‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’
আশির দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রচার হতো হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিনরাত্রি’। দেশে তখন একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভি। নাটক শুরুর সময় দেখা যেত রাস্তাঘাট সব ফাঁকা। লোকজন সব ভিড় জমিয়েছেন টিভি সেটের সামনে। যাদের বাড়িতে টিভি নেই, তারা ভিড় জমাতেন পাশের বাড়িতে।
‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকের শফিক চরিত্রে বুলবুল আহমেদ, রফিক চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর আর নীলু ভাবী চরিত্রে ডলি জহুর তখন সবার কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। ছোট্ট টুনির মৃত্যুর মাধ্যমে ধারাবাহিকটি শেষ করেন হুমায়ূন আহমেদ। পরদিনই প্রেসক্লাবের সামনে টানানো হলো ব্যানার ‘টুনির কেন মৃত্যু হলো, হুমায়ূন আহমেদ জবাব চাই’।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্রের জন্য রাজপথে মিছিল করার মতো ঘটনা তো একাধিকবার দেখা গেছে। ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ স্লোগানের মিছিলটি কোনো রাজনৈতিক দলের ছিল না। হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’র প্রধান চরিত্র বাকের ভাইকে ফাঁসি না দেওয়ার দাবি জানিয়ে এই স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে হুমায়ূন আহমেদ লিখেন ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’। এ নাটকের প্রধান চরিত্র বাকের ভাইকে বাঁচানোর দাবিতে মিছিল, দেয়াল লিখন ও সমাবেশ হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত গল্পের যবনিকা টানতে গিয়ে বাকের ভাইকে ঝুলতে হলো ফাঁসিতে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি এখনো মেনে নিতে পারেননি অনেকে।
একটি টিভি নাটক নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে, তার দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাকের ভাই চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর এখনো মানুষের মুখে মুখে বিচরণ করছেন। আসাদুজ্জামান নূর বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী। এখনো তিনি কোনো অনুষ্ঠানে গেলে তাকে বাকের ভাই বলেই ডাকা হয়। কোনো নাটকের চরিত্র যে কতটা জনপ্রিয় হতে পারে সেটা হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন।
‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটি প্রচারের প্রায় দুই দশক পর আসাদুজ্জামান নূর যখন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হলেন, তখন বাকের ভাইয়ের নাম ধরেই নীলফামারীতে ভোট চাওয়া হয়েছে। চরিত্র সৃষ্টিতে এমনই এক নিপুণ কারিগর ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। একইভাবে হুমায়ূন আহমেদের অয়োময়, বহুব্রীহি ও আজ রবিবার নিয়ে প্রবল আবেগ রয়েছে মানুষের মাঝে।
টিভি চ্যানেলের ঈদ আয়োজন কিংবা দৈনিক পত্রিকার ঈদ সংখ্যা যেন তাকে ছাড়া চলতোই না। চাঁদ রাতে সপরিবারে হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখতে বসা যেন প্রতি বছরের ঈদের নির্মল আনন্দের নিত্য ঘটনা। একইসঙ্গে ঈদ সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস। সব মিলিয়ে ঈদের আনন্দে লাখো মানুষকে ভাসিয়েছেন যাদুকর হুমায়ূন আহমেদ।
১৯৯৫ সাল থেকে বিটিভিতে ব্যক্তি উদ্যোগে নির্মিত প্যাকেজ অনুষ্ঠান প্রচারের সুযোগ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে দেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠেন নির্মাতা-পরিচালক। দেশের টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে— কে কত বেশি হুমায়ূন আহমেদের নাটক প্রচার করতে পারে। প্রতি ঈদেই দেশের শীর্ষ টিভি চ্যানেলগুলো তাদের প্রাইম টাইম ঠিক করে রাখে হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত নাটক প্রচারের জন্য।
ধারাবাহিকের পাশাপাশি একদিন হঠাৎ, খাদক, অন্যভুবন, অচিনবৃক্ষ, খোয়াব নগর, জোছনার ফুল, আজিজ সাহেবের পাপ, আমরা তিনজন, ভূত বিলাস, বুয়া বিলাস, এই বৈশাখে, চৈত্রদিনের গান, নাট্যকার হামিদ সাহেবের একদিন, পক্ষীরাজ, জুতা বাবা, তারা তিনজন-টি মাস্টার, তৃষ্ণা, রূপালী রাত্রি, মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম, বাদল দিনের প্রথম কদমফুল, ঘটনা সামান্য, চেরাগের দৈত্য, বৃক্ষমানব, এই বসন্তে’সহ অসংখ্য খণ্ড নাটক তৈরি করেছেন তিনি।
পিআর/সি
মন্তব্য করুন