• ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
logo

ফিলিস্তিনিদেরকে কি ভুলেই গেলো আরব বিশ্ব?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, আরটিভি নিউজ

  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:২১
Did the Arab world forget the Palestinians
সংগৃহীত

এখন থেকে এমন কি ১০ বছর আগেও যদি কোনও ইসরায়েলি সরকার অধিকৃত পশ্চিম তীরের এক চিলতে জমি অধিগ্রহণের ঘোষণা দিতো, আরব বিশ্বের ২২টি দেশেই প্রতিবাদের ঝড় উঠতো।

কিন্তু জুন মাসে যখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পশ্চিম তীরের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চল জর্ডান উপত্যকার বিশাল একটি অংশকে নিজের দেশের অংশ করে নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, আরব দুনিয়ায় তেমন কোন উচ্চবাচ্যই শোনা যায়নি।

ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র তৈরির শেষ সম্ভাবনাও নস্যাৎ হয়ে যাবে- ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে বারবার এই আশঙ্কা জানানো হলেও সৌদি আরব এবং তার আরব মিত্ররা মৌনব্রত পালন করছে। তারপর দুইমাস না যেতেই দুটি উপসাগরীয় আরব রাজতন্ত্র ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং বাহরাইন মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে গিয়ে চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেদিনই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে নিয়ে দাবি করেন যে, আরও অন্তত পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

হতাশ, ক্রুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা দেখছে যে গত অর্ধশতাব্দী ধরে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ঘুচিয়ে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রতি পুরো আরব বিশ্বের যে ঐক্যবদ্ধ সমর্থন, তাতে ফাটল ধরতে শুরু করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির বিশ্লেষকদের মধ্যে এখন আর তেমন কোনও সন্দেহ নেই যে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা-সংগ্রাম এখন আরব বিশ্বের অনেকগুলো দেশে অগ্রাধিকারের তালিকায় ক্রমশ নিচে নামছে।

সৌদি আরবের ইরান আতঙ্ক

আরব বসন্তের ধাক্কা, সিরিয়া-লিবিয়া-ইয়েমেন-ইরাকে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের হুমকি, তেলের দাম পড়ে যাওয়া- এসব কারণে অনেক আরব সরকার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে এখন এতটাই ব্যতিব্যস্ত যে ফিলিস্তিন ইস্যু তাদের কাছে এখন আর বড় কোনও এজেন্ডা নয়। সেই সাথে যোগ হয়েছে ইরান নিয়ে জুজুর ভয়।

বিবিসি আরবি সংবাদ বিভাগের সিনিয়র নিউজ এডিটর মোহামেদ এয়াহিয়া মনে করছেন, সৌদি আরব এবং আরও কিছু উপসাগরীয় দেশের মধ্যে ইরানভীতি এখন এতটাই প্রবল যে ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে তারা তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে দেখছে।

বিবিসি বাংলাকে এয়াহিয়া জানান, ইরান এখন তাদের অভিন্ন শত্রু। ফলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ১৮ বছর আগে ‘আরব ইনিশিয়েটিভ’ নামে সৌদি যে উদ্যোগ ইসরায়েলের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল, তা এখন অনেক দুর্বল।

প্রয়াত সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ'র উদ্যোগে ২০০২ সালে ২২টি আরব দেশ একযোগে ঘোষণা দেয় যে যতক্ষণ না ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা ফিলিস্তিনি জমি ছেড়ে দিয়ে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে নিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করতে দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।

মোহামেদ এয়াহিয়া বলেন, সৌদি আরব নিজেরাই তাদের সেই উদ্যোগকে দুর্বল করে দিয়েছে।

তার প্রথম প্রকাশ্য ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন ২০১৮ সালের এপ্রিলে যখন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে মার্কিন ইহুদি নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে খোলাখুলি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কড় সমালোচনা করে বলেন, দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের নমনীয় হতে হবে।

ওই বৈঠক নিয়ে সে সময়কার বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্টে লেখা হয়, যুবরাজ বিন সালমান খোলাখুলি বলেন, ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধান সৌদি আরব চায়, কিন্তু ‘ইরানের মোকাবেলা এখন তাদের কাছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার।’

এয়াহিয়া বলেন, ইসলামী বিশ্বে নেতৃত্ব ধরে রাখার বিবেচনায় সৌদি আরব নিজে হয়তো এখন ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সময় নিচ্ছে, কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে সৌদিদের অনুমোদন ছাড়া ইউএই এবং বাহরাইন ইসরায়েলের সাথে এই চুক্তি করতো না।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং মুসলিম দুনিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে আরব দেশগুলো এখন কয়েকটি গ্রুপে জোটবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা ইসরায়েলকে তার রাজনৈতিক ইচ্ছা হাসিলে অনেক সুবিধা করে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সান-ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ আহমেদ কুরু বিবিসিকে বলেন, আরব দেশগুলোর মধ্যে এখন যে বিভক্তি এবং বিরোধ তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর দেখা যায়নি।

তিনি বলেন, কয়েকটি ব্লকে তারা ভাগ হয়ে গেছে। একটি প্রভাব বলয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে রয়েছে ইউএই, ইরান-ইরাক-সিরিয়া একদিকে, আবার কাতার যোগ দিয়েছে তুরস্কের সঙ্গে।

ড. কুরু বলেন, এই বিভেদকে পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে ইসরায়েল। গত প্রায় বছর দশেক ধরে আস্তে আস্তে ফিলিস্তিুনি ইস্যু খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।

সেই সঙ্গে ইসরায়েলের পক্ষে হোয়াইট হাউজের বর্তমান প্রশাসনের পুরোপুরি একপেশে আচরণে ফিলিস্তিনিরা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অভাব-অভিযোগ নিয়ে দ্বারস্থ হবে, আরব দুনিয়ায় তাদের এমন মিত্রের সংখ্যা কমছে।

ফিলিস্তিন নিয়ে আবেগে ভাটা

কিন্তু ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব বিশ্বের সাধারণ জনগণের মনোভাব এখন কী? লন্ডনে গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ এল-দাহশান বিবিসি বাংলাকে বলেন, কোনও সন্দেহ নেই যে এক সময় ফিলিস্তিনি ইস্যুতে আরব দেশগুলোর রাস্তায় যতটা আবেগ চোখে পড়তো, এখন ততটা নেই।

একটি কারণ, তার মতে, আরব দেশগুলোকে নতুন একটি প্রজন্মের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের ইতিহাসের প্রত্যক্ষ কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ফলে, তাদের বাবা-দাদাদের ফিলিস্তিন নিয়ে যতটা আবেগ আছে, তাদের মধ্যে ততটা নেই।

তিনি বলেন, কিন্তু তাই বলে আবেগ পুরোপুরি চলে যাচ্ছে, তা কোনোভাবেই তা বলা যাবে না। আপনি যদি এখনও আমার জন্মস্থান মিশরে যান, দেখতে পাবেন ছোটো একটি শহরে হয়ত স্থানীয় কোনও ইস্যুতে মানুষজন জড় হয়ে প্রতিবাদ করছে এবং তাদের কয়েকজনের হাতে ফিলিস্তিনি পতাকা। ওই জমায়েতের সাথে ফিলিস্তিনের কোনও সম্পর্কই হয়ত নেই, কিন্তু তাদের হাতে সেই পতাকা।

মোহাম্মদ এল-দাহশান বলেন, অধিকাংশ আরব দেশে মানুষজন তাদের রাজনৈতিক মতামত দিতে পারে না। ফলে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে তারা কী ভাবছে, তা শতভাগ বোঝা সম্ভব নয়।

মিশর ও জর্ডানের অভিজ্ঞতা

এল-দাহশান মনে করেন, একের পর এক আরব সরকার যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করছে, কিন্তু সেই সম্পর্ক কতটা অর্থপূর্ণ হবে তা শেষ পর্যন্ত সেসব দেশের জনগণের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে।

তিনি মিশর এবং জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসের উদাহরণ টেনে বলেন, গত কয়েক দশক ওই সম্পর্ক শুধু দুই সরকারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।

এল-দাহশান বলেন, ৪০ বছর আগে মিশর এবং ৩০ বছর আগে জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের একই ধরনের চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু এতদিনেও এই দুই দেশের মানুষের সঙ্গে ইসরায়েলের বা ইসরায়েলি জনগণের কোনও সম্পর্ক হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ইউএই বা বাহরাইনের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যদি ইসরায়েলের সম্পর্ক তৈরি না হয়, তাহলে তা শুধু দুই দেশের মধ্যে দূতাবাস স্থাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে যাবে।

এল-দাহশান মনে করেন, তেমন অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে ফিলিস্তিনি সংকটের সমাধান এখনও গুরুত্বপূর্ণ।

ফিলিস্তিনিদের সামনে রাস্তা কী?

প্রশ্ন হচ্ছে, এল-দাহশান যেমনটি বলছেন সে ধরনের পরোক্ষ চাপের ভরসায় কি ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব অপেক্ষা করবে? বিবিসি আরবি বিভাগের মোহামেদ এয়াহিয়া মনে করেন, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সামনে এই মুহূর্তে বিকল্প খুব সামান্যই।

ওয়াশিংটনে গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের গবেষক ওমর এইচ রহমান ওই প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক প্রকাশনায় লিখেছেন, এই পুরো পরিস্থিতির জন্য ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দের দুর্বল নেতৃত্ব বহুলাংশে দায়ী।

তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন গত দুইবছর ধরে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নস্যাৎ করতে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন, তখন ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব বিকল্প কোনো প্রস্তাব-পরিকল্পনা হাজির না করে, বন্ধু তৈরির চেষ্টা না করে, পুরনো বস্তাপচা স্লোগান দিয়ে চলেছে।

রহমান মনে করেন, মাহমুদ আব্বাস রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে সবসময় ইসরায়েল এবং আমেরিকার ‘শুভ বুদ্ধির উদয়ের’ জন্য অপেক্ষা করেছেন এবং তার ফলে ধীরে ধীরে এখন অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন।

তাহলে কি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনা চিরতরে শেষ? মোহাম্মদ এল-দাহশান, যিনি নিজে জাতিসংঘে চাকরির সূত্রে দীর্ঘদিন পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েলে ছিলেন, মনে করেন যে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বপ্ন ফিলিস্তিনিরাও বেশ কিছুদিন ধরেই আর দেখছেন না।

তিনি বলেন, পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে এখনও নতুন নতুন ইহুদি বসতি তৈরি হচ্ছে। ওই সব বসতিতে ইহুদি জনসংখ্যা আট লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ওই সব বসতি রক্ষার নামে ফিলিস্তিনি জনবসতির মধ্যে দেয়ালে পর দেয়াল উঠেছে। গাজা ভূখণ্ড এখন একটি কারাগার। ফলে ফিলিস্তিনিরা বুঝে গেছে রাষ্ট্র গঠন আর সম্ভব নয়।

তাহলে তারা এখন কী করবে?

এল-দাহশান বলেন, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব এখনও মুখে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাতিল করে দেননি। কিন্তু বিপুল সংখ্যায় সাধারণ ফিলিস্তিনিরা এখন মনে করছেন যে তাদের সামনে এখন একটাই বিকল্প, আর তা হলো- নিজেদের রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাদ দিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রে সমান অধিকারের দাবি তোলা।

তিনি বলেন, আমি মনে করি নেতারাও ভেতরে ভেতরে ভাবছেন তাদের সামনে হয়তো আর কোনও বিকল্প রাস্তা নেই; সুতরাং বল এখন ইসরায়েলের হাতে। ইসরায়েলকেই হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কি গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনে সম্মতি দেবে, নাকি ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েল রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার দেবে।

আরও পড়ুন: কাতার-সৌদি সঙ্কটের মধ্যস্থতায় আগ্রহী রাশিয়া

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
ইইউর নিষেধাজ্ঞার কবলে ইসরায়েলি চার ব্যক্তি ও দুই সংস্থা
ইসরায়েলি হামলায় ২৪ ঘণ্টায় ৬৩ ফিলিস্তিনি নিহত
জাতীয় ঈদগাহে ফিলিস্তিনি‌দের জন্য দোয়া
ঈদের আগেও অনাহারে বহু ফিলিস্তিনি
X
Fresh