• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

করোনা মহামারিতে ঢাকা ওয়াসা গ্রাহকবান্ধব

  ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০১
ঢাকা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান

পানির অপর নাম জীবন। নিত্যদিনের খাবার না খেয়ে মানুষ কিছুদিন বাঁচলেও পানি পান না ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়। শরীর সচল রাখা ও শারীরিক ফিটনেস অর্জনে খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণ পানি থাকতেই হবে। আর ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি মানুষের পানির যোগান দিচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। করোনা মহামারির এ সময়ে দৈনিক পানি সরবরাহের সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনের কর্ম পরিকল্পনা সাজানোর নিয়ে আরটিভি নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। পাঁচ পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষ পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক আলম।

আরটিভি নিউজ করোনা মহামারিতে গ্রাহকদের পানি সরবরাহে ঢাকা ওয়াসা কোন পরিকল্পনায় এগিয়েছে?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : বিশ্বজুড়ে আজ করোনা মহামারি চলছে। আমাদের দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ যখন করোনা রোগী শনাক্ত ও মারা গেলেন তখন সব মানুষ ছিলেন আতঙ্কে। ঢাকা ওয়াসার পানি নিরবিচ্ছিন্নভাবে সরবরাহের জন্য ৯ মার্চ থেকে আমরা একটা সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম হাতে নিলাম। কারণ আমরা জানি, ঢাকা ওয়াসা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে প্রায় দুই কোটি মানুষের সেবার বিষয় জড়িত। তাই সব কিছু বন্ধ থাকলেও ঢাকা ওয়াসা সেবা বন্ধ করতে পারবে না। তখন আমাদের স্টাফদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করলাম যে লকডাউন হলেও আমাদের অফিসে আসতে হবে, কাজ করতে হবে। ২০২০ সালের ২৬ মার্চ সরকার যখন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করল তখনও ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। খুব ভালোভাবে আমরা আমাদের সার্ভিস দিয়ে যেতে পেরেছি। কোনো সমস্যা হয়নি। এক দিনের জন্যও কাজ বন্ধ হয়নি।

আরটিভি নিউজ : করোনা মহামারি থেকে সুরক্ষা পেতে ঘন ঘন হাত ধোয়ার প্রয়োজন। এতে পানির চাহিদা বেড়ে যায়। ঢাকা ওয়াসা সেই পানির চাহিদা পূরণে কী করেছে?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘন ঘন হাত ধুলে পানি ব্যবস্থাপনায় কোনো সমস্যা হবে না। কারণ ঢাকা ওয়াসার ৪টা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট সম্পূণরূপে চালু রাখা হয়েছে। পাম্প স্টেশন যেগুলো ভূগর্ভস্থ পানি নির্গমণ করে সেগুলোও চালু রাখা হয়। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও ঢাকা ওয়াসা অত্যাবশ্যকীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বিধায় আমরা আমাদের কাজ চলমান রেখেছি। নগরবাসীর নিরবচ্ছিন্ন পানি ও পয়ঃসেবাকে সমুন্নত রাখার জন্য ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন বিভাগ তাদের কাজ চালিয়ে যায়।

আরটিভি নিউজ : করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিতে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন কিনা?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : আমাদের প্রায় চার হাজার কর্মীর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক। যারা পজিটিভ হয়েছেন তাদের সব সময় খোঁজখবর নেওয়াসহ সব ধরনের সহায়তার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা শহর ঘনবসতিপূর্ণ শহর হওয়ায় করোনার ভয় ছিল এখানেই বেশি। করোনার মধ্যে কোনো মানুষ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয়নি। করোনার সংক্রমণ যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সরকার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন ঘোষণা করে। করোনার ভয়াবহ আতঙ্ক ও লকডাউনের মধ্যেও ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্রাহকদের নিরলসভাবে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রেখেছে। করোনার মধ্যে কোনো এলাকায় পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন কিংবা গ্রাহকের নতুন সংযোগের প্রয়োজন হলে মানুষ ঘরে বসে থেকে ঢাকা ওয়াসার জরুরি ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করা মাত্রই সেখানে ওয়াসার কর্মচারীরা পৌঁছে যেতেন। করোনা মহামারির মধ্যেও ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছেন। এই করোনার সময় ভালো থাকাটাই তো বড় কথা।

আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসার ফের পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে কী?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসায় পানি সংকটের সমস্যা সমাধান হয়েছে। এখন সংস্থাটির বিভিন্ন উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে। ওয়াসা এমন একটি সংস্থা যা কিনা নিজেদের সক্ষমতার পাশপাশি গ্রাহকদের বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়েও চিন্তা করে। সেখান থেকে আগামীতে এলাকাভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা রয়েছে ঢাকা ওয়াসার। নিম্ন আয়ের মানুষের পানির দাম আর বাড়বে না, কমানো হয়তো সম্ভব হবে না, কিন্তু অন্যান্য জায়গায় পানির দাম বাড়বে। নিম্ন আয়ের মানুষ সময় মতো বিল পরিশোধ করায় তাদের আমরা সন্মানিত করেছি। তবে দুঃখজনক হচ্ছে- আমরা যারা অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিকভাবে ভালো এবং ব্যয়বহুল এলাকায় বসবাস করছি তারাও যে টাকায় পানি পাচ্ছেন, ঠিক একই টাকায় নিম্ন আয়ের মানুষও পানি পাচ্ছে। এটা উচিত না। এই শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি যাদের টাকার কোনো অভাব নেই, তাদের ৭০ লাখ টাকা বিল বাকি থাকে কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের কারও ১০০ টাকাও বাকি নেই। ঢাকা ওয়াসা পানির উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম দামে পানি দিচ্ছে। বাকিটা সরকার আমাদের ভর্তুকি দিচ্ছে। সরকারের এই ভর্তুকির অর্থ ধনীক শ্রেণির মানুষ পাচ্ছেন, সেটা পাওয়া উচিত না। ঢাকা ওয়াসা এখন চিন্তা ভাবনা করছে সরকারের ভর্তুকির অর্থ নিম্ন শ্রেণির মানুষ পেলেও যাতে ধনীক শ্রেণির মানুষ কম পায় সেজন্য এলাকাভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণ করবে। এব্যাপারে সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছি যাতে করে নিম্ন আয়ের মানুষ পানি ব্যবহারে অর্থ সাশ্রয় পান।

আরটিভি নিউজ : এলাকাভিত্তিক পানির দাম বাড়ালে ওয়াসার কী লাভ?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : অভিজাত এলাকা গুলশানের বাসা ভাড়া আর খিলগাঁওয়ের বাসা ভাড়া এক নয়। দুই এলাকায় পানির দাম একই। এটা যৌক্তিক নয়। যারা পানি বেশি খরচ করেন, তারা বিলাসি জীবনযাপন করেন। অপচয়ও করেন বেশি। ওই পর্যায়ে পানির দামও রাখা হবে বেশি। এ সিস্টেম চালু হলে পানিতে ভর্তুকিও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ঢাকা ওয়াসা দিনে দিনে সফলতার দিকে যাচ্ছে, সেদিক থেকে সংস্থাটি মনে করছে, ভর্তুকি দিয়ে কোনো সংস্থা দীর্ঘমেয়াদে টিকতে পারে না। এখন হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ২৭ টাকা। বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। এলাকাভিত্তিক পানির দাম বাড়ালে আশা করা হচ্ছে এই ভর্তুকি কমে আসবে।

আরটিভি নিউজ : ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি কতটুকু সফলতা পেয়েছেন?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসার মূল লক্ষ্য পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখী পানি ব্যবস্থাপনা। এ লক্ষ্য ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচির আওতায় নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখন ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচির মধ্যদিয়ে প্রায় শতভাগ সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি গ্রহণের পরে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই কর্মসূচি নিয়ে মানুষ ঠাট্টা করেছেন। ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি প্রথমে ঢাকা ওয়াসায় ইউনিয়ন সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সব কর্মসূচি তাদের পছন্দ হয়নি। তখন কিছু কিছু কর্মকর্তা ঠাট্টা করা শুরু করলেন, স্যার এমন ঘুরে দাঁড়াইয়েন না, আমরা আওয়ামী লীগ সব বিএনপি হয়ে যাবু? আবার অনেকে বলেছেন যে, স্যার এমন বেশি ঘুরিয়েন না, যেন চিত হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। চিত হয়ে পড়ে যাওয়া অর্থ তারা বুঝিয়েছেন- ঢাকা ওয়াসায় যা ছিল এই কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে তাও নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। যেকোনো পজিটিভ কর্মসূচি হাতে নিয়ে অনেকে তা নেগেটিভ মনে করেন। যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দিলেন তখনও অনেক মানুষ ঠাট্টা করেছেন। আজকে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রকোপ চলছে। বাংলাদেশের অনেক মানুষ আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের কারণে বাড়িতে বসে অফিস করতে পারছেন। অনলাইনে যোগাযোগ করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে ঢাকা ওয়াসাকে ডিজিটাল ওয়াসা বানানো হবে।

আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসার মিটার রিডার ব্যবস্থা কেমন?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসার কিছু রাজস্ব পরিদর্শক (মিটার রিডার) মিটার রিডার ঘুরে মাসিক বিল কমিয়ে দিয়ে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন। কিভাবে তারা মিটার রিডার ঘুরিয়ে পানির বিল কমাতেন সেই কৌশল জানার পর ওয়াসার পুরোন মিটার পরিবর্তন করা হয়। আগের মিটারের তুলনায় বর্তমানে ওয়াসার মিটার গুণগতমান ভাল। এখন যেসব মিটার রয়েছে, সেগুলো আর ঘুরিয়ে মিটার রিডার কমাতে পারেন না রাজস্ব পরিদর্শকরা। গ্রাহক যতটুকু পানি ব্যবহার করবেন ততটুকু বিল পরিশোধ করেন। তবে পুরনো মিটার নিয়ে অনেক সময় অভিযোগ আসতো যে মিটার রিডাররা যে মাসোহারা আদায় করেন, তার একটি বড় অংশ চলে যায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পকেটে। একারণেই অনিয়ম ও দুর্নীতি সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতো। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসায় যেসব মিটার রয়েছে সেগুলো আর ঘুরিয়ে বিল করার কোনো সুযোগ নেই। এতে একদিকে গ্রাহকদের হয়রানি বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার সুনাম বাড়ছে। একই সঙ্গে ওয়াসার রাজস্ব কয়েকগুণ বেড়েছে।

আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসা পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করেছে। ইতোমধ্যে পানির ক্ষেত্রে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হয়েছে। শতভাগ মানুষকে পানি দিতে পারছি। মাস্টারপ্ল্যান ২০৩৫ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করেছি। আর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ২০৫০ সাল পর্যন্ত মাস্টারপ্ল্যানে রয়েছে। ঢাকা ওয়াসার রোড ম্যাপ পরিষ্কার। সরকারের একটি করপোরেট ম্যানেজমেন্ট ও বাণিজ্যিক সংস্থা। এ সংস্থার রয়েছে অত্যন্ত প্রগতিশীল একটি আইন। এ আইনের মাধ্যমে কাজ করলে আমাদের কেউ কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পারে না।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রকৌশলী তাকসিম এ খান ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনার পরিচালকের দায়িত্ব পান। এরপর থেকে একটানা ষষ্ঠবারের মতো তার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে আরও তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান প্রকৌশলী তাকসিম এ খান।

এফএ

মন্তব্য করুন

daraz
  • এক্সক্লুসিভ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh