• ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
logo

অপার সম্ভাবনার ‘ব্লু ইকোনোমি’

সরোয়ার আমিন বাবু ও মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান; চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ২৮ মে ২০১৭, ২১:৩৪

ব্লু ইকোনোমি বা সমুদ্র সম্পদ নির্ভর নীল অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্র বিজয়ের পর এই বিপুল সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটে উন্নীত করা সম্ভব। তবে তারা এও বলছেন, এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। আর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার ‘ব্লু ইকোনোমি সেল’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে। সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, তারা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছেন, অচিরেই যার সুফল মিলবে।

২০১৩ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সামুদ্রিক এলাকায় এখন বাংলাদেশ তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে অনায়াসেই। আর এখানকার সব ধরনের খনিজ সম্পদ এবং প্রাণীজ সম্পদের পুরো অধিকারও বাংলাদেশের।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সাইন্সেস অ্যান্ড ফিসারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জামাল হোসেন আরটিভি অনলাইনকে বলেন, আমাদের বিরাট সমুদ্রসীমায় লিভিং সোর্সের মধ্যে মৎস সম্পদের বিশাল সম্ভার রয়েছে। যেমন সমুদ্রে টুনা জাতীয় মাছ যেটি এখনো আমরা আহরণ করতে সক্ষম হইনি। আর নন লিভিং সোর্সের মধ্যে তেল, গ্যাস এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের বিশাল সম্ভার রয়েছে। পর্যটন এবং সামুদ্রিক বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।

এই অধ্যাপক বলছেন, তবে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। আর এজন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য একটি ‘মাল্টি সেক্টরাল পলিসি ডেভেলপ’করতে হবে।

মূলত জাতিসংঘ কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে ১৯৯৪ সালে গুন্টার পাউলি প্রথম ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা হিসেবে পরিবেশ বান্ধব ব্লু ইকোনোমির ধারণা দেন। ক্রমেই তার এই ধারনাটি বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় অর্থনৈতিক মডেলে পরিণত হয়েছে। সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটের একটি নিবন্ধে ব্লু ইকোনোমির সম্ভাবনাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছে।

রিয়ার এডমিরাল এম খুরশিদ আলম লিখিত ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ সালে প্রায় ২৫০০টি বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে এসেছে এবং ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি রপ্তানি হয়েছে। তবে এসব পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশি মালিকানাধীন মাত্র ৭৪টি (২০১৪) নিবন্ধিত বাণিজ্য জাহাজ রয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ফলে সামুদ্রিক জাহাজে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় বাংলাদেশের আরো অংশগ্রহণ করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

নিবন্ধটিতে বাংলাদেশে ব্লু ইকোনোমি সম্পর্কিত বিভিন্ন শিল্প এবং অবকাঠমো যেমন: জাহাজ নির্মাণ শিল্প, কোস্টাল শিপিং, পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙ্গা শিল্প, সমুদ্রবন্দর, মৎস সম্পদ, সামুদ্রিক জলজ প্রাণির চাষাবাদ, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, সামুদ্রিক লবন উৎপাদন, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, তেল, গ্যাস ও অন্যান্য সামুদ্রিক খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান, সামুদ্রিক পর্যটনের বিভিন্ন খাত, সমুদ্র অর্থনীতিকেন্দ্রিক মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং পরিকল্পনা প্রণয়নসহ বিপুল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরাও বলছেন এই সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্রই পাল্টে যাবে। ব্লু ইকোনোমি ঘিরে নতুন নতুন শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে। যাতে কর্মসংস্থান হতে পারে অসংখ্য মানুষের।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ আরটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ব্লু ইকোনোমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সরকার ইতোমধ্যেই বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ গঠন করা যেতে পারে, যারা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলছেন, ব্লু ইকোনোমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে চট্টগ্রামকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ ব্লু ইকোনোমিকেন্দ্রিক পরিকল্পনাগুলো এখান থেকেই বাস্তবায়ন করা অনেক বেশি সহজ হবে।

ব্লু ইকোনোমির সম্ভাবনা সম্পর্কে বন্দরের প্রশাসন এবং পরিকল্পনা বিভাগের সদস্য মোহাম্মদ জাফর আলম আরটিভি অনলাইনকে জানান, ব্লু ইকোনোমির যে বিশাল ক্ষেত্র সেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষের ইন্টারিম পার্টটিতে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর এজন্য আমরা পতেঙ্গা টার্মিনাল, বে টার্মিনাল এবং গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণনহ নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছি।

এদিকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বার্ষিক (২০১৫-১৬) প্রতিবেদনে সমুদ্র বিজয়ের পর বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকার ভূ-গঠন, তেল-গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ‘মাল্টি ক্লাইন্ট সিসমিক সার্ভে’পরিচালনার কথা জানানো হয়েছিল। যার কিছুটা অগ্রগতিও হয়েছে, এবছরের ১৪ মার্চ বঙ্গোপসাগরের ডিএস-১২ নম্বর ব্লকে তেল, গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের জন্য কোরিয়ান কোম্পানি পোসকো দেইয়ু করপোরেশন এর সঙ্গে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলা। কোরিয়ান কোম্পানিটি ওই ব্লকে দ্বিমাত্রিক এবং ত্রিমাত্রিক সিসমিক সার্ভে পরিচালনা করবে।

এরইমধ্যে সরকার ব্লু ইকোনোমিকেন্দ্রিক এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রায় ২৫টি মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার সমন্বয়ে এবছরের ৫ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ব্লু ইকোনোমি সেল’ নামে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করেছে। এই সেলে ২৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

ব্লু ইকোনোমি সেলের কর্মকর্তা কমোডর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী আরটিভি অনলাইনকে বলেন, ব্লু ইকোনোমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আমরা এখন এডিবি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিতভাবে কাজ করছি। এ ব্যাপারে আমার তাদের পরামর্শগুলো গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি। চীনের সঙ্গেও আমাদের এ ব্যাপারে ‘এমওইউ’সই হয়েছে। এছাড়া আসছে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কে ‘ব্লু ইকোনোমি’সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশও অংশগ্রহণ করছে, যাতে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতাগুলোকে আমরা কাজে লাগাতে পারি।

তবে কমোডর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলছেন, এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান সমস্যা হল সমুদ্রে গবেষণা এবং জরিপ পরিচালনা করার জন্য কোনো বিশেষায়িত জাহাজ নেই। দ্রুত এধরনের একটি জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং খুব শীঘ্রই এটি তার কার্যক্রম শুরু করতে পারবে বলে আশা করছি। এর ফলে আমরা আমাদের সমুদ্রসীমায় সিসমিক সার্ভেসহ নানা রকম গবেষণা ও জরিপ আমরা নিজেরাই পরিচালনা করতে পারব এবং জানতে পারব কি পরিমাণ সম্পদ সেখান থেকে আহরণ করা সম্ভব। এতে আমাদের বিদেশ নির্ভরতা কমবে।

এই কর্মকর্তা আরো জানান, আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি যাতে ব্লু ইকোনোমির সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি। আর সেটি করতে পারলে দেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি ব্লু ইকোনোমিকেন্দ্রিক নতুন নতুন অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

জেএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • অর্থনীতি এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh