• ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

ব্রিটিশ আমলে যে কারণে ভারতে নারীদের যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করা হতো

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, আরটিভি নিউজ

  ১৯ অক্টোবর ২০২০, ২০:৩৮
Why there was a law in British India to force women to undergo genital examination
সংগৃহীত

১৮৬৮ সালের কথা। ব্রিটিশশাসিত ভারতের কলকাতা শহরে সুখীমণি রাউর নামে এক নারীর কারাদণ্ড হলো। তার অপরাধ ছিল তিনি তার যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করাতে অস্বীকার করেছিলেন। তখন নিবন্ধিত যৌনকর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক একটি আইন ছিল যে তার যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করাতে হবে। খবর বিবিসি বাংলার।

সুখীমণি সেই আইন লঙ্ঘন করেছিলেন, কারণ তার দাবি ছিল- তিনি যৌনকর্মী নন। ঔপনিবেশিক ভারতে ওই আইনটির উদ্দেশ্য ছিল যৌনসম্পর্ক বাহিত রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আনা। সংক্রামক ব্যাধি আইন নামে ওই আইনের বিধান ছিল- যৌনকর্মীদের থানায় গিয়ে নিজেদেরে নিবন্ধন করাতে হবে, তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে এবং পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকতে হবে।

সুখীমণি রাউর সেই আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি আদালতে এক আবেদন করলেন তাকে মুক্তি দেবার দাবি জানিয়ে। আদালতে সুখীমণি বলেন, আমি যৌনকর্মী ছিলাম না এবং তাই আমি এক মাসে দুবার সেই পরীক্ষা করাতে যাইনি। তিনি আরও জানান যে, তিনি কখনই যৌনকর্মী ছিলেন না।

শেষ পর্যন্ত ১৮৬৯ সালের মার্চ মাসে কলকাতা হাইকোর্ট সুখীমণির পক্ষে রায় দেয়। বিচারকরা রায়ে বলেন, সুখীমণি রাউর একজন ‘নিবন্ধিত গণ যৌনকর্মী ছিলেন না’। শুধু তাই নয় আদালত বলেন, যৌনকর্মী হিসেবে নিবন্ধন হতে হবে স্বেচ্ছামূলক অর্থাৎ নিবন্ধন করানোর জন্য কারও ওপর জোর খাটানো যাবে না।

এ নিয়ে এক বিস্তারিত গবেষণার পর একটি বই লিখেছেন অধ্যাপক দুর্বা মিত্র। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ও লিঙ্গ বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপক মিত্র বলছেন, ঔপনিবেশিক যুগের দলিলপত্র ঘেঁটে তিনি দেখেছেন যে- তখন হাজার হাজার নারীকে তাদের যৌনাঙ্গ পরীক্ষার মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল।

‘ভারতের যৌনজীবন’ বা ‘ইন্ডিয়ান সেক্স লাইফ’ নামের বইটি প্রকাশ করেছে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস। এই বইটিতে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে, কিভাবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এবং ভারতের বুদ্ধিজীবীরা আধুনিক ভারতের সমাজকে নিয়ন্ত্রণ ও সংগঠিত করতে নারীদের যৌন বিচ্যুতির ধারণা গড়ে তুলেছিলেন।

ঘৃণ্য পরীক্ষা পদ্ধতি

দুর্বা মিত্র বলছেন, যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণের একটি উপায় ছিল যে নারীদের যৌনকর্মী হিসেবে দেখা হয় তাদের শ্রেণীবিভাগ, নিবন্ধন এবং ডাক্তারি পরীক্ষা করা। এর প্রতিবাদে ১৮৬৯ সালে কলকাতার কিছু যৌনকর্মী উপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের কাছে এক আবেদন পেশ করেন। তারা অভিযোগ করেন, নিবন্ধীকরণ এবং যৌনাঙ্গ পরীক্ষায় বাধ্য করার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ তাদের নারীত্বের অবমাননা করছে।

তারা এই ‘ঘৃণ্য পরীক্ষা পদ্ধতির’ প্রতিবাদ জানান, যাতে তাদের কুৎসিতভাবে দেহের গোপন অংশ দেখাতে হয়। তারা লিখেছিলেন, ‘যারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তাদেরকে ডাক্তার ও তার অধীনস্থ লোকদের কাছে নিজেদের অনাবৃত করতে হয়’ এবং ‘নারীর সম্মানবোধ তাদের মন থেকে এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি।’

কর্তৃপক্ষ খুব দ্রুতই এ আবেদন খারিজ করে দেন। কারণ শহরের ক্ষমতাধর কর্মকর্তারা বলেন, গোপন যৌনকর্মীরা যারা নিবন্ধন এড়িয়ে যাচ্ছে তারা নতুন আইনের প্রতি হুমকি হয়ে উঠেছে। কলকাতার একটি বড় হাসপাতালের প্রধান ডা. রবার্ট পেইন বলেন, বেঙ্গল প্রদেশের যৌনকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ এবং নিবন্ধনের কাজটা নারীদের সম্মতি ছাড়াই করা উচিত।

অধ্যাপক মিত্র বলছেন, ১৮৭০ থেকে ১৮৮৮ সালের মধ্যে এই আইন লঙ্ঘনের জন্য শুধু কলকাতাতেই দৈনিক ১২ জন নারীকে গ্রেপ্তার করা হতো। কর্তৃপক্ষ আরও খেয়াল করেছিলেন নজরদারির ব্যাপারটা টের পেলে অনেক নারীই শহর থেকে পালিয়ে যেতেন।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এক পর্যায়ে একটা বিতর্ক শুরু করে যে বাংলা প্রদেশের পুলিশ আইনগতভাবে যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করতে পারে কিনা - বিশেষ করে যে নারীদের বিরুদ্ধে শিশুহত্যা এবং ভ্রূণহত্যার অভিযোগ আছে।

