• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
logo

এখনকার ছবিগুলো টানে না : ববিতা

আরটিভি অনলাইন রিপোর্ট

  ১৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:৪০

বড়বোন সুচন্দার অনুপ্রেরণায়ই চলচ্চিত্রে আসা ববিতার। ১৯৬৮ সালে প্রয়াত চলচ্চিত্রনির্মাতা জহির রায়হানের ‘সংসার’ নামক সেই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যাত্রা শুরুর পর নিজেকে একজন গুণী অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে। প্রখ্যাত নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। কাজ করেছেন দেশ-বিদেশের অনেক গুণী অভিনেতার সঙ্গে।

চার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করা এ অভিনেত্রী সর্বপ্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর আরো অনেকবার এ পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ঢাকাই চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী এ অভিনেত্রী এখন অভিনয় করছেন খুবই কম। বেশি সময় কাটে কানাডায় পড়াশোনারত পুত্র অনিকের কাছে। তাহলে জানা যাক এ সময়ের চলচ্চিত্র নিয়ে ববিতার ভাবনা।

কেমন আছেন ...

আলহামদুলিল্লাহ। শারীরিকভাবে খুব ভালো আছি। মনটা ভালো নেই। প্রিয় মাতৃভূমিকে খামচে ধরেছে মৌলবাদের শকুন। মানুষের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। দেশটা কবে স্থিতিশীল হবে কে জানে। আল্লাহ যেন সবাইকে রক্ষা করেন, এই দেশকে রক্ষা করেন।

ছোটবেলায় নায়িকা হওয়ার ইচ্ছে ছিল ...

না না। একদমই নায়িকা হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। আমার মা ছিলেন ডাক্তার। আমি তার সহকারি হিসেবে টুকটাক কাজ করতাম। তখন ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবো। আমার বড় বোন সুচন্দা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন। তার সঙ্গে শুটিং দেখতে একবার কক্সবাজার গিয়েছিলাম। শুটিং দেখে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। গরমে রোদের মধ্যে তারপর পানিতে ভিজে বারবার শট দিচ্ছিলেন বুজি। আমি দূর থেকে ওসব দেখে খুব রেগে যাচ্ছিলাম। মনে মনে বলছিলাম এত ঝামেলা পোহায়ে কেউ এমন করে ছবিতে কাজ করে! আমি কখনোই এমনটা করব না।

তবুও চলচ্চিত্রে এলেন এবং ইতিহাস করে দিলেন। কীভাবে আগমন ...

পরের ঘটনাটা অনেক মজার। আমার দুলাভাই মানে সুচন্দা আপার স্বামী প্রয়াত বিখ্যাত নির্মাতা জহির রায়হান তার ‘সংসার’ ছবির জন্য অল্পবয়সী মেয়ে খুঁজছিলেন। তিনি আমাকে ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব দেন। আমি রাজি ছিলাম না। তারপর মা-বোনসহ পরিবারের সবাই খুব করে বোঝালেন। উপায় না পেয়ে রাজি হয়েছিলাম। ছবিতে রাজ্জাক ভাই আমার বাবা, সুচন্দা বুজি মা ছিলেন।

এরপর আড়াই বছর কেটে যায়। পরে জহির ভাই আবারো তার নতুন ছবির জন্য শবনম আপাকে অভিনয় করাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তার শিডিউল পেতে বেগ পেতে হয়। ছবির নাম ছিল ‘জ্বলতে সুরজ কি নিচে’। সে ছবির প্রযোজক বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান আফজাল চৌধুরী বললেন, ‘এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? তোমার ঘরেই তো নায়িকা আছে’। তিনি আসলে আমার কথাই বলছিলেন। জহির ভাই যখন বললেন না করে দিলাম। আগের মতোই মা-বোন বোঝাতে লাগলেন, ‘এই ছবিতে নায়িকা হবে, নাদিমের সঙ্গে অভিনয় করবে। করো।’ বললাম, এক শর্তে করতে পারি। এটাই হবে শেষ! কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ছবির কাজ শেষ হয়নি। এরপর জহির ভাই আমাকে নায়িকা করে রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আরো একটি ছবির নাম পরিকল্পনা করেন। ছবিটি করতে গিয়ে খুব অসুবিধায় পড়েছিলাম। কারণ আগের ছবিতে রাজ্জাক ভাই ছিলেন আমার বাবার চরিত্রে। তার সঙ্গে প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে নিজের কাছে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। ওই ছবিটা হিট হয়। খ্যাতি চলে আসল। সবাই প্রশংসা করছে অভিনয়ের। আমিও এই শিল্পের প্রতি দুর্বল হয়ে গেলাম। পরের গল্প সবার জানা।

ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল কোন ছবি ...

