে এডার সঙ্গে কথা বলছিলেন।

নিকলাস বলেন, আমি আমার মায়ের কোলে বসেছিলাম এবং আমার বাবা বড় একটি জানালার অন্য পাশে ছিলেন, যার নিচে ছোট ছোট গর্ত ছিল, যার মাধ্যমে আমরা একে অপরের কথা শুনতে পেতাম।

তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমরা শিগগিরই স্লিয়ার্সিতে (আপার বাভারিয়া) আমাদের বাড়িতে ক্রিসমাস উদযাপন করবো। আমি জানতাম যে তিনি মিথ্যা কথা বলেছিলেন। তার মিথ্যা আমার হৃদয়ে চুরমার করে দিচ্ছিল। এটাই আমার বাবার সঙ্গে শেষ দেখা।

তখনও রায় হয়নি, তবে তার আইনজীবী ১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মে আমার মায়ের সঙ্গে অনেকবার দেখা করেছিলেন এবং যা ঘটবে তার জন্য তাকে প্রস্তুত করেছিলেন। ওই গ্রীষ্ম আমার জন্য দুঃসাহসিকতায় পূর্ণ ছিল। মার্কিন সৈন্যরা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল এবং আমি মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য সিগারেটের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করতে তাদের পেছনে দৌড়াতাম।

১৯৪৫ সালের শরৎকালে আমি সংবাদপত্রে প্রথমবারের মতো লাশের স্তূপের ছবি দেখতে পাই। ওই স্তূপের মধ্যে আমার বয়সী শিশুও ছিল। আমি জানতাম যে আমার বাবা একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন; আমরা দুর্গে বাস করতাম, চাকর ছিল এবং পোল্যান্ডকে আমি আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেবেছিলাম। তারপর হঠাৎ আমি জানতে পারি যে আমার বাবার সঙ্গে এই ফটোগ্রাফগুলোর কোনোভাবে সংযোগ রয়েছে।

হান্স ফ্র্যাঙ্ক

১৯২৮ সালে জন্ম নেয়া আমার বড় ভাই নরম্যানের কথা মনে আছে, তিনি আমাদের মায়ের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, যদি এই ছবিগুলো সত্য হয় তাহলে আমাদের বাবার বেঁচে থাকার কোনও সুযোগ থাকবে না। কি ঘটছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম না, তবে ওই ছবিগুলোর সঙ্গে আমার বাবার সংযোগের বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে বিরক্ত করেছিল।

আমি জানতাম যে আমরা বিশেষ সুবিধা পেতাম, আমরা ‘সাধারণ’ মানুষ নই, তবে যুদ্ধটা আমার কাছে এতটা বাস্তব ছিল না। একবারে মনে আছে, যখন আমার বয়স চার বা পাঁচ বছর, তখন আমি বাবার কালো মার্সিডিজে বসেছিলাম এবং দেখতে পাই একটি জার্মান ট্যাংক পুড়ে গেছে। আমাদের গাড়ির চালক বলে ওঠেন, ‘ওহ এটি একটি টাইগার ট্যাংক’ এবং আমি শিহরিত হয়েছিলাম। তবে আমি কখনও কোনও খারাপ পরিস্থিতি, কোনও যুদ্ধের মুখোমুখি হয়নি। তবে যুদ্ধের শেষদিকে কেবল একবার যখন আমরা স্লিয়ারসি হ্রদে বসেছিলাম এবং মিউনিখে বোমা মারতে যাওয়া বিমানের ঝাঁক দেখেছিলাম।

আমার বাবার সঙ্গে আমার উল্লেখযোগ্য স্মৃতিগুলোর একটি হলো আমি যখন প্রায় তিন বছর বয়সী। ওই সময় আমরা বেলভেদার প্যালেসে থাকি, যেখানে আমরা মাঝে মাঝেই থাকতাম।

আমি একটি বড় গোল টেবিলের চারপাশে ঘুরছিলাম, আমার বাবার বাহুতে যেতে চাইছিলাম, তবে তিনি সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। আমার বাবা আমাকে তাচ্ছিল্য করে বলেন, তুমি কি চাও নিকি (আমার পরিবার আমাকে এভাবে সম্বোধন করতো)? তুমি আমাদের পরিবারের কেউ না। তুমি ফ্রেমডি। তিনি ফ্রেমডার বোঝাতে চেয়েছিলেন যার হচ্ছে অপরিচিত। এর মানে ছিল যে আমি অবৈধ ছিলাম, আমি তার সন্তান নই।

যখন আপনি আপনার বাবার দ্বারা এভাবে প্রত্যাখ্যাত হন তখন আপনার কাছে কেবল দুটি বিকল্প থাকে: আপনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন বা আপনি আপনার বাবার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন, অবচেতনভাবে বা ঘটনাক্রমে আমি এটাই করেছি।

গুজব অনুসারে, আমার অনুমিত জৈবিক বাবা ছিলেন গ্যালিসিয়ার গভর্নর কার্ল ল্যাশ, যিনি আমার বাবার একজন নিকটতম বন্ধু ছিলেন।

অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে হান্স ফ্র্যাঙ্ক

এসএসের প্রধান হেনরিখ হিমলার আমার বাবাকে পছন্দ করতেন না এবং তার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে চাইছিলেন। তবে এজন্য তিনি অ্যাডলফ হিটলারের অনুমতি পাননি, তাই তিনি আমার বাবার কাছের লোকদের কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করেন। ল্যাশের বাবা পোল্যান্ড থেকে চুরি করা মালামাল দিয়ে ভরপুর একটি ট্রাক জার্মানি নিয়ে যাবেন এবং হিমলার যখন এটি জানতে পারলেন তখন তিনি আমার বাবার বন্ধু ল্যাশকে গ্রেপ্তার করেন। পরে ব্রেসলাউয়ের কারাগারে ল্যাশকে হত্যা করান হিমলার।

যখন আমার বাবা এটা জানতে পারেন, তখন তিনি আমার মাকে বলেন, এখন নিকির বাবা মারা গেছে। আমার মা এই অভিযোগে শুনে খুব বিরক্ত হন এবং বাবাকে স্পষ্টভাবে বলেন যে এটি সত্য নয়।

আমার মায়ের অনেক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল, তবে ফ্রাঙ্কের সন্তান নয় এমন শিশুদের গর্ভপাত করেছিলেন তিনি। পরে আমি জানতে পারি যে তার দুটি বা তিনটি গর্ভপাত হয়েছিল। তিনি চাননি যে কোনও কিছুই তাকে ‘পোল্যান্ডের রানী’ হওয়া থেকে বিরত রাখে।

আমার মা ক্রাকো গ্যাটো গিয়ে ফার এবং দামি কাপড় কিনছেন যেগুলো দিয়ে তার ব্যক্তিগত টেইলার তাকে পোশাক বানিয়ে দিতেন। একবারের ঘটনা আমার মনে আছে যখন আমার বয়স প্রায় চার বছর তখন মায়ের সঙ্গে গ্যাটোতে গিয়েছিলাম। আমার ন্যানি হিলডের সঙ্গে আমি গাড়ির পেছনে বসেছিলাম।

গাড়ির কাছাকাছি ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে একটি ছেলে ছিল, সে খুব দুঃখ দুঃখ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে জিভ কাটলাম। সে কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চলে গেলো। আমি বিজয়ী অনুভব করলাম কিন্তু হিলডে আমাকে পেছনে টেনে আনলেন। আমরা কোথায় ছিলাম তা আমি বুঝতে পারিনি।

আমার মা খুব অনুভূতিহীন ছিল। আমার বাবার মতো তিনিও অন্যের মৃত্যু ও দুর্দশা নিয়ে চিন্তা করতেন না। তিনি কেবল অতিথিদের সঙ্গে ডিনার, শপিং করে নিজের জীবন উপভোগ করেছেন।

দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ছিলেন আমার মা। আমরা সবাই তাকে ভয় পেতাম। তার তুলনায় আমার বাবা দুর্বল ছিলেন। পরে যখন আমি মার্কিন প্রিস্ট ফাদার ও'কনোরের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম, যিনি নুরেমবার্গে কারাগারে থাকাকালীন আমার বাবাকে ক্যাথলিক গির্জায় ব্যাপটিস্ট করেছিলেন, তিনি বলেন, নিকলাস, তোমাকে আমার একটি কথা বলতে হবে: এমনকি কারাগারে থেকেও তোমার মাকে ভয় পেতেন তোমার বাবা।

মা ও বোনের সঙ্গে নিকলাস ফ্র্যাঙ্ক

যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমার বাবা তার যৌবনের সময়ের ভালোবাসাকে খুঁজে পান, যার জন্য তিনি আমার মাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি হিটলারের অনুমতি চেয়েছিলেন, আমি মনে এমনটা করতে দলের সিনিয়র সদস্যদের অনুমতি দরকার, কিন্তু যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটিকে না করতে নিষেধ করেছিলেন হিটলার। বাবার এমন ইচ্ছার কথা জানতে পেরে আমার মা হিটলারের কাছে তার এবং তার পাঁচ সন্তানের একটি ছবি পাঠিয়েছিলেন এবং জিজ্ঞাসা করছিলেন কেন একজন স্বামী এত সুন্দর পরিবার ছাড়তে চাইছেন?

১৯৪৫ সালের মে মাসে আমার বাবা গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাদের পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল। আমেরিকানরা আমাদের একটি দুই রুমের ফ্ল্যাটে স্থানান্তর করে। আমাদের কোনও চাকর বা কোনও টাকা ছিল না। এটা আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসার মতো। কিন্তু এটা আমার কাছে দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চার ছিল। আমার স্বাধীনতা ছিল, আমি মাছ ধরতে এবং এসএস সৈন্যদের ফেলে যাওয়া মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে খেলতে পারতাম।

আমার মা আমাদের জন্য খাবার জোগাড়ের বহু চেষ্টা করেছিলেন। তিনি রুটির জন্য ডিল করতেন, বিশেষ করে চুরি করা গহনার বিনিময়ে। এটি তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল, তবে তিনি কখনও হাল ছাড়েননি, কেবল কারাগারে আমার বাবাকে যে চিঠি লিখেছিলেন সেগুলোতে অভিযোগে ভরা ছিল।

তবে আমার জন্য, একজন গণহত্যাকারীর ছেলে হওয়া অনেক সুবিধা নিয়ে এসেছিল। মানুষজন বলতো, আহ বেচারা। তোমার নিষ্পাপ বেচারা বাবার কি হয়েছে? তুমি কি খেতে চাও এবং তোমার কাছে কি যথেষ্ট অর্থ আছে? কারও বাবাকে উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তা হিসেবে ফাঁসিতে ঝোলানো হলে ওই সময় জার্মানিতে কেবল এই সুবিধা পাওয়া যেতো।

বাবা ও মায়ের সঙ্গে নিকলাস ফ্র্যাঙ্ক

আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। তবে আমি খুশি যে আমার বাবা মৃত্যুর ভয় পেয়েছিলেন যা তিনি নিজে বহু নিরীহ মানুষকে দিয়েছিলেন।

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বাবা-মাকে খুঁজছে ৫ বছরের অবুঝ শিশু জুনায়েদ
নিখোঁজের ২০ বছর পর মা-বাবার কাছে ফিরলেন সন্তান 
বাবা হচ্ছেন ‘সুপারম্যান’
রাজধানীতে বাবার চড়ে ৫ বছরের শিশুর মৃত্যু
X
Fresh