একজন ম্যাজিস্ট্রেট যুক্তি দেন যে, যৌনাঙ্গ পরীক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে করা না হলে ধর্ষণ ও গর্ভপাতের মিথ্যা অভিযোগ বেড়ে যাবে। আরেকজন যুক্তি দেন যে, মেয়েদের সম্মতি নিতে হলে তা বিচার প্রক্রিয়াকে পঙ্গু করে দেবে।

প্রদেশের সচিবকে লেখা এক চিঠিতে কলকাতার পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ আভাস দেন যে, আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে নারীদের থেকে পুরুষদের যৌন রোগে সংক্রমিত হওয়া অব্যাহত রয়েছে।

হিজড়ারাও ছিল আইনের লক্ষ্যবস্তু

ইতিহাসবিদ জেসিকা হিঞ্চি বলছেন, ঔপনিবেশিক ভারতে শুধু যে যৌনকর্মীদেরই যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করানো হতো তা নয় বরং খোজা বা হিজড়াদেরও ১৮৭১ সালের একটি বিতর্কিত আইনের অধীনে যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করানো হতো। ওই আইনে কিছু জনগোষ্ঠীর লোককে ‘বংশানুক্রমিকভাবে অপরাধী’ বলে চিহ্নিত করা হয়।

হিঞ্চির মতে, ওই আইনটির লক্ষ্য ছিল হিজড়াদের ভারতীয় সমাজ থেকে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। এজন্য তাদের ওপর নাচগান ও মেয়েলি পোশাক পরাসহ বিভিন্ন রীতিনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা, হিজড়াদের বাড়ি থেকে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া, পুলিশ নিবন্ধন- ইত্যাদি নানা রকম নিয়মকানুন চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল।

নিম্নবর্ণের সব নারীই সম্ভাব্য যৌনকর্মী

ঔপনিবেশিক ভারতের এক লজ্জাজনক অধ্যায় বলে মনে করা হয় এই আইনকে। একজন যৌনকর্মীকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে- তার জন্য এক প্রশ্নমালা দেয়া হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও ডাক্তারদের। অধ্যাপক মিত্র বলছেন, ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ জবাব দিয়েছিল যে ‘ভারতের সব নারীই’ সম্ভাব্য যৌনকর্মী।

একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা এ এইচ জাইলস যুক্তি দেন যে, ‘উচ্চবর্ণের নয় এবং বিবাহিত নয় এমন সব নারীকেই’ যৌনকর্মী হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে। বাংলা ভাষার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং ‘বন্দেমাতরম’ গানের রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র চ্যাটার্জি তখন ছিলেন একজন মাঝারি শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন যে, ভারতে বহু ধরনের নারী গোপনে যৌনকর্মীর কাজ করেন।

অধ্যাপক মিত্র বলছেন, উচ্চবর্ণের হিন্দু ও বিবাহিত নারীদের বাইরে প্রায় সব নারীকেই তখন যৌনকর্মী বলে বিবেচনা করা হতো। এর মধ্যে তথাকথিত ড্যান্সিং গার্ল বা নাচ-গান করা মেয়ে, বিধবা, একাধিকবার বিয়ে হওয়া হিন্দু ও মুসলিম নারী, ভিক্ষুক, গৃহহীন, নারী কারখানা-শ্রমিক, গৃহকর্মী- সবাই ছিল।

১৮৮১ সালে বেঙ্গল প্রদেশে যে ঔপনিবেশিক আদমশুমারি করা হয়েছিল- তাতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের সকল অবিবাহিত নারীকেই যৌনকর্মী বলে বিবেচনা করা হয়েছিল। কলকাতা শহর ও তার আশপাশের এলাকাগুলোর আদমশুমারিতে ১ লাখ ৪৫ হাজার নারীর মধ্যে ১২ হাজার ২২৮ জনকে যৌনকর্মী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৮৯১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজারে।

অধ্যাপক মিত্র বলছেন, ওই আইনটা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন- যেখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জ্ঞানের একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় নারীদের যৌন আচার-আচরণ। অন্যদিকে পুরুষদের যৌন আচরণ রাষ্ট্রের আওতার সম্পূর্ণ বাইরে থেকে যায়।

তিনি আরও বলছেন, বাংলা প্রদেশের মতো জায়গায় নারীদের যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি ভারতীয় পুরুষরা সমাজের ব্যাপারে তাদের নিজেদের ভাবনার একটি বিশেষ দিকে পরিণত করেছিল- যা একটি-বিয়ে-করা উচ্চবর্ণের হিন্দু আদর্শ অনুযায়ী সাজানো। এখানে মুসলিম ও নিম্নবর্ণের মানুষদের ঠাঁই হয়নি।

তার কথায়, ‘বিপথগামী’ নারীরা তাদের চোখে এমন একটি সমস্যা ছিলেন যা সমাধান করা সহজ ছিল না। ফলে নানাভাবে তাদের বিচার, জেল, জোরপূর্বক দেহ পরীক্ষা ইত্যাদির শিকার হতে হতো। নারীদের ক্ষেত্রে এখন যা হচ্ছে তাতে ওই ইতিহাসেরই প্রতিধ্বনি দেখা যায়- মনে করেন অধ্যাপক দুর্বা মিত্র।

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
মিলনকে হত্যার ভয়াবহ বর্ণনা দিলেন যৌনকর্মী রোজিনা
X
Fresh