আমি অভিনয় করেছি চার শতাধিক ছবিতে। সবগুলো চলচ্চিত্রই আমার টার্নিং পয়েন্ট। কেননা, একটি না হলে অন্যটি হতো না। তবে আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার, উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রের অহংকার সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনী সংকেত’ ছবিটি। এই ছবিটি সারাবিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে আমাকে পরিচিতি দিয়েছে। এছাড়া আমাদের দেশের ‘মাইলস্টোন’,‘গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমণি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘আলোর মিছিল’, ‘বাদী থেকে বেগম’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘দহন’ ইত্যাদি ছবিও আমাকে ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে বলে মনে করি আমি।

অভিনেত্রী হিসেবে এই সাফল্যের মূলমন্ত্র কি ...

ধৈর্য-সততা-পরিশ্রম আর অভিনয়কে ভালোবাসা। অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে মূল্যায়ন ও শ্রদ্ধা করা। আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি, সততার সঙ্গে কাজ করেছি, পরিশ্রম করেছি। এছাড়া চরিত্র নিয়ে আমাকে অনেক সাধনা করতে হয়েছে। এমনও হয়েছে, প্রযোজকের আর্থিক দিক বিবেচনা করে আমি অনেক সুপারহিট ছবিতে কাজ করেছি কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক নেইনি। সবসময় নিজের চরিত্রটাকে প্রাধান্য দিয়েছি। কোনো সময় পারিশ্রমিক নিয়ে ভাবিনি। যে চরিত্রে কাজ করে দর্শককে মুগ্ধ করতে পারব বলে ধারণা করেছি, সেই চরিত্রের জন্য টাকা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। অভিনয় আমার পেশা। অবশ্যই এখানে আমাকে রোজগার করতে হবে। খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার সাথে মূল্যও বাড়াতে হবে। তবুও এটা একটি শিল্প। শিল্পী হিসেবে নিজের মনের কিছু খোরাক থাকে। সেই খোরাক মেটায় এমন চরিত্রের জন্য কম্প্রোমাইজ করতেই হবে।

পছন্দের নায়ক কে ...

আমি বিভিন্ন দেশের অনেক বড় বড় অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি। সবার সঙ্গে কাজ করেই ভালো লেগেছে। কেউ কেউ আমাকে গর্বিতও করেছেন। আমাদের নায়করাজ রাজ্জাক ভাই, ফারুক, সোহেল রানাসহ আরো অনেকের অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব আমাকে আজো মুগ্ধ করে রেখেছে। ভারতের সৌমিত্র দা’র মতো নায়কের সঙ্গেও আমি কাজ করেছি। তাকে নিয়ে বলার নতুন কিছু নেই। তবে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আমার স্বপ্নের বা পছন্দের নায়ক ছিল জাফর ইকবাল। কারণ তার কিছু জিনিস আমাকে একটু বেশিই মুগ্ধ করত। সে যেমন সুদর্শন ছিল, তেমনি ছিল তার অভিনয়ের সাবলীলতা, কণ্ঠ, ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন সচেতনতা, রুচিবোধ। জাফর ইকবাল খুব ভালো ইংলিশ গান গাইতে পারত। গিটার বাজিয়ে ওর মুখে ইংলিশ গান শোনাটা আমাদের সময়কার যে কোনো মেয়ের জন্য স্বপ্নের একটি মুহূর্ত। আমি বলব, ওর মতো সম্পূর্ণ কোনো নায়ক আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আসেনি। সব্যসাচী ছিল ও। জাফর ইকবালের অকালপ্রয়াণ আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করেছে।

এখনকার ছবিগুলো দেখা হয় ...

না, খুব বেশি দেখা হয় না। টানে না। এত সমালোচনা শুনি আর ইচ্ছে করে না। আসলে সব যুগের কাজ নিয়েই সমালোচনা হতো, হয়েছে। তবে পাশাপাশি আলোচনাটাও ছিল। কিন্তু আমাদের এখানে সমালোচনাটাই একতরফাভাবে হয়। তার মানে বুঝতে হবে এবং চলচ্চিত্রের মানুষদের এটা মানতেও হবে, আলোচিত হবার মতো চলচ্চিত্র তারা নির্মাণ করতে পারছেন না।

রাজ্জাক-ববিতাকে ছবিতে মা-বাবা করে জুটি বানালেই ছবির গল্প ভালো হয়ে যাবে না। মানুষকে তার জীবনের গল্প উপহার দিতে হবে। কেউ অন্যের গল্প শুনতে চায় না। মানুষ যদি একটি ছবির চরিত্রে নিজেকে খুঁজে না পায় তবে কেন সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবির জন্য বসে থাকবে? সম্প্রতি বেশ কিছু ছবিতে কাজ করেছি। কিন্তু অনেস্টলি বলছি, এসব ছবির গল্প দুর্বল। কাজ করতে করতেই শিল্পীরা বুঝতে পারছেন এটা কেউ গ্রহণ করবে না। ইন্ডাস্ট্রি এখন এক-দুজনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। গল্প, চরিত্র সবকিছুই একজন ঘিরে হয়। একজনকে ঘিরে হতে পারে যদি সেই একজন সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হন। এটা আমাদের ভাবতে হবে। কিন্তু আমরা তা ভাবছি না। তোষামোদিতে মেতে উঠেছি। এটা পুরো শিল্পের জন্য হতাশার। আর এজন্যই সিনিয়ররা এখন কাজের আগ্রহ পান না। একজন আলমগীর, সোহেল রানা বা ইলিয়াস কাঞ্চন ইচ্ছে করলেই যেমন তেমন চরিত্রে হাজির হতে পারেন না। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ার বলো আর অভিজ্ঞতাই বলো, একটা দায়বদ্ধতা কিন্তু থাকে বাবা।

বর্তমান সময়ে অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে আপনার মূল্যায়ন ...

মূল্যায়নের কথা খুব বেশি জানাতে চাচ্ছি না। এসব না বলাই ভালো। অনেকেই বলে থাকেন, সিনিয়ররা কেবল সমালোচনা করেন। কেন করেন সেটা তারা উপলব্ধি করেন না। একটা কথা বলতে চাই, নতুনদের নিয়ে নির্মাতা ও প্রযোজককে কৌশলী হতে হবে। তাদের জন্য মৌলিক গল্পের চমক জাগানিয়া ছবি বানাতে হবে। রিয়াজ-শাবনূর ও পূর্ণিমার আবারো চলচ্চিত্রে নিয়মিত হওয়া উচিত। এই তিন তারকার জুটি খুব জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তা কোনোদিনই ফুরায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যবহার করতে জানলে চিরকালই জনপ্রিয়তা থাকে। তার অনেক প্রমাণ আছে। শাহরুখ-কাজল জুটির জনপ্রিয়তা বেচে ‘দিলওয়ালে’ নামে একটা অচল গল্প চালিয়ে দিয়েছে বলিউড। সেখানে কিন্তু তারা ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ ছবির মতো কলেজপড়ুয়া না। তাই বলছি, রিয়াজ-শাবনূর বা রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারলে ইতিবাচক কিছু হতেই পারে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এবং ওদের জুটির ছবির আলাদা কদর আছে। তাছাড়া বাকি অনেকেই ভালো আছেন। অনেক নতুন মুখ আশা জাগাচ্ছে। তাদের অভিনয়ও ভালো। একটু সুযোগ দরকার। কিন্তু অধিকাংশই ছবির গল্প, চরিত্র নিয়ে না ভেবে পারিশ্রমিক নিয়ে আগে চিন্তা করেন। এটা শিল্পীসুলভ আচরণ না।

এখন তো যৌথ প্রযোজনায় ছবি তৈরির হিড়িক পড়েছে। সে সম্পর্কে কিছু বলুন ...

যৌথ প্রযোজনায় আগেও ছবি তৈরি হয়েছে। তবে এখনকার ছবিগুলোতে নানা অনিয়মের কথা কানে আসে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয় না। একশ্রেণির পয়সাওয়ালা লোক ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের পকেটে নিতে চাচ্ছে। যৌথ প্রযোজনায় ছবির বিপক্ষে আমি নই। তবে সেটা অবশ্যই হতে হবে নীতিমালা মোতাবেক।

তাছাড়া বর্তমানে অনিয়মের মধ্য দিয়ে ছবি আমদানি করারও সমালোচনা হচ্ছে। আমার মনে হয় অনেক সমস্যা আছে, সেগুলো জনগণ জানে। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি নতুনদের এ অনিয়ম রোধে এগিয়ে আসতে হবে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে গণমানুষকে বেঁধে রাখতে হবে। আজ যে ছবিটি অনিয়ম করে এদেশে চলছে, তার জন্য যদি দেশের মানুষ মাঠে নামত তবে চিত্রটা ভিন্ন হতে পারত। কিন্তু কেন মানুষ নামবে? এখন তো চলচ্চিত্র মানুষ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আমাদের তাই গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় শাখা হিসেবে গণমানুষকে কাছে টানতে হবে। নিজে তারকা হবার পাশাপাশি পুরো ইন্ডাস্ট্রিটাকে তারকা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

আরকে/এএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিনোদন এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh